বঙ্গবন্ধুর কথাডা কইলজায় লাগি গেছে
‘২৫ মার্চ ১৯৭১। মধ্যরাত। শুরু হয় অপারেশ সার্চ লাইট। ঢাকার রাস্তায় নামে পাকিস্তান সেনা। রক্তাক্ত হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল ও পিলখানা। এ খবর ছড়িয়ে পরে ঢাকার বাহিরেও। ২৬ মার্চ রাতে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে এক হত্যাযজ্ঞ চলে। ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে পাঞ্জাবি সেনারা। নিহত হয় শত শত বাঙালি সৈন্য। অনেকে ব্যারাক থেকে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচেন। গোলাগুলির শব্দে আশপাশের গ্রামের মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে জড় হয়। বাঙালি সৈন্যদের উদ্ধার করতে তারা ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করে।
খবর পেয়ে পার্বতীপুর থেকে ওইরাতে আমিও চলে যাই সেখানে। আহত অবস্থায় বের করে আনি মাহাবুব নামের একজনসহ কয়েকজনকে। পাঞ্জাবি সেনারা আমাকে লক্ষ্য করেও গুলি চালায়। কিন্তু গুলিটি আমার পেটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যাই আমি। আমরা আহতদের জড় করি খোলাহাটি ফকিরের বাজারে। মহসিন নামে সেখানে একজন ডাক্তার থাকতেন। তিনি আমার ও অনেকের শরীর থেকে গুলি বের করে আনেন। তাঁর চিকিৎসা না পেলে অনেককেই সেদিন বাঁচানো যেত না।’
‘তারপর আপনারা কি করলেন?’
‘ গুলি খেয়েই সিদ্ধান্ত নিই-দেশে থাকব না। ২৭ মার্চ দুপুরের পর প্রস্তুতি নেই। বসন্তি সীমান্ত হয়ে আমি চলে আসি ভারতের কাতলায়। আমার সঙ্গে ছিল বাঙালি আর্মি, মোজাহিদ ও ইপিআরের লোকেরা। দিনাজপুরের জর্জ ভাইয়ের মাধ্যমে আমি মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট হই। ছয়দিন চলে লেফ-রাইট। অতঃপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। পানিঘাটায় আমরা ট্রেনিং করি ৩১ দিন। ২৯ দিন ট্রেনিং, ১দিন পিকনিক ও ১ দিন ছিল নাটক। আমাদের উইয়ংয়ে দোভাষি কমান্ডার ছিলেন বুলবুল। আমার এফএফ নং ছিল ২৯০৩।
১২ রকমের বিস্ফোরক তৈরির ট্রেনিং দেওয়া হয় আমাকে। পতাকা ছিল আমাদের কাছে কোরআনের মতো। তাই এ ট্রেনিংয়ের শুরুতেই পাতাকা ছুয়ে শপথ করেছিলাম-জাতির প্রয়োজন ছাড়া ব্যক্তিগত কাজে এ ট্রেনিং ব্যবহার করব না।’
কথা ওঠে ১৯৭১ এর রনাঙ্গণ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘ ট্রেনিং শেষে আমরা হাতিয়ার পাই আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প থেকে। অতঃপর সম্মুখ যুদ্ধ করি এক মাস। প্রথম যুদ্ধ ফুলবাড়ির মাসুয়া পাড়ায়। সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালি ঘাটি। বসন্তির ছোট খাল পেরোলেই ক্যাম্পটি। ফজরের সময় খাল পেরিয়ে আমরা তাদের ক্যাম্পের পঞ্চাশ গজ সামনে চলে আসি।
অপারেশনের পূর্বেই আমাদের রেইকি করতে হতো। ইপিআরের এক হাবিলদার এ অপারেশনটির ভূল রেইকি করে। নিয়ম ছিল শক্রুর তিনশ গজ দূরে অবস্থান করার। কিন্তু আমরা তা না করায় বিপদের মধ্যে পড়ে যাই।
কয়েকটি গ্রুপে আমরা ছিলাম চল্লিশজন। কমান্ডার ছিলেন আফসার আলী। শুরু হয় যুদ্ধ। কয়েক মিনিট পর আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। শক্রুদের মর্টার আমাদের ওপর এসে পড়ছে। খুব কাছে চলে আসাতে আমরা সুবিধা করতে পরি না। নিজেদের এ ভুলের কারণে ওই অপারেশনে শহীদ হয় দুই সহযোদ্ধা। ইসমাইল ও আজিজুলের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে চোখের সামনে।।
