স্বকৃত নোমানের ‘হীরকডানা’
ঔপন্যাসিক স্বকৃত নোমানের নতুন উপন্যাস ‘হীরকডানা’ প্রকাশ করেছে বিদ্যাপ্রকাশ। বিষয়গত দিক থেকে উপন্যাসটি গুরুত্বপূর্ণ। আঠার শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় এক বিপ্লবীর অভ্যুদয় ঘটে। তাঁর নাম শমসের গাজী। ‘বাংলার বীর’, ‘ভাটির বাঘ’ তাঁর উপাধি। মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হয় হার্মাদরা। কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তরপুরুষ সৈয়দ গদা হোসেন তাঁর অন্তরে জ্বালিয়ে দিলেন জ্ঞানপ্রদীপ। জমিদারকন্যা দরিয়াবিবির সঙ্গে অসফল প্রেম তাঁর জীবনকে উন্নীত করে ভিন্ন মাত্রায়। কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজাবিদ্বেষী কর্মকা-ের বিরোধিতা করে রোষানলের শিকার হন ত্রিপুররাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। ভুখানাঙা চাষাভুষাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে। হীরকডানায় ভর করে যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ান তেজোদীপ্ত যবন বীর শমসের। শত্রুসেনা বিনাশ করতে করতে হয়ে ওঠেন অবিনাশী যোদ্ধা, অপ্রতিরোধ্য হন্তারক। অধিকার করে নেন রাজ-সিংহাসন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন টানা এক যুগ। তাঁর কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হওয়ার পর বেনিয়াদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তাঁর। শুরু হয় আরেক লড়াই। চম্পকনগর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলেও আবার পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। একদিকে তিনি অকুতোভয় বীর, প্রজাদরদি রাজা, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে মনকাড়া বাঁশিওয়ালা। গভীর রাতে বাঁশির সুর শুনে বেরিয়ে আসেন আত্মগোপন থেকে। অমীমাংসিত থেকে যায় তাঁর মৃত্যু। ইংরেজ ইতিহাস তাঁকে দস্যু-ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে, আর ভাটিবাংলার মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মহানায়ক হিসেবে অমর হয়ে থাকেন। জোসনারাতে হীরকডানায় ভর করে জিন হয়ে জিনের সঙ্গে, পাখি হয়ে পাখির সঙ্গে উড়ে বেড়ান। ইতিহাস, কিংবদন্তী ও কল্পনার নান্দনিক সম্মিলন ঘটেছে এই উপন্যাসে। বর্ণিত হয়েছে বিস্মৃত সময়ের আখ্যান, ঘটেছে লেখকের মেধার স্ফুরণ। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা সর্বোপরি সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ববাংলার অতীত সময়ের এক বিশ্বস্ত দলিল হীরকডানা।
লেখক পরিচিতি
স্বকৃত নোমান বাংলা ভাষার প্রতিশ্রুতিশীল ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম। জন্ম ১৯৮০ সালের ৮ নভেম্বর―ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায়। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে ইতোমধ্যে তিনি দৃষ্টিগ্রাহ্য মাত্রা সংযোজন করেছেন। সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব শিল্পধারা। জ্ঞান অন্বেষণ ও লেখালেখিকে জীবনের প্রধান কাজ বলে মনে করেন। স্বভাবে কিছুটা অন্তর্মুখী, আবেগপ্রবণ, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক। পৃথিবী একদিন সর্বমানবের সম্মিলিত সঙ্গীত-উৎসবে মুখর হবে―এই আশা বুকে লালন করেন সবসময়। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান পাঠে এবং লেখায়। তিনি প্রান্তবঙ্গের এক শক্তিশালী কথক। তাঁর উপন্যাসে একাঙ্গ হয়ে থাকে গ্রামবাংলার বিচিত্র মানুষ, প্রকৃতির বিপুল বৈভব, ইতিহাস, সমকাল, পুরাণ, বাস্তবতা ও কল্পনা। রাজনটী উপন্যাসের জন্য ২০১২ সালে এইচএসবিসিÑকালি ও কলম কথাসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে সংবাদ ম্যাগাজিন সাপ্তাহিক-এর সহসম্পাদক হিসেবে ঢাকায় কর্মরত। স্ত্রী নাসরিন আক্তার নাজমা ও কন্যা নিশাত আনজুম সাকিকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। হীরকডানা তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস।
© 2013 – 2018, https:.