মায়াবী দীপচর আর সাদা পাহাড়ের কথা
নদীরবুকে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা। সোনালী – লাল বালুময় পথ। পা রাখতেই দেবে যায়গোড়ালি অবধি। এক পাশে তিরতির করে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী।নদীতে স্রোত নেই তেমন। বর্ষায় ওর রূপ খোলে। তখন সোমেশ্বরী হয়স্বাস্থ্যবতী। চরের ভেতর সাদাফুলের কাশবাগান। লম্বা লম্বা কাশফুলগুলোবাতাসে দুলছে। নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে নদীর পানিতে। দূর থেকে মনে হয় শিল্পীরতুলির আচড়ে আঁকা একটি ছবি। ছবির মতো চর। চরের ওপাশে অন্য দৃশ্য। সবুজেঘেরা উঁচু উঁচু সব পাহাড়। যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো।কয়েকটি আবার পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে সামনের দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। দেখতেবেশ লাগে।
সবচেয়ে বড় পাহাড়ের চূড়াটি একেবারে মেঘে ঢাকা। দূর থেকে মনেহয় একটি পাহাড়ের ছায়া যেন পড়েছে অন্যটিতে। আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল।মাঝে মাঝে তুলোর মতো সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। বালুচরের কাশফুলের বাগানেবসে এমন দৃশ্য দেখতে কার না ভালোলাগে?সামনেই দুর্গাপূজার ছুটি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বন্ধু সুমন জানালোআটাশজনের একটি দল যাবে সুসং দুর্গাপুরে। বিরিশিরিসহ ঘুরবে বেশ কিছুজায়গায়। দুর্গাপূজায় দুর্গাপুরে। একবাক্যেই রাজি হয়ে গেলাম। সকাল ৭টায়মহাখালি বাস স্ট্যান্ডে থাকার এলান জারি হয়। দুর্গাপুরের উদ্দেশে বাসছাড়ে ৭.৩০-য়।
মাত্রপাঁচ ঘন্টা লাগল নেত্রকোনার শুকনাকুড়ি যেতে। যানগুলি বুঝিছুটি কাটাতে গিয়েছে তাইজট পাইনি কোথাও। তবে রাস্তার সে কী অবস্থা! মনেহলেই কান্না পায়। শুকনাকুড়ি থেকেপৌনে এক ঘন্টা লাগল বিরিশিরিরওয়াইএমসি-র রেস্ট হাউজে পৌঁছতে।
পেটেরতখন ত্রাহি অবস্থা। সাফসুতরো হয়ে খাবার ঘরে ঢুকলাম।ভাজি,ডাল আর দেশি মুরগির গোশত – অমৃতঠেকল। খেয়ে উঠে খানিক বিশ্রাম নিয়েনেই।ট্যুর ম্যানেজার করা হয়েছে রবিকে। ব্যস্ততায় বেচারা ত্রস্ত। গলাটাবেশ ভারি করে বলল,ঠিক চারটায় রওনা দিব। কেউ লেট করলে পশতাতে হবে। বন্ধুসুমনও বেশ ব্যস্ত। ছবি তোলার কাজ নিয়েছে সে। ভাইয়া আমার একটা বলতেই আররেহাই নেই – একটু ডানে সরো, ঘাড় সোজা করো, মুখটাকে পাঁচের মতো করে রেখো নাইত্যাদি বলছে আর ক্লিক করছে।
ইঞ্জিনচালিতবড় একটি নৌকা ঠিক করাই ছিল। বিরিশিরি ঘাট থেকে ভেসে যাই সোমেশ্বরীর বুকে।
সবাই যেন শরতের রূপে বিভোর। ছবি তোলায় ব্যস্ত কেউ কেউ। সুমন বসেছেনৌকার ঠিক সামনের অংশে। সোমেশ্বরীর প্রেম কাহিনি শোনাচ্ছে মেয়ে বন্ধুদের –প্রেম না পেয়ে সোমেশ্বরী কেঁদেছিল অঝোরে। সেই কান্না নাকি এই নদী হয়েপ্রবাহিত হচ্ছে! আমি ভাবি, আজকালকার মেয়েদেরএসব শুনিয়ে কাত করা যায়? নৌকা এগোতে থাকে। পথ দেখাচ্ছে গোপাল, মঞ্চ নাটকে নিবেদিতপ্রাণ।
