মুক্তিযুদ্ধ

জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা

ঠাকুরগাঁও থেকে পঞ্চগড়ের বাসে প্রায় ত্রিশ কিলো পথ চলতেই মিলে ভুল্লী বাজার। বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি নদী। স্থানীয় একজন জানালেন এটিই ভুল্লী নদী। তাই নদীর নামেই হয়েছে বাজারের নামকরণ। আমাদের গন্তব্য জাঠিভাঙ্গা। ভুল্লী ব্রিজ পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তাটি চলে গেছে সে দিকটাতে। এখানে পথ চলতে ভ্যানই ভরসা। একটি ভ্যান নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে আমরাও এগুই জাঠিভাঙ্গার দিকে।

ইউনিয়নের নাম শুখান পুখরী। কেনো ইউনিয়নটির এমন নামকরণ তা জানা নেই স্থানীয়দের। এ ইউনিয়নকে ঘিরে রেখেছে খরস্রোতা ছোট্ট একটি নদী। সবার কাছে এটি পাথরাজ নদী। নদীর নাম কেন পাথরাজ? এমন প্রশ্নে ভ্যানচালক লোকমান জানালেন নানা তথ্য।
পঞ্চগড় থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এ নদীটি। এক সময় এ নদীতে মিলত অসংখ্য পাথর। নদীর জলে ভেসে আসত পাথরগুলো। সে পাথর তুলে বিক্রি করতো নদীপাড়ের মানুষেরা। নদীর পাথরে বদলে যেত মানুষের ভাগ্য। তাই নদীপাড়ের মানুষরা নদীটির নাম দিয়েছে পাথরাজ। জাঠিভাঙ্গা নামক স্থানটি পাথরাজ নদীর তীরেই। শুখান পুখরী ইউনিয়নের এ জায়গাটিতেই ১৯৭১ সালে হত্যা করা হয় কয়েক হাজার নীরিহ-নিরাপরাধ মানুষকে।
আমরা যখন জাঠিভাঙ্গায় পৌঁছি তখন মধ্যবিকেল। নদীর ওপর ছোট্ট একটি ব্রিজ। ব্রিজ বেয়ে রাস্তাটি গিয়ে মিশেছে জাঠিভাঙ্গা বাজারে। ব্রিজের গোড়াতেই নির্মিত হয়েছে বধ্যভূমির স্মৃতি সৌধটি। লাল ইটের বেধীর ওপরে কালো টাইলসে বাঁধানো লম্বা প্রাচীর। বিকেলের আলোক ছটা এসে পড়েছে কালো প্রাচীরের ওপরটাতে। দূর থেকে তা জ্বলজ্বল করছে। চারপাশে নদীর তীরঘেষা কলাখেত। সবুজের মাঝে ঝকমকে কালো মিনারটি যেন মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে।

পাথররাজ নদীর এখানটাতেই ঘটেছিল গণহত্যাটি
পাথররাজ নদীর এখানটাতেই ঘটেছিল গণহত্যাটি

একসময় পাথরাজ নদীর বাঁকে বাঁকে ছিল বাঁশঝাড় আর জংলা। চারপাশ ছিল নিরিবিলি সুনসান। ফলে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীর দোসররা গণহত্যার জন্য বেছে নেয় এ নদীর তীরটিকেই। জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সুধীর চন্দ্র শর্মা। বয়স তার ষাটের মতো। ১৯৭১ সালে ছিলেন যুবক বয়সী। সেদিন দূর থেকে গণহত্যায় স্থুপ করা লাশ দেখে তিনি আৎকে ওঠেন। তখনও কয়েকজন ছিলেন জীবিত। বেয়নেটের আঘাতে স্তম্ভিত করে দেয়া হয় তাদের দেহ। নিভে যায় তাদের জীবন প্রদীপ। গণহত্যার ঘটনাটি শুনি সুধীরের মুখে।

