আদিবাসী জীবনপ্রবাহ
বাঙালি ছাড়াও এদেশে বসবাস করছে কমপক্ষে ৭৩টি জাতির মানুষ, যারা আদিবাসী নামে পরিচিত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট, উত্তর-পশ্চিমে বৃহত্তর রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়া-পাবনা এবং উপকূলীয় এলাকায় বেশিরভাগ আদিবাসীর অবস্থান। এই আদিবাসী জাতিগুলোর প্রত্যেকে নিজস্ব ধারার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন করে গড়ে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় জীবন প্রণালী। আর এ কারণেই বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির মানুষের দেশ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বেশ অগ্রগামী হলেও সমতলের আদিবাসীরা অনেকটাই পিছিয়ে। এখানকার অনেক আদিবাসীই দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে নিজেদের স্বকীয়তাকে। আবার অনেক জাতি হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে। আদিবাসী গ্রাম ঘুরে তেমনই কয়েকটি জাতির কথা তুলে ধরছি আজ।
কড়া :
‘কড়া’ মানে মাটি খোঁড়া। এক সময় এ আদিবাসীরা দিঘি খোঁড়ার কাজে যুক্ত ছিল। ইংরেজ আমলে এ অঞ্চলে রেললাইন বসানোর কাজের সূত্র ধরেই ঝাড়খন্ড থেকে এদের আগমন। এদেশে কড়াদের একমাত্র গ্রামের প্রধান জগেন কড়া জানান এমন তথ্য। এ আদিবাসী গ্রামটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজায়। এখানে বাস করে কড়াদের ১৬টি পরিবার। এছাড়া বৈরাগীপাড়ায় একটি এবং সদর উপজেলার ঘুঘুডাংগার খাড়িপাড়ায় রয়েছে আরো দুটি পরিবার। মোট ১৯ পরিবারে এদেশে কড়াদের মোট সংখ্যা মাত্র ৮৫জন।
এক সময় দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কড়াদের একাধিক গ্রাম ছিল। কালক্রমে স্থানীয়দের সঙ্গে ভূমি বিরোধ ও দারিদ্র্যের কারণে এ আদিবাসীরা পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ভারতের ঝাড়খন্ড স্টেটের দুমকা, গোড্ডা,পাকুর, শাহীবগঞ্জ, হাজারিবাগ প্রভৃতি অঞ্চলে এখনো কড়াদের একাধিক গ্রাম রয়েছে।
এদের গ্রাম পরিষপদে গ্রামপ্রধান বা মাহতো ছাড়াও রয়েছে গোড়াৎ ও পারামানি নামের দুটি পদ। আগে কড়াদের কয়েকটি গ্রামের একজন প্রধান থাকত। তাকে বলা হতো ‘পাঁড়ে’। পদগুলো নির্বাচনের ক্ষেত্রে কড়াদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য তৈরি হয় না।
কড়াদের ধর্ম সনাতন হলেও এদের পূজাতে মূর্তির ব্যবহার নেই। অভাব মুক্তির জন্য এরা কারমা, দেবতাকে নানা কষ্টের কথা শোনাতে বিষহরি এবং গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্য এরা ‘গট পূজা’ পালন করে থাকে।
অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে নিষিদ্ধ হলেও লোকস্বল্পতার কারণে কড়া আদিবাসীরা বর্তমানে অন্য সম্প্রদায়েও বিবাহ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের বিবাহ-কেন্দ্রিক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও বিশ্বাসগুলো।
