পায়ের ভেতর এখনো গুলি আছে
এক মুক্তিযোদ্ধার পায়ের ভেতর এখনো গুলি আছে। একচল্লিশ বছর ধরে শরীরের ভেতর বাসা বেঁধেছে সে গুলিটি। জোরে হাঁটতে কিংবা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে গুলিটি কামড়ে ধরে মাংসের ভেতরটায়। যন্ত্রণায় তখন ছটফট করেন তিনি। পাকিস্তানিদের গুলি মুক্তিযোদ্ধার দেহে। এটা মেনে নেওয়া সত্যি কঠিন। তাই নীরবে নিভৃতে কেটে যাচ্ছে ওই মুক্তিযোদ্ধার জীবন।
মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের কথা এভাবেই বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সুধীর চন্দ্র রায়। একই সঙ্গে তিনি জানালেন তার সাক্ষাত মিলবে ঢাকাতেই। আমরা আগ্রহী হয়ে ঠিকানাটি জেনে নিই। অতঃপর এক বিকেলে পা রাখি তার বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে চলে দীর্ঘ আলাপচারিতা।
মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের বাবার নাম ডা. আলতাফ হোসেন মোল্লা ও মায়ের নাম সাজেদা বেগম। দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার রাজনগর গ্রামে। তার বাবা ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক।
দেলোয়ারের পড়াশোনা শুরু বগা হাইস্কুলে। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তিনি চলে যান খুলনার খালিশপুরে। সেখানকার জুট মিলে চাকরি করতেন তার বড় ভাই। প্রথমে চরের হাট হাইস্কুল এবং পরে দেলোয়ার ভর্তি হন পটুয়াখালী সরকারি কলেজে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। তিনি ওই কলেজের ছাত্র সংসদের সদস্যও ছিলেন।
ছোটবেলার কথা উঠতেই দেলোয়ার বলেন, ‘এখনো মনে পড়ে পাশের বাড়ির সিরাজ মৃধা ও বাচ্চুর কথা। পুকুর পাড়ে ছিল বাচ্চুর পড়ার ঘরটি। প্রায়ই আমরা সেখানে রাত জেগে একত্রে বসে পড়তাম। শীতের রাতে সবাই মিলে রস জ্বাল দিয়ে খেতাম। মাঝে মাঝে চলত মুরগি ভোজ।’
স্কুলে থাকতেই দেলোয়ার স্কাউটে ভর্তি হন। ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নেন কলেজে উঠে। একজন পাকিস্তানি সুবেদার মেজর ছিলেন তাদের ক্যাডেট প্রশিক্ষক। ট্রেনিংয়ের মাঠে বসে তিনি সবাইকে বলেছিলেন, ‘এই ট্রেনিং একদিন তোমাদের জীবনে কাজে আসবে।’ সত্যি তাই হলো! ক্যাডেট প্রশিক্ষণটি দেলোয়ারের কাজে লেগে যায় মুক্তিযুদ্ধে।
ওই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ দেশের সব খবর পেতেন দেলোয়াররা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি তারা শোনেন রেডিওতে। ওই ভাষণ তাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। তার ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করো।’
তা শুনে আমরা পটুয়াখালী শহরে জড়ো হলাম। গঠন করা হলো সংগ্রাম কমিটি। যুবক বয়সী প্রায় ১০০ জনকে গোপনে দেওয়া হলো ট্রেনিং। ট্রেনিং চলল জুগলি স্কুলের মাঠে। তোহা নামের এক আনসার কমান্ডার ছিলেন প্রশিক্ষক।’
২৫ মার্চে রাতে ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। পটুয়াখালীতে সে খবর আসতেই দেলোয়াররা শহরের চারপাশে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মহিলা কলেজ ছিল তাদের সেন্টার। সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন কাশেম উকিল (আওয়ামী লীগের কাশেম উকিল নামে খ্যাত)। দেলোয়ার বলেন, ‘এলাকায় ছিল অনেক বিহারি। তাদের একটি অংশ ছিল পাকিস্তানিদের অনুসারী। আমরা তাদের নেতাদের ধরে আনি সেন্টারে। কিন্তু দু-এক দিন পরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং করে পটুয়াখালী শহর দখলে নেয়। আমরা তখন কোনো রকমে নৌকাযোগে পটু ইটবাড়িয়া ও লাউকাঠি হয়ে চলে আসি ধইঞ্চায়।’
ধইঞ্চা থেকে লেবু বাড়ি হয়ে দেলোয়ারা ক্যাম্প করেন পাদ্রি শিবপুরের একটি স্কুলে। সেখানে ছিল খ্রিস্টান পাদ্রিদের বাস। এলাকার দায়িত্বে ছিলেন ব্রাদার জল্লাদ। সংখ্যায় দেলোয়াররা ২০০ জনের মতো। খ্রিস্টান পাদ্রিরা খাবার ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে তাদের সাহায্য করতেন। নদীপথে গেরিলার মতো পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর আক্রমণ করে দেলোয়াররা আবার ফিরে আসতেন পাদ্রি শিবপুরে। এভাবেই তারা বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ করছিল।
ট্রেনিংয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই দেলোয়ার বলেন, ‘কিছুদিন পর আমরা কয়েকজন চলে আসি বরিশালে। সেখানে মেজর জলিল মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করছিলেন। আমি মাঠে দাঁড়াতেই প্রশ্ন করলেন, ‘কয় ভাই’। দুই ভাই ও ছোট শুনতেই আমাকে নিয়ে নিল। অনেকেই সেদিন বাদ পড়েছিল। সংসারের বড় ও একমাত্র সন্তানকে রিক্রুট করতেন না মেজর জলিল।’ তিনি বলেন, ‘মেজর মেহেদী হাসান ছিলেন ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার। জুনের শুরুতে তার সঙ্গে আমরা চলে আসি মেহেরপুরে। মুজিবনগরে চলে আমাদের দুই মাসের ট্রেনিং।’