কেউ কেউ পা ঝুলিয়ে বসে সোমেশ্বরীর জলের স্পর্শ নিচ্ছে। কেউবা আবার তা দেখে মুখ টিপে হাসছেও।
আমাদের নৌকা সামনে এগোতে থাকে। গাইড গোপাল জানালো এই নদী পথেইযাওয়া যায় বিজয়পুরের জিরো পয়েন্টে। যাওয়ার পথে দেখা মেলে মেঘালয়েরবড় বড় পাহাড়গুলোর। অন্যরকম সে দৃশ্য।
গোপালেরকথাই ঠিক, মিনিট বিশেক চলতেইমেঘালয়ের পাহাড়গুলো আমাদেরদৃষ্টির সীমানায় চলে আসে। মন ছুঁয়ে যায় সে দৃশ্য। সবারমধ্যেই অন্যরকমউত্তেজনা। এমনকী গম্ভীর রবিও চেঁচিয়ে ওঠে।
ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক শব্দ। অন্য দু‘একটা নৌকা ভর্তি লোকজন নিয়েখেয়া পার হচ্ছে। এদেরই একটিকে পাশ দিয়ে আমাদের নৌকা সামনে এগোয়।
নদীর জল একেবারে কাচের মতো ঝকঝকে। পাহাড়ি নদীগুলোর জল নাকি এমনটাই হয়।নীল আকাশের ছায়া পড়েছে সে জলে। নদীর জলে আকাশ দেখতে অন্যরকম লাগে। হঠাৎকার যেন কন্ঠ বেজে ওঠে। তাকিয়ে দেখি সেজতি গান ধরেছে – এই নদীতে সাঁতারকাইট্টা বড় হইছি আমি, এই নদীতে আমার মায়ে কলসিতে নিত পানি…। গানের সুরেআমাদের মন হারিয়ে যায় অন্য কোনোখানে।
দূর থেকেই একটি চরের দিকে আমাদের দৃষ্টি পড়ে। গোপাল জানায় এটি দীপচর।বর্ষায় এ চরের দেখা মেলাই ভার। অজস্র সাদা কাশফুল ফুটে আছে চরটিতে। দূরথেকেই বেশ দেখা যাচ্ছিল ফুলগুলোকে। চরের ওপাশে মেঘালয়ের পাহাড়গুলি বেশদেখাচ্ছে। সবমিলিয়ে ছবির মতো।
এমন সুন্দর চর এর আগে কখনও দেখি নি। এই চরে পা না রাখলে কি হয়? সবার আগ্রহে মাঝি নৌকা ভেড়ান দীপচরের ঘাটে।
দীপচরে পা রাখতেই হারিয়ে যায় বৃষ্টি আর শারমিন। সবাই ছুটোছুটি করছে চরেরবালিতে। ছেলেরা ফুটবল খেলছে। মেয়েরা ঘুরে ঘুরে দেখছে চরের কাশফুলগুলোকে।
কে কোথায় খোঁজ নেই। মিনিট ত্রিশেক পরেই স্মরণে আসে বৃষ্টি আর শারমিনেরকথা। রবি, দীপ,তানিয়া আর সুমনসহ আমরা দীপচরের কাশফুলের বাগানে খুঁজে ফিরিতাদের।
শেষে দেখি তারা বসে আছে একেবারে শেষ প্রান্তে। চরের এ পাশটাতে পাহাড়গুলোখুব পরিষ্কার। দুই বান্ধবী এককোণে বসে পাহাড় দেখার আনন্দে মজে আছে।চুটিয়ে গল্প করছে বৃষ্টি আর শারমিন। হাতে কয়েকটি কাশফুল। কথার ফাঁকেফাঁকে কাশফুলের সাদা পাঁপড়িগুলোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে তারা ফুঁ দিয়ে উড়িয়েদিচ্ছে নীল আকাশের দিকে। তাদের হাসিতে চারপাশের নীরবতা কাটে। তা দেখেআমাদেরও লোভ হয়। আমরাও কাশফুলের পাঁপড়ি উড়িয়ে পাহাড় দেখি বৃষ্টিদেরসাথে।
সূর্যটা ডুবুডুবু। নদীর ওপাশের গ্রামের পেছনে অস্ত যাচ্ছে। লালচে কমলা রঙেরআলো ছড়িয়ে আছে আকাশময়। অস্তমিত সূর্যের ছায়া এসে পড়ছে সোমেশ্বরী নদীরপানিতে। সবাই এসে জড়ো হই চরের একপাশে,নদীর ধারে। দীপচরে বসে দেখিসূর্যডোবার অপরূপ দৃশ্য।
