ভাসতে ভাসতে লালাখালে
‘এখানটায় সারি নদীর নাম কেন লালাখাল হলো? প্রশ্ন শুনে মাঝি মুচকি হাসে। উত্তরে দূরের একটি গ্রাম দেখিয়ে ফিরে যায় বহু পূর্বে। ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী ঢুকেছে বাংলাদেশের ভিতরে। দূরের গ্রামটির নাম লালা গ্রাম। লালাগ্রামকে ভেঙ্গে নদীটি তার পথ তৈরি করেছে। আর এ কারণেই এখানটাকে সকলেই বলে লালাখাল।’
নদীর নাম সারি। তাই ঘাটের নাম হয়েছে সারিঘাট। সারিঘাট থেকে আমরা নৌকা ভাসাই। ভটভট শব্দে ইঞ্জিন ধোঁয়া তোলে । ঢেউ কেটে ছুটে চলে আমাদের নৌকা। ছাউয়ের ওপর বসা নৌকার মাঝি। নাম আবুল হোসেন। নৌকার হাল তার হাতে। দৃষ্টি সবসময় সামনে। চোখের পলক যেন পড়েই না। মাঝে-মধ্যে তামাক পুড়িয়ে দম নেয় সে। আমরা চলছি নদীর উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে।
সারি নদীর রূপ অপরুপ। জল একেবারেই সবুজাভ। খানিক যেতেই তা বদলে হয় নীলাভ। জলের স্পর্শেই হিম হয়ে যায় শরীর। পাহাড়ি নদী বলেই নাকি এমন। স্বচ্ছ জল দেহে ভরে নদী চলে এঁকেবেঁকে। সারি নদীর জলের রঙে আমরা ভাবনায় পড়ি। মনে পড়ে যায় সেন্টমার্টিনসের কথা। সেও তো নোনা জলের নীলাভ হাতছানি। কিন্তু মিঠাপানির নদীতে কেন সমুদ্রের রূপ? এরকম নানা প্রশ্ন ঘোরপাক খায় মনে।
নদীর দুই তীর একেবারেই চোখের সীমানায়। তীরের মানুষদের কান্ড আমাদের অবাক করে। কেউ ডুবোজলে গা ভাসিয়ে নিচ থেকে তুলে আনছে কালো মতো কিছু একটা। সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই আমাদের চোখ তো কপালে ওঠার দশা। ওমা! এত মাছ নয়, এ দেখি কয়লা। দলবেঁধে সে কয়লা ধুয়ে ময়লা ছাড়াচ্ছে আবালবৃদ্ধরা। সারি নদীতে ভেসে আসা কয়লায় জীবন বদলায় শত শত পরিবার। আবুল মাঝি বলে, স্যার কয়লা না, এ আমাদের কালো মানিক।
মানিক নিয়ে ভাবতে ভাবতে দৃষ্টি আটকায় আরেক জায়গায়। সেখানে চলছে অন্য কান্ড। কয়েকজন লোক ডুব দিয়ে তুলে আনছে ঠুকরিভর্তি পাথর। যেন নদীর জলে হাবুডুবু খেয়ে দূরদেশ থেকে ছুটে এসেছে এ পাথরগুলো। যেমন তার দেহ, তেমন তার বর্ণ। দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছে হয়।
কান্তহীন আমাদের চোখ দুটো নানা দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত। আমরা এগোই জিরো পয়েন্টের দিকে। নদীর বাঁক পেরোতেই বদলে যায় দৃশ্যগুলো। চারপাশে তখন উঁচু উঁচু সব পাহাড়। সবুজে ঢাকা তার দেহ। পাহাড়ের বুক চিড়ে ছুটে চলে নদীটি। নিটোল পায়ে যেন রিনিঝিনি শব্দে। একেক বাঁকে তার একেক রূপ খোলে। সে রূপে আমরাও মজে যাই।
মাঝি হাঁক দেয়, ‘জিরো পয়েন্ট’। তাই এগোতে মানা। আমরা আর ওমুখো হই না। নৌকায় বসে পা ডুবাই নদীর জলে। দূরের মেঘে ঢাকা পাহাড়গুলো আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। রূপবতী নদী আর বিশাল দেহী পাহাড়ের সৌন্দর্যে আমরা উদাস হই। মন তখন হারিয়ে যায় অন্য কোনোখানে। অন্য কোনো ভুবনে।
চার দিন হয় এসেছি সিলেট সফরে। জায়েদ, মুন্না, মনির আর আমি। সঙ্গে আমাদের পরিবার। সব মিলিয়ে ১২জন। সিলেটের পথ চিনিয়ে নিতে সিলটী বন্ধু সিব্বির আমাদের সঙ্গী হয়।
