ভ্রমণকথা

কালি টি এস্টেটে এক দিন

‘চা বাগানের ভেতরেই বাঁশলাইন, মাদ্রাজিলাইন আর বাংলা টিপাড়ায় চা শ্রমিকদের ডেরা। পাড়াগুলো ঘুরতে গেলে লোকজন আমাদের বসতে দেয়, আপন ভেবে কথা বলে। কার্তিক মাসে কালীপূজায় নেমন্তন্ন করে। এরপর আমরা আবারও টিলা মাড়াই। একেক জায়গা থেকে চা বাগান দেখতে একেক রকম লাগে। সবুজ সৌন্দর্য আমাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।’

বেশ ঢালু ও উঁচু একটি টিলা। গা বেয়ে উঠে গেছে ইটবাঁধা সরু পথ। টিলার বাকি জায়গাটুকু সবুজে মোড়ানো। গায়ে গা মেলানো চায়ের গাছ। ফাঁকে ফাঁকে ছায়াবৃক্ষ। থোকা থোকা সাদা ফুল ছায়াবৃক্ষের মাথায়। এখানে মানুষের কোলাহল নেই। নাম না-জানা পাখিরা নীরবতা ভাঙে। আশপাশে বড় বড় আরো কয়েকটি টিলার দেখা মিলল। সেগুলোও সবুজে মোড়া। মনে অন্যরকম দোলা লাগে।
ইটের পথ বেয়ে টিলার চূড়াতে উঠেই সাহেবি কেতার বাংলোটির দেখা পাই। নীল আকাশ মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক গোলমরিচের গাছ ইতিউতি ছড়ানো। শীতে জবুথবু হয়ে আছে। বাংলো থেকে চারপাশের চা বাগান দেখা যায়। ধোয়া ওঠা তাজা চা দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন বাগানের ম্যানেজার হাসান চৌধুরী।

চার দিন হয় সিলেট সফরে এসেছি মনিরুল আলম, জায়েদ জুলফিকার, আরিফুল ইসলাম ও আমি। সঙ্গে আমাদের পরিবার। বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে ১২ জন। জায়েদ আমাদের দলনেতা। হিসাবে দারুণ পাকা। কানাকড়িও বিফলে খরচের উপায় নেই।
প্রচণ্ড শীত। তবু প্রকৃতি দেখার নেশায় আমরা সটান। আগের রাতে জায়েদ নির্দেশ জারি করেছিল-সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। আমরা অমান্য করার সাহস দেখাইনি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আমাদের গন্তব্য কুলাউড়ার কালি টি এস্টেট। বাগান-মালিক খয়সর আহমেদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছে সিলেটের বন্ধু সিব্বির। একটি মাইক্রোবাসও ঠিক করা ছিল। সকাল ৭টায় সিব্বিরের নেতৃত্বে আমরা সিলেট শহর থেকে রওনা দিলাম।
ড্রাইভারের নাম মামুন। বয়সে নবীন, রসিকও খুব। শহরের শেষ প্রান্তে এসে রাস্তার পাশে গাড়ি থামায়। হাত বাড়িয়ে একটি দোকান থেকে পান নিল। দোকানের সাইবোর্ডে আমাদের চোখ আটকায়। লেখা আছে- ‘খাইলে চাইবায়, না খাইলে পস্তাইবায়’। আমরা পস্তাইতে চাই না। তাই পান চিবাতে চিবাতেই আবার যাত্রা করি।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক গাড়ি চললে মৌলভীবাজার গিয়ে উঠি। আঁকাবাঁকা পথ। দুপাশে মনোরম চা বাগান। বাচ্চারা মাঝে মাঝে আওয়াজ তুলছে ‘ওয়াও, কী সুন্দর! বন্ধু সিব্বিরের অবশ্য এসব কিছু নতুন ঠেকে না। সে গম্ভীরমুখে সিলটি ভাষায় ড্রাইভারকে নির্দেশনা দিচ্ছে-‘হাতর বায়ত, হাতর ডানত যাও’।
বাংলোর ভেতরটাও সুন্দর সাজানো। দামি দামি সব আসবাবপত্র। দুপুরের ভোজের বন্দোবস্তও করেছিলেন বাগানের ম্যানেজার। খেয়েদেয়ে বাংলোর বারান্দায় বসে প্রকৃতি দেখি। ডাকবাংলোর কেয়ারটেকারের নাম ইংলিশ। আমাদের বাগান ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব পান তিনি।
লম্বা টিনশেডের কারখানা ঘরটি কাছেই ছিল। চা পাতা শুকানোর কাজ চলছিল তখন। চা শুকানোর পদ্ধতি দেখে আমরা টিলা থেকে টিলায় ঘোরাঘুরি করি। এক সময় ইংলিশ ভাইকে জিজ্ঞেস করি, বাগানের নাম কেন কালি টি এস্টেট? ইংলিশ ভাই ব্রিটিশ আমলে ফিরে যান-১৮৮৪ সাল। কুলাউড়ায় ছিল সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাস। একটি বটগাছের নিচে ছিল একটি কালীমন্দির। কালীপূজার সময় দূর দূর থেকে লোকজন আসত। ব্রিটিশরা মন্দিরের আশপাশের প্রায় এক হাজার ২০০ একর জমিতে গড়ে তোলে চা বাগান। মন্দিরের কারণেই মুখে মুখে চা বাগানের নাম হয়ে যায় কালি টি এস্টেট।
চা শ্রমিকদের অধিকাংশই আদিবাসী। ব্রিটিশ আমল থেকে তারা কাজ করছে এখানে।
চা বাগানের ভেতরেই বাঁশলাইন, মাদ্রাজিলাইন আর বাংলা টিপাড়ায় চা শ্রমিকদের ডেরা। পাড়াগুলো ঘুরতে গেলে লোকজন আমাদের বসতে দেয়, আপন ভেবে কথা বলে।
কার্তিক মাসে কালীপূজায় নেমন্তন্ন করে। এরপর আমরা আবারও টিলা মাড়াই। একেক জায়গা থেকে চা বাগান দেখতে একেক রকম লাগে। সবুজ সৌন্দর্য আমাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
সন্ধ্যা হতেই চা বাগানে অন্ধকার নামে। চারদিকে শুরু হয় শিয়ালের ডাকাডাকি। দূর থেকে দু-একটিকে দেখলাম আবছায়াভাবে। ফিরতি পথ ধরি। হেডলাইটের আলো ফেলে পথ খুঁজে নেয় আমাদের গাড়ি। পেছনে পড়ে থাকে কালি টি এস্টেট।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, ১৪ জানুয়ারী ২০১৩

© 2013 – 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button