কড়ারা কথা বলে খট্টা ভাষায়। তবে বর্তমানে কড়া শিশুরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে বাংলা ভাষায় । এনজিও-নির্ভর শিশু শিক্ষা কেন্দ্রই এদের একমাত্র ভরসা। কড়া গ্রামে কোনো শিশুই এসএসসি উত্তীর্ণ হয়নি। এ আদিবাসীদের প্রধান পেশা কৃষি। ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক এ তিন মাস এদের অভাবের সময়। এ সময় মহাজনদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রি করে এরা পরিবার চালায়। বর্তমানে স্থানীয় একটি এনজিও কড়াদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য কাজ করছে। অভাব-অনটন আর অবহেলাকে জয় করে টিকে থাকার নিত্য সংগ্রাম করছে এ আদিবাসীরা।
গোড়াৎ :
রাজশাহীর দলদলিয়া, শেরেপাড়া, মারাইল প্রভৃতি এলাকায় গোড়াৎ আদিবাসীদের বাস। এ অঞ্চলে এদের আগমন ঘটে ব্রিটিশ আমলে। এরা এসেছে ভারতের নাগপুর চুটিয়াপাড়া থেকে। গোড়াৎরা নারীদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ‘রানী’ ও পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘সরদার’ শব্দটি ব্যবহার করে। তবে অবিবাহিত নারীদের নামের শেষে এরা ‘বালা’ শব্দটি যুক্ত করে। গোড়াৎদের একটি গ্রামে একজন ‘মোড়ল’ এবং পাঁচটি গ্রামের জন্য একজন ‘পরধান’ থাকে। এছাড়া এদের গ্রাম পরিষদে রয়েছে চকিদার ও মোহরী পদ। এদের ভাষায়, ‘পরধান উপমাকরী, মোড়ল বিচারকারী, মোহরী উপমা কি বিচার তরজমাকারী আর চকিদার হাকাকারী।’
গোড়ৎ আদিবাসীরা কথা বলে নাগরী ভাষায়। এ ভাষা পুরোপুরি মৌখিক। নিজ ভাষার বর্ণ না থাকায় এরা হারিয়ে ফেলছে নিজের মায়ের ভাষাটিকে। স্বতন্ত্র আদিবাসী রীতিতে গোড়াৎরা পালন করে দোসরাপূজা, করমপূজা ও লক্ষ্মীপূজার আনুষ্ঠানিকতা। পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই এরা কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত। এক সময় এদের নিজেদের জমি ছিল। এখন অধিকাংশ ভূমিহীন। অন্যের জমিতে কাজ করা ও ভ্যান চালানোর কাজে যুক্ত রয়েছে এ আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা। গোড়ৎদের বিয়েতে কনেকে সিঁদুর, খাড়– ও শাঁখা পরাতে হয়। পণ হিসেবে দিতে হয় ২৫ টাকা। বিয়ের আগে এরা পানিকাটা পর্ব সম্পন্ন করে। এর মাধ্যমে গোড়াৎরা জেনে নেয় বর-কনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কটা। যে কোনো উৎসবে হাড়িয়াই তাদের প্রিয় পানীয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বার বার দাবি তুললেও গোড়াৎ আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি সরকারের আদিবাসী (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) তালিকায়।
মালো :
জমিদাররা একসময় মালোদের দিয়ে ঘোড়া,মহিষ ও গবাদি পশুর ঘাস কাটার কাজ করাত। সে কারণে মালোদের ঘাসি বলেও ডাকা হতো। মালোদের গানেও মেলে এর সত্যতা – ‘রাঁচি থেকে এলো ঘাসি, তারপর হলো আদিবাসী।’ জমিদারদের লাঠিয়াল ও বরকন্দাজ হিসেবেও এরা কাজ করত। ঘোড়াঘাটের শীতল গ্রামের ভরত মালোর ভাষ্যে মেলে এমন তথ্য। স্থানীয়দের কাছে এরা বুনো বা বুনা নামেও পরিচিত। দিনাজপুর, রংপুর, মৌলভীবাজার ও জয়পুরহাট জেলায় মালো আদিবাসীদের বাস। এরা এসেছে ভারতে রাঁচি থেকে। বিহারের মালভূমি ও মালই টিলার অধিবাসীদের জীবন-যাত্রার সঙ্গে মিল আছে বলেই এদের মালো নামে ডাকা হয়। এদের রয়েছে ১৩টি গোত্র। মালো সমাজে একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। মাঝি হারাম, পারমানিক ও গুরুদিক – মালোদের গ্রাম পরিষদের তিনটি পদ। মাছ ধরা এদের জাতিগত পেশা। তবে বর্তমানে মালোরা কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে জীবনযাপন করছে। এদের বিয়েতে সাজনা সাজা, লগন, কৈইলনী, মারোয়া ও বিহা পর্ব সম্পন্ন করতে হয়। একসময় মালোদের বিয়েতে কনেকে পণ দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিয়েতে বরকে সাধ্যমতো যৌতুক দিতে হয়। আগে মালোদের নিজস্ব জমি ছিল। অভাবের সময়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে কড়া সুদে এরা টিপসই দিয়ে কর্জ নিত। সে সুযোগে মহাজনরা ধীরে ধীরে দখল করে নেয় তাদের জমিগুলো। এ অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহ ও মুক্তিযুদ্ধে মালোরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। মূলত ধর্মান্তরিত হওয়ার পর এদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। তবে এখনো অনেক মালো পরিবারই ধরে রেখেছে পূর্বপুরুষদের আদি সংস্কৃতি ও আচারগুলোকে।
লোহার :
লোহার শব্দটি এসেছে লো-হর শব্দ থেকে। ধারণা করা হয় শব্দটি কোল ভাষাগোষ্ঠী থেকে আগত। ‘লো’ অর্থ আগুন জ্বালানো আর ‘হর’ শব্দের অর্থ মানুষ। যে মানুষেরা সবসময় আগুন জ্বালিয়ে কাজ করে তারাই লোহার। এ আদিবাসীরা লোহা গলিয়ে বা পিটিয়ে কৃষির যন্ত্রপাতি ও সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করে। এরা বিশ্বামিত্রকে নিজেদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করে। তাই পেশাগত দেবতা হিসেবে এরা বিশ্বমিত্রকে পূজা করে। এরা এসেছে ভারতের বিহার ও সাঁওতাল পরগণা থেকে। নওগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুরে এ আদিবাসীদের বাস।
লোহারদেরও তিন সদস্যের গ্রামপরিষদ গঠিত হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। গোত্রপ্রধানকে এরা বলে ‘সিকদার’, সিকদারের সাহায্যকারীকে ‘ওহেদার’ ও গোত্রের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্ব থাকে ‘ছেড়িদারের’। এরা কথা বলে সাদরী ভাষায়।
বিশ্বকরমা পূজা লোহারদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এছাড়াও এরা মনসাপূজা, চড়কপূজা, জিতিয়াপূজা, কার্তিকপূজা, নয়াখালীপূজা, বাঁধনা উৎসব পালন করে থাকে। এদের বিয়েতে এক সময় পণপ্রথা চালু ছিল। বর্তমানে এরা যৌতুক প্রথায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরা অধিকাংশই আজ দরিদ্র ও ভূমিহীন। ফসল কাটতে আধুনিক মেশিন প্রযুক্তির ব্যবহার আর লোহার চড়া দামের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে এদেশের লোহাররা। বর্তমানে এরা নিজেদেরকে যুক্ত করছে কৃষিসহ অন্যান্য পেশায়।
পাহাড়ি :