ট্রেনিং শেষে দেলোয়ারদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে। সেখান থেকে তারা পাদ্রি শিবপুর, বাকেরগঞ্জ, দগদগি, শ্যামপুর প্রভৃতি স্থানে অপারেশন করেন।
কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন? এমন প্রশ্নে তিনি খানিকটা নীরব থাকেন। অতঃপর উত্তরে বলেন, ‘নভেম্বরের শেষের দিকের ঘটনা। বাউফল থানা থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা ছোট লঞ্চে খালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ছিলাম দশ-পনেরো জন। কালিশ্বরী নামক জায়গায় খালের এক পাশে ঝুপড়িতে আমরা পজিশন নিই। গুলি করতেই তারা প্রত্যুত্তর দেয়। তাদের একটি গুলি এসে আমার ডান পায়ের রানের ভেতর ঢুকে যায়। আমি তখন পা নাড়াতে পারছিলাম না। তাকিয়ে দেখি পা ভিজে গেছে রক্তে। পাশের যোদ্ধারা গামছা দিয়ে আমার পা-টি বেঁধে দেয়। পাকিস্তানিরা তখন পালিয়ে যায় নদীপথে।’
কোথায় চিকিৎসা হলো? তিনি বলেন, ‘দু-এক দিন চিকিৎসা ছাড়াই সেখানেই থাকি। পরে একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকায় আমাকে লঞ্চে তুলে নেয় সহযোদ্ধারা। বরিশাল সদর হাসপাতালে চিকিৎসা চলে প্রায় এক মাস। স্বাধীনের পর ভর্তি হই পিজি হাসপাতালে। কিন্তু গুলিটি হাড়ের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় তা আর বের করা সম্ভব হয়নি।’
দেলোয়ারের পরিবার জানত তিনি মারা গেছেন। যুদ্ধের সময় এক রাতে গোপনে তিনি গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সেদিনটির কথা শুনি মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ারের মুখেই। কান্না জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাবা ওই দিন থেকে যেতে বলেছিলেন। আমাকে পাশে বসিয়ে খাওয়ালেন। অন্য রকম আদর করলেন। বিদায়ের সময় জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদছিলেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথা উঠতেই এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমরা কোনো বেলায় কোথায় খাব জানতাম না। সাধারণ লোক খাবার জোগাড় করে দিত।’ তার ভাষায়, ‘সে সময় মুক্তিযোদ্ধা ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী ছিল আর ছিল মুক্তিকামী জনতা। এ জনতার সহযোগিতা ছিল বলেই মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনগুলোতে জয়ী হতো।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হতো চরমপত্র। এম আর আখতার মুকুলের পাঠ করা সে চরমপত্র শুনতে উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন দেলোয়ারসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। দেলোয়ারের আজও মনে পড়ে ‘বিছুয়া বাহিনীর কেসকা মাইর’ শিরোনামের চরমপত্রটির কথা।
নানা কথায় কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকার বদল হলেই যদি তালিকা বদল হয়, তবে কখনোই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা হবে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে কিন্তু তালিকা নিয়ে বিতর্ক কমেনি।’ তিনি মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যখন প্রথম গঠিত হয়, তখনই সম্ভব ছিল সঠিক তালিকা তৈরির।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচার কামনা করি। বিচার হওয়া উচিত সে যতই বড় হোক।’ বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু যাদের এখন বিচার করা হচ্ছে তারা তো সাধারণ ক্ষমার তালিকায় ছিল না। আমার ভাইকে যারা হত্যা করিয়েছে। বোনকে যারা তুলে দিয়েছে পাকিস্তানিদের হাতে। তাদেরকে ক্ষমা করার অধিকার কারো নেই।’
২ নভেম্বর ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন পটুয়াখালীতে। বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে। দেলোয়ার তখন খুব কাছ থেকে দেখেছেন এ নেতাকে। তার ভাষায়, ‘এমন চেহারা, এমন চাহনি আমি এখনো দেখিনি। বঙ্গবন্ধু সততার কথা বলতেন। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও সাহস মানুষকে আকৃষ্ট করতো।’ মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। এখন হয়েছে দুর্নীতিগ্রস্থ বাংলাদেশ।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নাই, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দল আছে।’
মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার দুঃখ করে বলেন, ‘যে জন্য যুদ্ধ করে দেশে স্বাধীনতা আনলাম। সে স্বাধীনতার স্বাদ পেল না এ জাতি।’
নানা সমস্যা থাকলেও তিনি মনে করেন, এ দেশ আজ মুক্ত ও স্বাধীন। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেন পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে। তার ভাষায়, ‘তারা নিজেদের ইতিহাসকে জানবে। বাঁচিয়ে রাখবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে। স্মরণ করবে দেশের মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের। তবেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হবে গৌরবের।’
© 2012 – 2021, https:.