‘আমরা ছিলাম গেরিলা’
‘ট্রেনিং তখন শেষ। আমাদের পাঠানো হয় তরঙ্গপুরে। সেখান থেকে বরাহার ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন এসএস বার্ট। তার নির্দেশেই আমার অপারেশন শুরু। আমরা যুদ্ধ করি ৭ নং সেক্টরে। বাড়ি আমার ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর এলাকায়। তাই প্রথম ডিউটি পড়ে ওই এলাকাতে। ফুলবাড়ীর চিন্তামনে ছিল পাকিস্তান আর্মিদের ছোট্ট একটি ক্যাম্প। কী পরিমাণ অস্ত্র ও কতজন পাকিস্তানি আছে সেখানে? এ বিষয়ে রেকি করতে হবে। আমরা পাঁচজন। সন্ধ্যায় বেরিয়ে সব তথ্য নিয়ে আবার ফিরে আসি ক্যাম্পে।
আগস্ট মাসের ৭-৮ তারিখ। মোহনপুর ব্রিজে হ্যারেজম্যান্ট ফায়ারের নির্দেশ আসে। আমার সঙ্গে দেওয়া হয় ১০ জনকে। কমান্ডে আমি নিজেই। প্রথমে সনদিয়া ক্যাম্পে ও পরে আসি আমবাড়ির হাজীবাড়িতে। ওখান থেকে ব্রিজের দিকে গুলি করার প্রস্তুতি নিই আমরা। ব্রিজের ওপর টহল দিচ্ছিল পাকিস্তান আর্মিদের বেশ কয়েকটি গাড়ি। তাদের লক্ষ্য করে আমরা গুলি চালাই। প্রত্যুত্তরে শুরু হয় বোম্বিং। কোনো রকমে আমরা বেঁচে যাই সে-যাত্রায়।
১৬ আগস্ট ১৯৭১। নির্দেশ আসে পার্বতীপুর আক্রমণের। আমরা ১১ জন। আমজাদ হোসেন ছিলেন কমান্ডে। সন্ধ্যায় আমবাড়ি উচিতপুর হয়ে আমরা ঢুকে পড়ি বাংলাদেশে। রাতে ১টার মধ্যে পৌঁছে যাই ফরিদপুর হাটে। সেখানকার একটি পানের বরজের ভেতর আমরা রেস্ট নিই। অতঃপর ভবানীপুরের পূর্র্বদিক হয়ে আমরা পৌঁছে যাই খয়পুকুর হাটে। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ছিল সেখানে। আমরা তখন ৬৪ জন। পরিকল্পনা হয় খোলাহাটি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার। কমান্ডে ছিলেন পার্বতীপুরের আলাউদ্দিন। রাতের আঁধারে মাইন দিয়ে ব্রিজটিকে উড়িয়ে দিই আমরা।
আমরা ছিলাম গেরিলা। আক্রমণ করেই সরে পড়তাম। আনন্দবাজারে বেলালের বাড়িতে আমাদের ঠাঁই হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি। একদিন তার মেয়ে আসে শ্বশুরবাড়ি থেকে। পরনে সাদা কাপড়। তার স্বামী রাজাকার ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাই তাকে মেরে ফেলেছে। বেলাল নিজের মেয়েকেই বোঝাচ্ছিলেন ‘ও দেশের শক্র ছিল। মুক্তিবাহিনীরা ঠিক কাজটিই করেছে।’ এসব ঘটনা আমাদের আরও সাহসী করে তোলে।
আনন্দবাজার থেকে যেতে হবে রংপুর শটিবাড়িতে। রাতে রওনা দিয়েও মালুয়াছড়ায় পৌঁছাতেই ভোর হয়ে গেল। ওই এলাকাটিতে অধিকাংশই ছিল বিহারি ও রাজাকাররা। আমরা কৌশলী হলাম। যারা উর্দু ও হিন্দি জানে শুধু তারাই কথা বলবে। তাই ঘটল। আমাদেরকে রাজাকার ভেবে এক বিহারি এসে জানাল কোথায় কোথায় মুক্তি আছে। অবস্থা বেগতিক দেখে তখন দ্রুত আমরা ওই এলাকা ছাড়ি। গেরিলার বেশে এভাবেই যুদ্ধ করছিলাম আমরা।’
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনার কথা বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সুধীর চন্দ্র রায়। তার গ্রামের বাড়ি পার্বতীপুরের চন্ডীপুরে। বাবার নাম ধরনী ধর রায় ও মা রাজেশ্বরী রায়। বাবা ছিলেন হাবরা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। ৫ ভাইবোনের মধ্যে সুধীর ভাইদের মধ্যে বড়। লেখাপড়ার শুরু শমসের নগর প্রাইমারি স্কুলে। পরবর্তীকালে রাজারামপুর হাইস্কুল, জয়পুরহাট কলেজ, পার্বতীপুর কলেজ হয়ে তিনি ভর্তি হন নীলফামারী সরকারি কলেজে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বিএসসি পরীক্ষার্থী।
ছোটবেলা থেকেই সুধীরের ঝোঁক ছিল মাছ ধরাতে। একরাতে বন্ধু শ্রীকান্ত নাথ মন্ডলের সঙ্গে মাছ ধরতে বেরোয় সুধীর। মশাল হাতে ভোররাত পর্যন্ত চলে মাছধরা। আলো দেখে থমকে দাঁড়াত শিং ও সাটি (টাকি) মাছ। সে সুযোগে দায়ের কোপে ধরা পড়ত মাছগুলো। সেদিন বাবার পিটুনিতেও বন্ধ হয়নি সুধীরের মাছ ধরার নেশা।