পাহাড়ি আদিবাসীদের আদি নাম ছিল ‘তিরিংদাত’।’ এরা এসেছে ভারতের মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও মালদহো থেকে। জঙ্গল পরিষ্কার ও রেললাইনের কাজের সূত্র ধরে এ অঞ্চলে এদের আগমন ঘটে। পাহাড় থেকে এসেছে বলে তখনকার জমিদাররা তাদের নাম দেয় ‘পাহাড়ি’। নিজ জাতির নামকরণের এমন তথ্য জানান, রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার গোলাই গ্রামের পাহাড়ি রনজিৎ কুমার সরদার। সরকারি হিসেবে এদেশে পাহাড়িদের সংখ্যা ছয় হাজারের মতো। রাজশাহীর জামদাহ, কানাপাড়া, খৈড়াকান্দি ছাড়াও পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর ও গাইবান্ধা প্রভৃতি জেলায় রয়েছে পাহাড়িদের আরো গ্রাম।
নামের শেষে টাইটেল দিয়েই পাহাড়িদের গোত্রকে বোঝানো হয়। এক সময় এদের গোত্র ছিল চারটি। সাওরিয়া, চেটে, কুমড়ে ও মাল। কিন্তু বর্তমানে এরা টাইটেল হিসেবে শুধুই ‘সরদার’ ও ‘সিং’ শব্দ দুটিই ব্যবহার করে। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ।
একটি গ্রামপরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় পাহাড়িদের গ্রামগুলো। এক সময় এ পরিষদে একাধিক পদ থাকলেও বর্তমানে গ্রামগুলোতে রয়েছে গ্রাম প্রধান বা মোড়ল ও সাকিদার পদ।
পাহাড়িরা মূলত মালো ভাষায় কথা বলে। এ ভাষাটি দ্রাবিড় গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত। তবে বর্তমানে বয়স্করা তাদের আদি ভাষায় কথা বললেও যুবক বয়সী প্রায় সবাই অভ্যস্ত বাংলা ভাষায়। পাহাড়িদের ধর্ম সনাতন। কিন্তু এক সময় এরা ছিল প্রকৃতি পূজারী। এখনও ভুট্টা এবং আমের সময়টাতে পাহাড়িরা পূজা দিয়ে ফলন তোলে। পাহাড়িদের অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় হারিয়ে ফেলছে তাদের ধর্মকেন্দ্রিক আদি আচারগুলো।
এরা মূলত কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। চৈত্র – বৈশাখ আর আশ্বিন- কার্তিক এদের অভাবের সময়। আগে এ সময়টাতে এরা আগাম শ্রম বিক্রি ছাড়াও মহাজনদের কাছ থেকে কড়া শর্তে চাল ধার নিত। কিন্তু বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলের পাহাড়িরা নিজ নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছে মুষ্টি চালের সমিতি। তাদের ভাষায় ‘রক্ষা গোলা’। ফলে এখন পাহাড়িদের আর মহাজনের সুদ-চক্রে আটকে থাকতে হয় না। এভাবে নিজ জাতিটাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে পাহাড়ি আদিবাসীরা।
ডালু :
ডালু আদিবাসীরা মিশে যাচ্ছে অন্য জাতির মাঝে। অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে গারো, হাজং আর সনাতন হিন্দু সংস্কৃতিতে। ফলে এখন আর তাদেরকে আলাদাভাবে চেনা যায় না। হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া গ্রামের শুকনা ডালু এভাবেই তুলে ধরেন নিজের জাতিগোষ্ঠীকে। ডালুরা ইন্দো- মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর একটি শাখা। কিন্তু তাদের ভাষ্য তারা মহাভারতে বর্ণিত অর্জুনের পুত্র ব্রক্ষƒবাহনের বংশধর। এদেশে ডালুদের সংখ্যা মাত্র ৮শর মতো। হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া, সংড়া, মনিকুড়া এবং শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলায় এদের বাস। তবে ভারতের আসাম রাজ্যের নওগাঁ, দরং, গোয়ালবাড়ি এবং মেঘালায় রাজ্যের ফুলবাড়ী, গারোবাদা, তুরা প্রভৃতি জেলায় বিপুল সংখ্যক ডালু আদিবাসী রয়েছে।