চারপাশে অন্ধকার কাটিয়ে মুখ তুলে তাকায় আশ্বিনের চাঁদ। চাঁদের ঐশ্বর্যময়আলোতে দীপচরের রূপ যায় পাল্টে। চাঁদের আলোতে নিজেদের মুখ দেখা। আরদীপচরের বালিপথে ছুটোছুটি চলে খানিকক্ষণ। চরের মধ্যে লুটোপুটি খেয়ে বালিছড়াতে ছড়াতে সবাই নেমে পড়ি নদীর জলে। চাঁদের আলোতে সোমেশ্বরীর জলেসাঁতার কাটতে বেশ লাগে। মনে পড়ে যায় ছেলে বেলার দুরন্তপনার কথা।সোমেশ্বরীর জলের উষ্ণ পরশে প্রাণ জুড়িয়ে যায় আমাদের। নদীর জলে শরীরভাসিয়ে আমরা দেখি মায়াবি চাঁদটাকে।
সাঁতার কেটে সবাই ক্লান্ত। শরীরটাকে হেলিয়ে দেই নৌকায়। তাকিয়ে থাকি আকাশপানে। তারায় ভরা আকাশ। চাঁদটা যেন তাকিয়ে দেখছে সবাইকে। মাঝি লগি মেরেনৌকা ভাসায়। আমরাও বিদায় জানাই দীপচরটিকে। নৌকায় বসে মিষ্টি কন্ঠে এবারসামিয়া গান ধরে – আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…। গানের সুরে দোল খায়আমাদের অনুভূতিগুলো। ক্রমেই দীপচর দূরে সরে যায়। সবাই তাকিয়ে থাকি চরের দিকে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোতে দূর থেকে অপরূপ দেখায় দীপচরকে।
রাতের খাবার সেরে সবাই যে যার কামরায়। বাইরে বসে আড্ডা জমায় মনির,তানিয়া আর সুমন। রবি এলান জারি করে,সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। এত সকালে কেন? মুচকি হেসে রবি উত্তরে বলে,কাল যাব সাদা পাহাড়ের দেশে।
সুমন সেখানে গিয়েছিল বার কয়েক। তাই সে আলাপ জমায়।
পাহাড়গুলো অন্যরকম। সবুজের মাঝে সাদা পাহাড়গুলোকে রূপসী রমণীর মতো দেখায়। লাবন্যময়ী এ পাহাড়ের গায়ের রঙ ফর্সা। স্পর্শ করলেই হাতে পড়ে পাউডারের মতো সাদা প্রলেপ।
তানিয়ার প্রশ্ন, তারপর?
একটি পাহাড় আরেকটি পাহাড়ের সঙ্গে লাগানো। দুইপাহাড়ের মাঝে মাঝেই জমে বৃষ্টির পানি। সে পানির রঙ! সে তো অপরূপ। একেবারেনীলাভ সবুজ। স্বপ্নের মতো দেখায় সাদা পাহাড়গুলোকে।
সত্যি ? তানিয়ার কথায় সুমন উত্তর দেয় না। বলতে থাকে।
পাহাড়ের ওপরের দিকে যতই উঠি,ততই সবুজ সম্রাজ্য চোখের সামনে ধরা দেয়।একদিকে দূর মেঘালয়ের উঁচু উঁচু সব পাহাড়। অন্যদিকে ছোট্ট ছোট্ট পাড়া।সবুজ ধানক্ষেতে দলবেঁধে নামছে সাদা বক। পাশেই বাঁশের ঘের দেওয়া একটি মাটিরবাড়ি। বাড়ির ভেতরে অনেকগুলো কলাগাছ। হাওয়ায় দুলছে কলাপাতাগুলো। একযুবক গাছের ছায়ায় বসে কী যেন ভাবছে। পাশেই চড়ে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগলগুলো।সাদা পাহাড়ের উপর থেকে সবকিছু দেখতে ছবির মতো লাগে।
সব শুনে তানিয়ার ঘুম যেন ছুটে যায়।
সকাল ৭ টা। দুর্গাপুর উপজেলাকে পেছনে ফেলতেই রাস্তা শেষ। এবার সোমেশ্বরীপেরোতে হবে। আহা! দিনের আলোতে পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীকে দেখা। শিবগঞ্জগুদারা পাড় হই আমরা।
