আমরা শুধুই মুক্তিযোদ্ধা
‘আমাদের বাড়ি ছিল পদ্মার পারে। চর এলাকা। দিনভর নদীর বুকে সাঁতার কাটা আর বালিজাল দিয়ে মাছ ধরাতেই ছিল আনন্দ। বন্ধু ইউসুফ ও হাসনকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই বানাতাম কলার ভেলা। ভাদ্র মাসে দিনগুলো কাটত অন্য রকম। ঘুরে বেড়াতাম নৌকা নিয়ে। আর ইলিশের স্বাদে হতাম তৃপ্ত।
গ্রামের ফকির মোল্লা ছিলেন আমার দাদা। খুব নামি লোক। বেয়াদবি দেখলে আমাদের কান ধরে উঠবস করাতেন। মাথায় কাপড় ছাড়া কোনো বউ তার সামনে দিয়ে যেতে পারত না। তা ঘটলে ডেকে আনা হতো তার স্বামীকে।
গ্রামে দু-একজনের বাড়িতে ছিল রেডিও। পঁয়ষট্টিতে যুদ্ধ হয় ভারত-পাকিস্তান। ওই যুদ্ধের বাজনা ও চরমপত্র আগ্রহ নিয়ে শুনতাম। রেডিওর খবর আর মুরব্বিদের আলোচনা থেকে জেনে যেতাম বৈষম্যগুলো। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও আমরা শুনি রেডিওতে।
শেখ মুজিবকে তখনো দেখিনি। বড়দের কাছে শুনতাম, তিনি আমাদের জন্য লড়াই করছেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে সারা দেশে পাকিস্তানি আর্মি নামে। আর্মিরা আসার আগেই আমাদের দুগলিয়া বাজারে ক্যাম্প বসায় রাজাকাররা। জব্বার ছিল ওই ক্যাম্পে সার্বিক দায়িত্বে। সামাদ ছিল কমান্ডে।
পাবনায় রাজাকারদের বড় নেতা ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। গ্রামের মজিদ চেয়ারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধু পক্ষের লোক। কিন্তু অন্য গ্রামের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল মতিউর রহমান নিজামীর।
সে সময় রাজাকাররা যাদের ধরে নিয়ে যেত, তারা আর ফিরে আসত না। একবার বাবর আলী নামের আমার এক আত্মীয়কে তুলে আনে তারা। পরে তার কোনো খোঁজ মেলেনি। রাজাকাররা বাঙালি হিন্দু এলাকায় অত্যাচার চালাত। লুটে নিত তাদের সর্বস্ব। এসব দেখে ঠিক থাকতে পারতাম না। মনটা অস্থির হতো। একদিন সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার।’
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া প্রসঙ্গে এভাবেই বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কেয়ামউদ্দিন মোল্লা। তার পিতার নাম ইসারত মোল্লা ও মাতা খোদেজা খাতুন। ৬ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাড়ি তার পাবনা সদর উপজেলার দিঘীগোয়েল বাড়ি গ্রামে। বর্তমানে বয়স একষট্টি।
কেয়ামউদ্দিন বিয়ে করেন মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে। নববধুকে ফেলে, পরিবারকে না জানিয়ে একদিন তিনি চলে যান মুক্তিবাহিনীতে। কেয়ামউদ্দিনের ভাষায়, ‘ভোরের দিকে রওনা দিয়ে আমরা প্রথম কুষ্টিয়া আসি। ইয়াকুব আলী ও সিদ্দিকসহ আমরা ছিলাম ৪ জন। রাতের মধ্যে পৌঁছি বর্ডারে। পরদিন সকালে চলে আসি ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা বাজারে। সেখানেই আমরা মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখান থেকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় দোলঙ্গি হয়ে মালদাহ গোরবাগানে। সেখানে চলে ১৩ দিনের লেফট-রাইট। অতঃপর ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। আটাশ দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আমাদের। আমার এফএফ নং ছিল ৭৭৪৯।’