ডালুরা বর্তমানে বাংলাভাষায় কথা বললেও মনিপুরি হচ্ছে এদের আসল ভাষা। এদের প্রাধন গোত্র তিনটি- চিকাং, পিড়া এবং মাশী। এছাড়া এদের আরো সাতটি উপগোত্র রয়েছে। ডালু সমাজে সন্তানরা মায়ের গোত্রনাম লাভ করে। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। এক সময় ডালুদের একেকটি গ্রাম পরিচালিত হতো একেকজন মোড়ল বা সরকারের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা তার পরিবর্তে গাঁওবুড়ার পদ প্রবর্তন করে। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় ডালু সমাজে আজ সে নেতৃত্বও লুপ্ত হয়েছে ।
গারো ও হাজংদের মতো ডালু আদিবাসীরাও কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ডালু পরিবার অন্যের জমিতে কাজ করাসহ কুটির শিল্প, ছুতোর মিস্ত্রি, হাতের কাজ, কর্মকার প্রভৃতি পেশায় যুক্ত রয়েছে।
ডালুরা বর্তমানে হিন্দু সনাতন ধর্মের পুরোপুরি অনুসারী। তবে বাস্তুদেবতা এদের আদি উপাস্য দেবতা। অগ্রহায়ণ মাসে এখনো এরা ধুমধামের সঙ্গে গ্রামের বাস্তুপূজা করে থাকে। মূলধারার সনাতন হিন্দুরা যেভাবে পূজাঅর্চনা করে, ডালুরাও সেভাবেই তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কিন্তু তবুও সনাতনপন্থী বর্ণহিন্দুরা ডালুদের আজো গ্রহণ করেনি। ফলে ধর্মকেন্দ্রিক নানা বৈষম্যের বোঝা নিয়ে টিকে আছে এদেশের ডালু আদিবাসীরা।
তুরি :
ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের কাজের সূত্র ধরে এ অঞ্চলে তুরিদের আগমণ ঘটে। এরা এসেছে ভারতের দুমকা ও ভাগলপুর থেকে। তুরিদের ঝুমটা নাচের গানেও মেলে তার সত্যতা-‘কিনে দেব ঝুমকা ত লেয়ে যাব দুমকা’। ভারত থেকে এলেও বর্তমানে তুরিদের সংখ্যা বাংলাদেশেই বেশি। দিনাজপুরের লোহাডাংগা, রামসাগর, বোটের হাট, জামালপুর, পুলহাট, খানপুর, মহেশপুর, বড়গ্রাম, সাদিপুর, মুরাদপুর, হাসিলা, গোদাগাড়ী, নাজিরগঞ্জ ছাড়াও জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর ও রংপুর জেলায় তুরিদের বসবাস।
তুরিরা পুরুষদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ‘শিং’ আর মেয়েদের নামের শেষে ‘বালা’ শব্দটি ব্যবহার করে। এরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে খট্টা ভাষায়। এক সময় এদের বিয়েতে পণপ্রথা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে যৌতুক প্রথা গ্রাস করছে সে আদি রীতিটিকে। মন্ডল, মহত, বাসি ও ছড়িদার- এ চার সদস্যের পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় তুরিদের একেকটি গ্রাম। তবে বর্তমানে মন্ডল বা মহত ছাড়া বাকি পদগুলোর তেমন কোন কার্যকারিতা নেই।
তুরি নারীদের পছন্দের অলন্কার রুপার ঝুমকা (রুপার দুল), হাসেলী (মালা), বাজু, বিছা প্রভৃতি। হাড়িয়া এদের প্রিয় পানীয়। করমা ও বিষহরি পূজা দুমধামের সঙ্গে পালন করে এ আদিবাসীরা। এছাড়া বিষহরি পূজার পরের দিন এরা তুমরি খেলার (প্রচীন তন্ত্রমন্ত্র খেলা) আয়োজন করে থাকে।
কৃষিকাজ তুরিদের প্রধান পেশা। কিন্তু এদের অধিকাংশই আজ ভূমিহীন। ফলে অন্যের জমিতে চাষাবাদ ও নাউয়া গিরি বা নাপিতের কাজ করে জীবন চালায় তুরি আদিবাসীরা। দারিদ্র্য থাকলেও নানা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভনে এরা এখনো ধর্মান্তরিত হয়নি।