কামারখালির পথ পেরোতেই হাজং মাতা রাশিমনির স্মৃতিসৌধ। এর পাশ দিয়ে কাঁচারাস্তাটি চলে গেছে কুলস্নাগড়া ইউনিয়নের দিকে। এখানেই রয়েছে চিনামাটিরসাদা পাহাড়গুলো। সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটি মেঠো পথ। সেপথেই ধুলো উড়িয়ে আমরা চলে আসি একেবারে শেষ প্রান্তে।
গ্রামের নাম কেন বগাউড়া ? তা জানা নেই স্থানীয়দের। একটি হাজং পাড়ার সামনে এসে থেমে যাই আমরা।
সবাই হাঁটছি। আমাদের ভেতর চিনামাটির পাহাড় দেখার তেষ্টা। হঠাৎ চোখের সামনেএসে দাঁড়ায় উঁচু একটি পাহাড়। এপাশ থেকে ওপাশকে ঠাহর করা কঠিন। আমাদেরদিকে সুমনের চোখ পড়তেই বুঝে ফেলি চলে এসেছি সাদা পাহাড়ের দেশে।
আমরা পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকি ওপরের দিকটায়। পাহাড়ের গায়ে জমানো পানিচমৎকার দেখায়। সুমনের কথাই ঠিক,ওপরে উঠতেই মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আমাদেরদৃষ্টির সীমানায় চলে আসে। মন ছুঁয়ে যায় সে দৃশ্য।
চিনামাটি, পানি ও প্রকৃতির নয়াভিরাম দৃশ্যে বিমোহিত হই আমরা। পাহাড়েরমাটিগুলো নানা রঙের। সাদা, গোলাপী, হলুদ, বেগুনি, খয়েরী, নীলাভ। যেন চোখজুড়িয়ে যায়।
লোকজনের শব্দে পাহাড়ের একপাশে আমাদের দৃষ্টি পড়ে। একদল শ্রমিক অবিরতকাটছে পাহাড়ের মাটিগুলো। দেখেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। চিনামাটির এইখনিগুলোকে কি না কাটলেই নয়?
গোপাল জানালো কিছু তথ্য। ১৯৫৭ সাল থেকে নাকি এই মাটি উত্তোলনের কাজ চলছে।সর্বপ্রথম কোহিনুর এলুমিনিয়াম ওয়ার্কাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই সাদামাটিউত্তোলনের কাজ শুরু করে। সরকারের অনুমতিতে বর্তমানে ৯টি কোম্পানী প্রায়৩০০ জন শ্রমিক দিয়ে প্রতিদিন এই মাটি উত্তোলনের কাজ করাচ্ছে। গোপালেরকথায় আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এভাবে কাটতে থাকলে একসময় এদেশে কি কোন পাহাড়মিলবে?
মনের আগুনে ঢালি পানি। সাদা পাহাড়ের উপরে বসে সবাই মিলে মেঘালয়ের পাহাড়দেখি। ইস্ , যদি ঐ পাহাড়টায় যেতে পারতাম। নানা ইচ্ছা আমাদের মনে বাসাবাধে।
এবার ফিরতে হবে। সাদা পাহাড়টিকে বিদায় জানাই আমরা। মনে মনে রবিকে খানিকটাধন্যবাদ জানাই। আজ না আসলে হয়তো এই পাহাড়টিকে কখনই দেখতে পেতাম না।ওইদিন বিকেলেই আমরা ফিরতি পথ ধরি।
এখনও আনমনে ভাবি দীপচর আর সাদা পাহাড়ের কথা। সোমেশ্বরীর জলের স্পর্শ আজওআমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, হাতছানি দিয়ে ডাকে মেঘালয়ের ছবির মতোপাহাড়গুলো।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ই-ম্যাগাজিন ‘আমাদের ছুটি’ , ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যা – বৈশাখ ১৪২০
© 2013 – 2019, https:.