ট্রেনিং শেষে কেয়ামউদ্দিনদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় তরঙ্গপুরের কালিয়াগঞ্জে। সেখান থেকে মেলে অস্ত্র। ওই ক্যাম্পের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘৪ হাজার লোক খেত এক নোঙরে। দুপুর ২টায় দাঁড়ালে খানা মিলত ৪টায়।’
অস্ত্র নিয়ে দোলঙ্গি ক্যাম্প হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেন কেয়ামউদ্দিনরা। তারা ছিলেন গেরিলা। তাদের আত্মগোপন করে থাকতে হতো দেশের ভেতরেই। কেয়ামউদ্দিনদের ৩১ জনের দলটির কমান্ডে ছিলেন রশিদ সরদার।
কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেন? এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা কেয়ামউদ্দিন বলেন, ‘আমরা দিনের বেলায় ইনফরমেশন নিতাম। আর রাতে সেমতে চলত অপারেশন। এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিতাম ব্রিজগুলো। অবকাঠামো ও পাকিস্তানিদের যোগাযোগব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়াই ছিল কাজ। তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের বাড়িতে আমরা দিনে লুকিয়ে থাকতাম। অনেকেই নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়াত। গরিব ঘর হলে খরচটা দিতাম। কিন্তু তা নিতে চাইত না অনেকে। এভাবে আমরা অপারেশন করি ৭ নং সেক্টরের লালপুর, ভেড়ামারা, ঈশ্বরদীতে।’
একটি অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা কিয়ামউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে তার ডান হাতের হাড় ফেটে যায়। ছিঁড়ে যায় কয়েকটি রগ। ফলে ওই হাত হয়ে যায় অকেজো। হাতের দিকে তাকালে আজও সেসব ঘটনা তার মনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কী ঘটেছিল সেদিন? শুনি তার জবানিতেই।
‘ডিসেম্বরের ৭ তারিখ। রাত একটা। ঈশ্বরদীর বাবুচরা গ্রাম থেকে আমরা মুভ করে পাবনায় আসি। অন্যান্য জায়গা থেকে আসে আরও কয়েকটি দল। সবাই মিলে পরিকল্পনা হয়। দখল করতে হবে পাবনার মেন্টাল হাসপাতাল। সেখানে ছিল পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি। চার প্রুপে আমরা ২০০ জনের মতো। কমান্ডে পাবনার রফিকুল ইসলাম বকুল।
প্রথম ফায়ার করবে পশ্চিম ও দক্ষিণের গ্রুপ। তেমনটাই পরিকল্পনা। আমি ছিলাম পশ্চিমের গ্রুপে। ভোর তখন ৪টা। শুরু হয় গোলাগুলি। পাকিস্তানিদের কাছে ছিল অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। ফলে আমরা টিকতে পারছিলাম না। ক্রলিং করে সামনে এগোই। আমার পাশে এলএমজি চালাচ্ছে সেলিম। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, তার মাথায় গুলি লেগেছে। শরীরটায় কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়েই সে মারা গেল। আমি তাকে ধরতে পর্যন্ত পারলাম না। ফজরের দিকে পেছনে হটার নির্দেশ এল। আমি গুলি চালাতে চালাতে পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করি। সে সময় দুটি গুলি এসে লাগে শরীরে। একটি আমার সোয়েটারে ভেতর আটকে যায়। কিন্তু অন্যটি আমার ডান হাতে বিদ্ধ হয়। হাত থেকে তিরতির করে রক্ত বেরোচ্ছিল। আমি আর নড়তে পারি না। পানি পিপাসায় ছটফট করতে থাকি। কিন্তু কেউ আমাকে পানি দেয় না। পানি খেলে মৃত্যু ছিল অবধারিত। তাই সমরে আহত কাউকে প্রথমে পানি দেওয়া হতো না। সহযোদ্ধারা গরুর গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে যায় বাবুচরায়। সেখানে এক ডাক্তার গুলি বের করে আমার হাতে সেলাই করে দেয়। পরবর্তীকালে চিকিৎসা হয় কলকাতায়। কিন্তু গুলিতে আমার হাতের হাড় ফেটে যাওয়া এবং কয়েকটি রগ ছেঁড়ার কারণে সারা জীবনের জন্য আমার হাতটি অকেজো হয়ে যায়।’