মুশহর :
স্বল্পসময়ে ফসল লাগানো ও ফসল তোলার মজুর হিসেবে মুশহর আদিবাসীদের বেশ খ্যাতি রয়েছে। এ আদিবাসীরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ‘ঋষি’ শব্দটি ব্যবহার করে । এদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতের মুংগাইর জেলা থেকে। ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের কাজের সুত্রে এ অঞ্চলে এদের আগমন। দিনাজপুর জেলার নেহাল গ্রাম, দেরাপাটিয়া, গোবিন্দপুর ও দারুইলে ছাড়াও রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় অধিক সংখ্যক মুশহরদের বাস।
এরা হাতে খোদাই করে কাঁকড়া আকৃতির চিহ্ন এঁকে রাখে। মুসহরদের কাছে এটি ‘জাতি চিহ্ন’। ফসল কাটার পর এরা আদিরীতি মেনে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করে। এ সময় ছেলেরা ইঁদুর শিকার করে। এরা মনে করে এটি তাদের সৃষ্টিকর্তারই নির্দেশনা। এদের বড় উৎসব ছটপূজা। এ পূজায় সকালে সুর্য ওঠার আগে নদীর মধ্যে কোমর পানিতে নেমে সূর্যকে ভোগ দিয়ে প্রার্থনা করে এরা। এ ছাড়াও এরা বিষহরি, চিতিয়া বা ডালা পূজা করে থাকে। সাপের বিষ নামাতে এদের অনেকেই বেশ পারদর্শী।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মুশহরদের গ্রাম পরিষদ। এদের গ্রামে এখন ম-ল, ছড়িদার আর পারমানি ছাড়া আর কোন পদ নেই। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো এরাও বিয়েবাড়িতে কলাগাছ দিয়ে মারোয়া সাজায়। কিন্তু বিয়ের আগে বর ও কনকে নিজ নিজ বাড়িতে জোয়াল পূজা করতে হয়। এদের নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে নিষিদ্ধ।
অভাবের সময়টাতে মুশহররা আগাম শ্রম বিক্রি করে। ফলে ফসল কাটার সময়ে মহাজনদের জমিতে কম মূল্যে মজুর খেটে প্রথমেই তাদের শোধ করতে হয় কর্জের টাকা। মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের জন্য এনজিও নির্ভর স্কুলই মুশহর শিশুদের একমাত্র ভরসা। দারিদ্র্য থাকলেও ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রলোভন এদের তেমন টলাতে পারেনি।
ভুনজার :
দিনাজপুরের বহবলদীঘি, পিপল্লা, প্রভৃতি এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভুনজার আদিবাসীদের বাস। এক সময় পালকি বহন ও সাপের বিষ নামাতে এরা ছিল বেশ পারদর্শী। ভুনজাররা গ্রাম প্রধানকে বলে মন্ডল। নানা আচার-অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় মন্ডলকে। মন্ডলের পরই মহতের স্থান। সকলকে নানা খবর পৌঁছে দিতে গোত্রে রয়েছে কোতোয়াল। এছাড়া অবাধ্য কাউকে শাস্তি দেয়ার জন্য রয়েছে সিপাহি পদ। ভুনজারদের এমন তথ্য মিলে বহবলদীঘির মহত বাতাসু ভুনজারের ভাষ্য থেকে। ভুনজাররা কথা বলে খট্টা ভাষায় । এরা অধিকাংশই আজ ভূমিহীন।