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। শুক্রবার। দুপুরের পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী পাশের জগন্নাথপুর, নাড়–পাড়া, পলাশবাড়ীসহ দক্ষিণের গ্রামগুলো থেকে ধরে আনে মুক্তিকামী নিরীহ লোকদের। অন্যদিকে ভারতে যাওয়ার পথে ধরে আনা হয় কয়েক হাজার হিন্দু বাঙালীকে। পরে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হবে ভারতে- এমন আশ্বাসে জড় করা হয় সবাইকে। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করে স্থানীয় রাজাকার ও আল বদরের লোকেরা। জাঠিভাঙ্গায় নদীর ধারে প্রথমে লুটপাট করে কেড়ে নেয়া হয় সকলের টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালংকার। অতঃপর ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে সবাইকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয় পাথরাজ নদীর তীরে। রক্তে লাল হয় পাথরাজের জল। নদীর জলে ভেসে যায় মানবতা।

সুধীর বলেন, ‘প্রায় দুই হাজারের ওপর লোককে হত্যা করা হয়েছিল এখানে। এখনো জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুরে গেলে দেখা মিলে শত শত বিধবার। স্বামীকে হারিয়ে সেদিনের বীভৎস স্মৃতি নিয়ে আজো বেঁচে আছেন তারা। স্বাধীনের পর অনাহারে অর্ধাহারে কেটেছে তাদের জীবন। তবুও, রাষ্ট্রীয়ভাবে মিলেনি শহীদ পরিবারের সম্মান ও স্বীকৃতিটুকু।’

জাঠিভাঙ্গা বাজারে মিলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের দেখা। স্মৃতিসৌধের জন্য জায়গাটি দিয়েছেন তারই বড় ভাই আব্দুর রশিদ। বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, ‘এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত এদেশীয় দোসরা এখনও বেঁচে আছে। তাদের চিহিৃত করে বিচারের উদ্যোগ না নিলে আমরা দায়মুক্ত হবো না।’ পাশাপাশি তিনি দাবী জানান, জাঠিভাঙ্গা গণহত্যায় শহীদ পরিবারগুলোকে সরকারি স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের।
জাঠিভাঙ্গায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের প্রধান গেইট ও সীমানা প্রাচীরের কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়ল না। স্মৃতিসৌধের পেছন দিকটা অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা। বোঝার অপেক্ষা রাখে না বহুদিন কারো পায়ের ছাপ পড়েনি এখানটাতে। স্মৃতিসৌধের কোথাও গণহত্যার ইতিহাসটি টাঙানো নিই। ফলে কেন এই স্মৃতিসৌধটি- তা জানার উপায় নেই আগতদের। স্থানীয় কয়েকজন যুবককে প্রশ্ন করতেই তারা শুধু বললেন, একাত্তরে কিছু লোককে হত্যা করা হয়েছে এখানে। তারা সঠিকভাবে জানেও না এখানকার গণহত্যার ইতিহাসটি।

এ প্রসঙ্গে কথা বলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল মান্নান। তার ভাষায়, ‘ঠাকুরগাঁওয়ের সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল জাঠিভাঙ্গায়। তাই পরবর্তী প্রজম্মের কাছে এ ইতিহাসটি তুলে ধরা প্রয়োজন।’
স্মৃতিসৌধ শুধু ইট সুরকির কোনো স্থাপনা নয়। এটি শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মানের নিদর্শন। অথচ বছরের বিশেষ দিনেও ফুলেল শ্রদ্ধা পড়ে না জাঠিভাঙ্গা স্মৃতিসৌধে। নেই সংস্কার আর নিয়মিত পরিচর্চার ব্যবস্থা। নেই কোনো স্থানীয় উদ্যোগও। যা দেখে আজ শহীদ পরিবারগুলো শুধুই নিরবে চোখের জল ফেলে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকারিপোট২৪.কমে, ৩০ মে ২০১৩

© 2013 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button