কলেজেই সুধীর যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তানিদের বৈষম্যের নানা খবরাখবর পেতেন সেখান থেকেই। তখন শেখ মুজিব ছিলেন সবার কাছে আলোচিত নেতা। মার্চের ৩ তারিখ ঢাকায় শেখ মুজিব ভাষণ দেবেন। আগের দিন কলেজে গিয়েই এমন খবর পান সুধীর। খবরটির যাচাই না করেই বঙ্গবন্ধুর টানে বন্ধু বিনয়, বীরেন, সুশীলসহ সুধীর ট্রেনে চলে যান ঢাকাতে। পরদিন আবার হতাশ মনে ফিরে আসেন পার্বতীপুরে। পরবর্তীকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শোনেন রেডিওতে।
পাকিস্তান আর্মিরা পার্বতীপুর আক্রমণ করে ৯ এপ্রিল। স্থানীয় রাজাকার ও বিহারিদের সহায়তায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রামগুলো। ভবানীপুরসহ হিন্দু এলাকায় চলে হত্যা ও লুটতরাজ। ভয়ে পরিবারসহ সুধীররা চলে যান ভারতের জলপাইতলীতে। থলসামা বাজারের পাশে মেলে আশ্রয়।
কেন এবং কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন? এমন প্রশ্নে সুধীর বলেন, ‘মে মাসের দিকে ছোট ভাইকে নিয়ে চলে আসি কুমারগঞ্জ শরণার্থী ক্যাম্পে। কিন্তু মানুষের চাপ ও কলেরায় সেখানে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছিল দু-একজন। একবার ছোট ভাইকে নিয়ে যাই কুমারগঞ্জ হাসপাতালে। সেখানকার এক কম্পাউন্ডার আমাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘দেশ লুটে নিচ্ছে ভিনদেশিরা। অথচ তোমরা যুবক ছেলেরা এ দেশে বসে বসে খাচ্ছ।’ কথাটা শুনে খুব মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কথাটা তো সত্য ছিল। এভাবে আর কত দিন? সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে রায়গঞ্জ ও গঙ্গারামপুর। সেখানে পাই জর্জ আর এন দাশকে। তিনি উদ্যোগী হয়ে একটি ইয়ুথ ক্যাম্প গড়ে তুলছিলেন। আমরা ১০০ জন ছিলাম সেখানকার প্রথম ব্যাচ। তিন-চার দিন চলে লেফট-রাইট। অতঃপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। ২৮ দিন চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। আমার এফএফ নং ছিল ২৬১৮।’
কথায় কথায় মুক্তিযোদ্ধা সুধীর চন্দ্র জানালেন আহত হওয়ার ঘটনাটি। তাঁর ভাষায়, ‘দেশ তখন স্বাধীন। অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আপনজনদের সঙ্গে কাটালাম কয়েকটা দিন। নির্দেশনা ছিল দিনাজপুরে রিপোর্ট করার। ৬ জানুয়ারি ১৯৭২। সকালে রিপোর্ট করি মহারাজা স্কুল মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ছিলেন সেটির দায়িত্বে। স্বাধীনের পরেও দিনাজপুরের পথে-ঘাটে মাটির নিচে পুঁতে রাখা ছিল মাইন। মুক্তিযোদ্ধারা তল্লাশি চালিয়ে তা এনে জড়ো করে রাখে মহারাজা স্কুলের আন্ডারগ্রাউন্ডে বিশেষ রক্ষণাগারে।
‘স্কুল ভবনে ছিল পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা খানিকটা বিশ্রাম নিই। সন্ধ্যার ঠিক আগে হুইসেলের শব্দ। দোতলা থেকে দেখলাম, মাঠের মধ্যে প্রবেশ করেছে একটি ট্রাক। ট্রাকটি মাইন ও অস্ত্র-বিস্ফোরকে ভর্তি। অতএব সেটিকে আনলোড করতে হবে।
‘সবার সামনে দাঁড়াই আমি। ট্রাক থেকে মাল নামাব, হঠাৎ বিস্ফোরিত হয় ট্রাকটি। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে ট্রাকের ভেতরের বিস্ফোরক এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে রাখা মাইনগুলোতে। বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে আশপাশ। আমি তখন ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারাই। খানিক পরে দেখি, গোটা স্কুল ভবনটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চারপাশে ছোপ ছোপ রক্ত। পাশেই দেখলাম বন্ধু সোহরাবকে। তার শরীরে মাংস নেই। তোজাম্মেলের পা গেছে উড়ে। হাত ঝলসে গেছে অনেকেরই। চারদিকে চিৎকার। নিজের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি। পেট, বাম পা ও কোমরের মাংসটা ছিঁড়ে নেমে পড়েছে। গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে সেদিক দিয়ে। আমি পেট চেপে ধরছিলাম যেন ভুঁড়িটি বেরিয়ে না যায়। প্রায় দেড় মাস আমার চিকিৎসা চলে রংপুর মেডিকেলে। সেদিন শহীদ হন ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২২৫ জন।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুধীর চন্দ্র রায় যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। রাজাপুর হাইস্কুল, হাবরা হাইস্কুল, বুড়ি পুকুরহাট হাইস্কুলে চলে তার শিক্ষকতা। পরে তিনি চাকরি করেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে।
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘জিয়ার কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণাটি আমি নিজেই শুনেছি। কিন্তু তখনো জানি না জিয়া কে? কিন্তু তখন একধরনের মনোবল পেয়েছিলাম। বুঝেছিলাম সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকেরা আমাদের সঙ্গে আছেন।’
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে নানা বিতর্কের কথা উল্লেখ করে মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘ঘোষণা শুনেই বাঙালিরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই কথাটি ঠিক নয়। তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কি কোনো রেইস ছিল যে ঘোষণার পর পরই সবাই যুদ্ধ শুরু করে দিল।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পরেই এটি করা উচিত ছিল। তখন সরকারের কাছে সব রকম রেকর্ড ছিল। ক্যাম্পে ক্যাম্পে ছিল তালিকা।’ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে সুধীর বলেন, ‘এর পেছনে মুক্তিযোদ্ধারাই দায়ী। একজন মুক্তিযোদ্ধার শনাক্তকরণ ছাড়া কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না।’ তিনি মনে করেন, সুবিধা দেওয়ার পূর্বেই সরকারের উচিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটিকে চূড়ান্ত করে ফেলা।’
আলবদর ও রাজাকারদের পাশাপাশি ১৯৭১-এ বিহারিদের একটি বড় অংশ গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল। সুধীর তাদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাটিও সঠিক ছিল না। তার ভাষায়, ‘ছোট হোক, বড় হোক তারা কিন্তু অপরাধী ছিল। ফলে মাফ না করে তাদের কিছুটা হলেও শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল।’
শক্ত কথার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আমরা আসি ভালো লাগা প্রসঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা সুধীর বলেন, ‘স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবসে যখন মানুষের আনন্দ দেখি, বাতাসে ওড়ে লাল-সবুজ পতাকা, তখন সত্যি অন্য রকম লাগে।’ খারাপ লাগার কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি দেখলে কষ্ট লাগে। এ রকম দেশ তো আমরা চাইনি।’
তিনি অকপটে বলেন, ‘আমরা কিন্তু তলাবিহীন ঝুড়ি নই।’
মুক্তিযোদ্ধা সুধীর মনে করেন, দেশে যা সম্পদ আছে তার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়। আর এ জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমিক ও সৎ হওয়া। দেশকে ভালোবাসলে যেকোনো কাজে উন্নতি আসবেই। মুক্তিযোদ্ধা সুধীরের বিশ্বাস, একদিন সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ হবেই। আর এ স্বপ্নের কান্ডারী হবে পরবর্তী প্রজš§। নতুনদের নিয়ে এমনটাই আশা তার।
© 2012 – 2021, https:.