মুক্তিবাহিনীতে কোন শ্রেণীর লোকেরা গিয়েছিলেন? উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা কেয়ামউদ্দিন বলেন, ‘শতকরা ৮৮ জনই ছিল কৃষক ও সাধারণ ছাত্র। বড় লোকের ছেলেরা গিয়েছে খুব কম। তারা অনেকেই জীবন বাঁচাতে চলে গিয়েছিল ভারতে।’ পাবনার কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় নাসিম সাহেব ছিলেন প্রধান সংগঠক। মাঠে ছিলেন ইকবাল, রফিক, কাজী আরেফ, বকুল প্রমুখ।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে কথা উঠতেই এ মুক্তিযোদ্ধা নিজের অভিমত তুলে ধরেন অকপটে। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনের পরপরই ছিল তালিকা তৈরির আসল সময়। মুক্তিযোদ্ধা কতজন ভারতে ট্রেনিং নিয়েছিল, কতজন মুজিব বাহিনী ও কাদের বাহিনীতে ছিল- এসব তথ্য তখন এক করলেই তালিকা হয়ে যেত।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এখন রাজনীতির প্যাঁচে পড়েছে। ২ লাখ ২৫ হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধা নেই। এর মধ্যে ২৫ হাজার আর্মি। বাকিরা ছাত্র জনতা।’
তিনি মনে করেন, স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগে ডুপ্লিকেট মুক্তিযোদ্ধারাই টাকার বিনিময়ে এ তালিকা বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনের পর আমরা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়েছি। ডিফেন্সের যোদ্ধারা বলেন, তারা দেশটা স্বাধীন করেছে, মুজিব বাহিনীর লোকেরা বলেন, তারাই ছিলেন প্রধান ভূমিকায়, আর আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বলি, আমরাই তো যুদ্ধ করেছি।’ মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য খারাপ হয়েছে। আমরা তো কোনো দলের নই। আমার শুধুই মুক্তিযোদ্ধা।’
স্বাধীনের পর কোনো মুক্তিযোদ্ধার না খেয়ে থাকার খবরে কষ্ট পান এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশন অনেক নিচে নেমে গেছে। দেশের ক্ষমতায় ছিল চিহ্নিত রাজাকাররা। আর এখন তো টাকাওয়ালাদের কাছে চলে গেছে দেশটা।’
স্বাধীন দেশের উন্নয়ন দেখলে ভালো লাগে এই মুক্তিযোদ্ধার। এ দেশের সোনার ছেলেরা যখন বিদেশের মাটিতে খেলায় জিতে বাংলাদেশের পতাকাকে সম্মানিত করে, তখন গর্বে বুক ভরে যায় মুক্তিযোদ্ধা কেয়ামউদ্দিনের।
স্বাধীন দেশে খারাপ লাগা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজাকারের ছায়া দেখলেই খারাপ লাগে। যারা এ দেশে দুর্নীতি করছে তাদের দেখলে ঘৃণা আসে। কিছু খারাপ লোক রাতারাতি বড়লোক বনে গেল। আমরা চেয়েছিলাম সোনার বাংলা। এখন সোনার বাংলা আছে মুখে মুখে।’
পরবর্তী প্রজম্মের কথা উঠতেই খানিক নীরব থাকেন মুক্তিযোদ্ধা কেয়ামউদ্দিন মোল্লা। তার আশা, কোনটি দেশের জন্য ভালো, তা ঠিকই বুঝে নেবে পরবর্তী প্রজম্ম। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা বর্তমানের মতো নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং তৈরি করো না। দেশের স্বার্থে তোমরা এক হয়ে কাজ করো। দেশটাকে ভালোবেসো। তাহলেই দেশ উন্নত হবে। দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের আত্মাও শান্তি পাবে।’
© 2012 – 2021, https:.