ক্যাম্পে ফিরেই আমরা বন্দুক তাক করি রেইকি ম্যানের দিকে । কিন্তু দলের কমান্ডা আমাদের শান্ত করেন। ওইবার পিছু হটলেও কয়েকদিন পর আমরা আবার ওইক্যাম্পে আক্রমণ করি। উড়িয়ে দেই তিনশ পাকিস্তান সেনাদের ঘাটিটিকে।’
‘হিলিতে পাকিস্তান সেনাবহিনীর ঘাটিতে আক্রমণের সময়ও আমি ছিলাম। আমরা তিনটি স্কোয়াট। সঙ্গে ছিলেন প্রায় তিনশজন ভারতীয় ফৌজ। এসএস বার্ট ছিলেন কমান্ডে। রাতের অন্ধকারে আমরা পাকিস্তান আর্মিদের বান্কারে গরম ও বিষাক্ত পানির নল রেখে আসি। পানি ছাড়তেই বান্কার থেকে বেরিয়ে আসে সৈন্যরা। ওই সুযোগে আমরা তাদের গুলি করি। রক্তক্ষয়ী সে অপারেশনে বহু ভারতীয় সেন্য শহীদ হয়। এভাবেই বিভিন্ন অপারেশনে সরাসরি যুদ্ধ করছিলাম।
পরে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গেরিল বাহিনীতে। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে আত্মগোপনে থেকে আমরা আক্রমণ করে সরে পরতাম। ৫ নং সেক্টরের অধীনে আমি যুদ্ধ করি আমবাড়ি, ফুলবাড়ি, পলাশবাড়ি, হিলি, মোহনপুরসহ দিনাজপুরের অনেক জায়গায়।
পা হারালেন কোন অপারেশনে ? খানিক নিরব থেকে তিনি বলেন, ‘ জানুয়ারি ১৯৭২। দেশ তখন স্বাধীন। দিনাজপুর মহারাজা গিরিজাথ স্কুলে খোলা হয় একটি মিলিশিয়া ক্যাম্প। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার। তার সঙ্গে ছিলেন জর্জ আর এন দাশ (জর্জ ভাই)। সেখানে অস্ত্র জমা নেওয়া হতো। গ্রামে রাজাকারদের কিছু অস্ত্র উদ্ধার করি আমরা। ৫ জানুয়ারি সকালে সে অস্ত্র জমা দিতে আসি মহারাজা স্কুলে। সঙ্গে ছিলেন অনীল ও আক্কাস। অস্ত্র জমা দিয়ে ওইদিন ক্যাম্পেই থেকে যাই আমরা।
ক্যাম্পটির ভেতর লিস্টেট মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৭৫০জন। সেখানেই বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়েছিল এনটি ট্যান্ক মাইন,এন্টি পারসনাল মাইন, টুইন্চ মর্টার, থ্রি ইন্চ মর্টার প্রভৃতি। শুধু এনটি ট্যান্ক মাইনই ছিল সাড়ে বারশ।
৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার ঠিক আগে। আমরা যাব বাংলা সিনেমা দেখতে। তেমনটাই ছিল পরিকল্পনা। এ কারণে ক্যাম্প থেকে নিতে হতো টোকেন। আমরা টোকেনের আবেদন করে রুমে ফিরে আসি। হঠাৎ বাঁশির শব্দ। রিপোর্ট করেত হবে। আমরা দ্রুত মাঠের মধ্যে এসে সোজা হয়ে দাড়াই। একেকজন দাড়িয়ে এক, দুই, তিন বলে নিজের অবস্থান জানান দেয়। মাঠের মধ্যে আনলোড হচ্ছিল একটি ট্রাক। সেটি এসেছিল হিলি থেকে। ট্রাকতে ভর্তি ছিল বিভিন্ন ধরণের মাইন। হঠাৎ বিকট শব্দ। চাকাত চাকাত করে কয়েকটা আলোর ঝলকানি দেখি। এরপর আর কিছুই মনে নেই। আট দিন পর জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি মিশন হাসপাতালে। আমার ডান পা কাটা। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্প্রিন্টারের ক্ষত।
মহারাজা স্কুলের মিলিশিয়া ক্যাম্পে কীভাবে ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা আজও অজানা। বিস্ফোরণে স্কুল বিল্ডিংটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নিচ থেকে পানি উঠে ওই জায়গাটি পুকুরে পরিণত হয়। আশপাশের বাড়িগুলোতেও ফাটল দেখা দেয়। বিস্ফোরণের পর আমার রক্তাক্ত দেহটি ঝুলে ছিল গাছে। লোকজন সেখান থেকে নামিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেয় হাসপাতালে। সেখানে দেখতে আসেন কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারসহ অনেকেই। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকাতে।’