ভুনজারদের প্রাণের দেবী মনসা বা বিষহরি। এদের ভাষায় ‘জিন্দ দেবতা’। ভাদ্র মাসের চাঁদের পূর্ণিমায় এরা বিষহরির পূজা করে। এছাড়া চৈতবিসিমা উৎসব পালন করে এরা। এ উৎসবে চৈত্র মাসের শেষ দিনে এরা বাসন্তী পূজা করে। ডায়রিয়া আর বসন্ত রোগের হাত থেকে মুক্তি পেতে পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই এরা এ পূজা করে আসছে। এ কারণেই এ পূজার এমন নামকরণ । এছাড়া বৈশাখের সকালে ভুনজাররা কাঁচামরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে পানতা খায়। এদের বিশ্বাস বছরের প্রথমে পানতা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও তারা কষ্ট পায় না। ওইদিনই এরা দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। রাতভর চলে খ্যামটা নাচ আর হাড়িয়া খাওয়া।
ভুনজার আদিবাসীদের বিয়েতে কনেকে পণ হিসেবে দিতে হয় ২৯ টাকা ও আধ মণ চাল। এরা পুরুষ ও মহিলা উভয়েই মাঠে কাজ করে। দারিদ্র্য ঘোচাতে, চিকিৎসা ও ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনে ভুনজারদের অনেকেই আজ ধর্মান্তরিত হচ্ছে।
মাহাতো :
এক সময় মাহাতোরা বন-জঙ্গল, গাছ, উঁচু-নিচু জমি কেটে চাষের উপযোগী করে তুলেছিল। এ কারণেই এদের কুর্মী নামে ডাকা হতো। চা-বাগান অঞ্চলে মাহাতোদের এখনো এ নামেই ডাকা হয়। আবার অনেকেরই অভিমত, পূর্বে মাহাতোদের বোদ্ধা নামে ডাকা হতো। কালক্রমে বোদ্ধা নাম থেকেই এ আদিবাসীদের মাহাতো নামকরণ করা হয়েছে। মাহাতোদের নিয়ে এমন তথ্য জানান, রাজশাহীর জাওইপাড়া আদিবাসী গ্রামের শতীশ মাহাতো। রাজশাহীর জাওইপাড়া, ঝালপুকুর, একান্নপুর, শ্রীগ্রামপুর, সাতপুকুরা, হাপানা ছাড়াও জয়পুরহাট, গাইবন্ধা, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, চাপাঁইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় রয়েছে অধিকসংখ্যক মাহাতো।
এ আদিবাসীদের গোত্র বা টোটেম দশটি। মাহাতোদের বিশ্বাস তাদের গোত্রগুলো গাছ-গাছড়া, জীব-জন্তু, পশু-পাখি প্রভৃতি থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে খট্টা ভাষায়। কিন্তু সে ভাষার লিখিত কোনো বর্ণ নেই। মাহাতো আদিবাসী সমাজে গ্রামপ্রধানকে বলে মন্ডল, মোড়ল, মাতব্বর, প্রামানিক, মাহাতোয়া প্রভৃতি। গ্রামপ্রধানের অনুমতি ছাড়া এদের কোনো অনুষ্ঠান বা উৎসব শুরু হয় না।
মাহাতো আদিবাসীরা অধিকাংশই কৃষিজীবী। এরা নারী-পুরুষ উভয়েই মাঠে কাজ করে। এক সময় এদের অনেক জমিজমা ছিল। কিন্তু কালপ্রবাহে নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে স্থানীয় ভুমিদস্যুরা দখল করে নেয় এদের ফসলি জমিগুলো। সহরায়ই এদের প্রধান উৎসব। অশুভ শক্তি নাশ ও গরু-ছাগলের মঙ্গল কামনায়ই এ পূজার উদ্দেশ্য। এছাড়া এরা ডাল উৎসব, সূর্যাহী পূজা, ফাগুয়া, পুষনা উৎসব পালন করে থাকে। সার্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এরা অন্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে এদেশের আদিবাসীরা। এদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে করেছে সমৃদ্ধ। অথচ আদিবাসীরা আজ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে শুধু বঞ্চিতই নয় বরং প্রতিনিয়ত এরা লড়াই করছে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য। সময়ের পরিক্রমায় ভূমিহীন হয়ে এরা আজ পরিণত হয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এক একটি জাতি, জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিগুলো।
সাপ্তাহিক ২০০০, বর্ষশুরু সংখ্যা, ২৪ মে ২০১৩
© 2013 – 2018, https:.