প্রথমদিন আমরা দিনভর কাটাই চা বাগানে। রাতে কান্ত শরীর নিয়ে ফিরি হোটেলে। শোয়ার প্রস্তুতি চলছিল, এমন সময় মুন্না এলান জারি করে – ‘অপারেশন লালাখাল’। নদীর রূপ আর পাহাড়ের ভালবাসা উপভোগ করার সুযোগ। অগত্যা সকাল সকাল উঠতে হবে।
গাড়ি ঠিক করাই ছিল। প্রস্তুত ছিল বন্ধু সিব্বিরও। সকাল ১০ টায় আমরা সিলেট থেকে জাফলংয়ের পথ ধরি। সে পথেই যেতে হয় লালাখালে। শহর থেকে বেরোতেই ড্রাইভার মামুন গান শোনান। তবে তা মুখে নয়, সিডিতে। ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভোলায় রে’। বন্যার গান। গানের সুরে সবাই চুপচাপ। আপন মনে চারপাশের দৃশ্য দেখছে সবাই। প্রকৃতি দেখার ফাঁকে মুন্না কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পাইনি। ঘন্টাখানেক পরেই গাড়ি ব্রেক কষে থেমে যায়। থামার ঝাঁকুনিতে ভড়কে যায় মুন্না। চোখ খুলেই প্রশ্ন ‘আমরা কোথায়’। মুন্নার কান্ড দেখে সবাই মুচকি হাসে।
জৈন্তাপুর উপজেলাতেই লালাখাল। সারিঘাটে নেমেই আমরা বেছে নিই শক্তপোক্ত একটি ইঞ্জিনচালিক নৌকা। অতঃপর যাত্রা হয় শুরু ।
যতই আমরা এগোই ততই নির্জনতা আমাদের ঘিরে ধরে। সারি নদীর স্বচ্ছ জলরাশির উপর দিয়ে ছুটে চলে আমাদের নৌকা। হঠাৎ পাশ দিয়ে ছুটে যায় একটি স্পীডবোট। তার ঢেউয়ের তোড়ে আমাদের নৌকা দোলে। আমরাও দুলি মনের আনন্দে।
তীরের দিকে ক্যামেরা তাক করে মনির ছবি তোলে। সেদিকে তাকিয়ে আমরা অবাক হই। তাকিয়ে দেখি অবাক কান্ড। অদ্ভুত সাজে নদী পাড়ের শক্ত মাটির স্তরগুলো। দূর থেকে তা ভাস্কর্যের মতো দেখায়। আমরা বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম চারপাশ। এরই মধ্যে মনির ছবি তুলতে মাচায় ওঠে। আমরাও তার পিছু নিই।
ঘন্টাখানিক যেতেই আমরা লালাখালে পৌঁছি। সবার চোখে-মুখে তখন আনন্দ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমরা তাকিয়ে থাকি নদীর পানির দিকে। কি সুন্দর নীল, একদম নিচে দেখা যায়। মৃদু বাতাসের মধ্যে নদীর নীল পানির মধ্য দিয়ে আমরা চলি দুলেদুলে।
একসময় মাঝি আবুলকে প্রশ্ন করি, এখানটায় সারি নদীর নাম কেন লালাখাল হলো? প্রশ্ন শুনে মাঝি মুচকি হাসে। উত্তরে দূরের একটি গ্রাম দেখিয়ে ফিরে যায় বহু পূর্বে। ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী ঢুকেছে বাংলাদেশের ভিতরে। দূরের গ্রামটির নাম লালা গ্রাম। লালাগ্রামকে ভেঙ্গে নদীটি তার পথ তৈরি করেছে। আর এ কারণেই এখানটাকে সকলেই বলে লালাখাল। আবুল মাঝির কথা আমরা তম্ময় হয়ে শুনি।
আমাদের নৌকা ভিড়ে লালা টি স্টেটের ঘাটে। সবাই তখন ঝাঁপিয়ে পরে তীরের বালির ওপর। অতঃপর শুরু হয় ছোটাছুটি। বালিমাখা শরীর নিয়ে আমরা টিলায় উঠি। উপর থেকে দৃষ্টি ফেলে চোখের ফ্রেমে বাঁধি লালাখালের গোটা সৌন্দর্যটি।
দুপুরের পরেই আমরা ফিরতি পথ ধরি। জিরোপয়েন্ট ঘাটে তখন অনেকগুলো নৌকা। লালাখালের সৌন্দর্যে তৃপ্ত আগতরা। নারী শিশুদের আনন্দ কন্ঠ তা জানান দেয়। লালাখাল, সত্যি অপরূপ। আজো মনে হলে ইচ্ছে হয় ছুটে যাই।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে, ১৯ এপ্রিল ২০১৩
© 2013 – 2019, https:.
লালখাল কী নীল… খুব সুন্দর!
লালাখালের পানি নীল। আসলেই সুন্দর।
নীল পানি। আপনি গিয়েছিলেন কখনও?