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথার পিঠে কথা চলছিল মুক্তিযোদ্ধা মো. তোজাম্মেল হকের সঙ্গে। রফিউদ্দিন ও তোরাফুন নেছার পুত্র তোজাম্মেলের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার সিংগিমারী কাজীপাড়া গ্রামে। বর্তমান বয়স পয়ষট্টি। তিনি পড়াশোনা করেছেন সিংগিমারী কাজীপাড়া হাই স্কুলে। পড়েছেন কাস এইট পর্যন্ত । ১৯৬৫ সালে তিনি পড়াশোনায় ইতি টানেন। অতঃপর পার্বতীপুরে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা।
মুক্তিযোদ্ধা তোজাম্মেল বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শোনেন রেডিওতে। তার ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শক্রুর মোকাবেলা কর। বঙ্গবন্ধুর কথাডা কইলজায় লাগি গেছে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা লাগে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নেন হায়ার ট্রেনিং। ইয়ুথ ক্যাম্পে ছিল ১ লাখের মতো। বাকীরা দেশের ভেতর কয়েকটি ছোট দলে যুদ্ধ করে। স্বাধীনের পর শুনি সব নাকি করেছে মুজিববাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো তাদের চোখে দেখিনি।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমরা কোনো পার্টির নই। সারাদেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি। তাই আমরা সবারই।’ তিনি বলেন, ‘ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে বিভক্ত হয়ে যায়। যা মোটেই ঠিক হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা আর কখনও জন্মাবে না। তাই রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা বানানোটাও মহাপাপ।’
বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে কথা বলেন তোজাম্মেল হক। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমাদের গ্রামে এক রাজাকার ছিল। সে ছিল খুবই গরীব। পেটের দায়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু সে কোনো হত্যার কাজে যুক্ত ছিল না। এমন লোককে তো ক্ষমা করা যেতেই পারে।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা উঠতেই তিনি অকপটে বলেন, ‘ স্বাধীনের পর অনেকেই টাকার বিনিময়ে ও আত্মীয়তার অজুহাতে রক্ষা করেছেন বহু রাজাকারকে। রাজাকারদের বিচার নিয়ে হয়েছে নানা রাজনীতি। অথচ বহুপূর্বে এদের তুলে দেওয়া উচিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের আদালতেই ওদের বিচার করা উচিত।’
মুক্তিযোদ্ধা তোজাম্মেল আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধে গিয়েছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে তো তাঁকেও বাঁচতে দিল না। উনি নেই তাই আমাদের স্বপ্নও শেষ।’ দেশের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ থাকলে তো দেশে কোনো শান্তি আসবে না।’
মুচকি হেসে তিনি আরো বলেন, ‘এখন যদি আরেকটি য্দ্ধু লাগে তাহলে কেউ হয়তো যুদ্ধেও যাবে না। কেননা সবাই দেখেছেন স্বাধীনের পর এদেশে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষাও করেছেন। অথচ রাজাকাররা হয়েছে সম্মানিত। ’
এতো হতাশার মাঝেও নতুনদের মাঝে আলো দেখতে পান মুক্তিযোদ্ধা তোজাম্মেল হক। তার ভাষায়, ‘ নতুরা সত্যিটাকে ঠিকই খুঁজে নিবে। সত্য পথে চলবে। তখন দেশ হবে উন্নত ও আলোকিত।’
ঘরে বসে বই কিনতে চাইলে : click here
© 2013 – 2021, https:.