ঝাড়ুয়ার বিল গণহত্যা

বিলটির অধিকাংশ স্থানের মাটি কাঁটা। এ কাজ চলছে কয়েক বছর ধরেই। কোদাল চালানো হয়েছে তার বুকের ওপর। লাল মাটির নানা স্তরই কাটা পড়েছে। সে মাটি চলে গেছে আশপাশের ইটখোলায়। পোড়ানো হয়েছে বিলের মাটি। মাটি পুড়ে তৈরি হয়েছে ইট। সে ইট চলে গেছে শহরে শহরে। দালানের পরতে পরতে বসেছে ইটগুলো। ইটের দালানে সমাজের লোকদের কদর বেড়েছে, সম্মান উঠেছে উঁচুতে। কিন্তু মাটির সঙ্গে পুড়ে গেছে মানবতা। পুড়ে গেছে শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাসগুলো।
বলছিলাম ঝাড়ুয়ার বিলের কথা। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝাড়ুয়ার বিল বধ্যভূমির বেহাল অবস্থা দেখে যে কারোরই এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কোন স্মৃতিচিহৃ নেই ঝাড়ুয়ার বিল বধ্যভূমিতে। নেই কোনো ঘের। গোটা জায়গাটিই অরক্ষিত। গরু চরছে একপাশে। অন্যপাশে মাটিকাটার ধুম। মানুষের পায়ের তলায় লুন্ঠিত হচ্ছে শহীদদের সম্মান। অথচ ১৯৭১ এ এখানেই হত্যা করা হয়েছিল প্রায় দেড় সহস্রাধিক নিরীহ নিরাপরাধ মানুষকে।
২৫ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তান বাহিনী নামে ঢাকায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও জগন্নাথ হলে রক্তের বন্যা বয়। এ খবর ছড়িয়ে পরে সারাদেশে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট ছিল রংপুর ও সৈয়দপুরে । সেখান থেকে মুক্তিকামী

বাঙালি সৈনিকরা বের হয়ে আশ্রয় নেয় রামনাথপুরে। রংপুর থেকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে যমুনেশ্বরী নদী। এ নদীর পশ্চিমে মুক্তিবাহিনীর অনেকেই শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। একসময় তারা পাকিস্তানিদের সৈয়দপুর যাওয়ার পথও বন্ধ করে দেয়। ৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে টিকতে পারে না তারা। পরবর্তী সময়ে সবাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সেনারা আক্রমণ করে রামনাথপুরসহ কয়েকটি এলাকায়।
১৯৭১ এ কি ঘটেছিল ঝাড়ুয়ার বিলে? এমনটাই প্রশ্ন ছিল ভয়াবহ সেই হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী ও বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যাপক মেছের উদ্দিনের কাছে। একাত্তরে তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার বয়স এখন সত্তরের মতো। তবু স্মৃতিররাজ্যে ওইদিনের ঘটনাটি এখনও প্রায় জীবন্ত। তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ ছিল ওই দিনটি। কারবালার প্রান্তরে মানুষ মরেছিল মাত্র ৭২ জন। অথচ দুটি ট্রেনে করে এসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা ওইদিন এখানকার ৮টি মৌজা ঘেরাও করে হত্যা করে হাজার হাজার লোককে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেকের মতো আমরাও আশ্রয় নিই ঝাড়ুয়ার বিলে। ১৭ এপ্রিল দুপুরের পরে শুরু হয় গুলির শব্দ। আমি ও আমার বাবা আব্দুল গফুর কোনোরকমে লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচাই। ওইদিন দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানিরা দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে জামায়াতের নেতা বাচ্চু খান, কামরুজ্জামান এবং নঈমকাজীর নেতৃত্বে একটি ট্রেনে এসে রামনাথপুর ঘিরে ফেলে। রংপুরে তখন আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিল এটিএম আজহারুল ইসলাম। তার নেতৃত্বে অস্ত্রসহ রংপুর থেকে আসে পাকিস্তান আর্মিদের আরেকটি দল। আশপাশের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার কারণে মৃত্যুভয়ে রামনাথপুর, ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুর এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল হাজার হাজার লোক। বিকেলের মধ্যেই ওরা নৃশংসভাবে হত্যা করে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে।’
মেছেরউদ্দিন দুঃখ করে বলেন, ‘আমার চাচি মোসলেমা বেগম গুলির শব্দে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিলেন তার পাঁচ বছরের মেয়ে মনসুরাকে। কিন্তু ঘাতকদের গুলি তাকেও বাঁচতে দেয়নি। একটি গুলি মায়ের পেছনে ঢুকে মেয়ের বুককে একইসঙ্গে বিদ্ধ করে বেরিয়ে যায়। ওই অবস্থায়ই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দুজন।’
কান্না জড়ানো কন্ঠে তিনি বলেন, ‘সেদিন সেখানে যাঁরা বয়সে তুরুণ এবং যুবক ছিলেন, এ রকম প্রায় ২০০ মানুষকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও আলবদরের লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি তারা। শুধু হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কয়েকজনের লাশ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ছিল আমার খালাতো ভাই সমবারু। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম সে সময়ই গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।’
ওইদিন মেছের উদ্দিন ও তার বাবা প্রাণে বেঁচে গেলেও নিকট আত্মীয়দের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকে ঝাড়ুয়ার বিলে। তার মামাতো ভাই ফজলুর রহমান, চাচাতো ভাই আজাদুল, ইসলাম উদ্দিন, আব্দুল গাফ্ফার প্রামাণিকের ৩ সন্তান ওহিদুল, ওমর আলী, রজব আলী, খিবীর উদ্দিনের ২ ছেলে নুর মোহাম্মদ, খায়রুলসহ শহীদ হন আরো অনেকেই।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীর দোশররা ওইদিন রামনাথপুর ইউনিয়নের কিসমত ঘাটাবিলের কোনাপাড়া, মন্ডলপাড়া, গয়দাপাড়া, কুটিরপাড়া, খিয়ারপাড়া, খালিশা হাজীপুরের পাইকপাড়া, তেলীপাড়া, বাজারপাড়া, বানিয়াপাড়া ও কামারপাড়ায় গণহত্যা, লুন্ঠন ও ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ছাড়া আলবদর বাহিনীর লোকেরা রামকৃষ্ণপুরের মাষাণডোবা,সরকারপাড়া, খিজিরেরপাড়া, মধ্যপাড়া, বালাপাড়া, বিত্তিপাড়া, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বুজরুক বাগবাড়, মন্ডলপাড়া, দোয়ানী হাজীপুর, সর্দারপাড়াসহ অনেক বসতিতেই গণহত্যা চালায়।
আমাদের সঙ্গে কথা হয় ঝাড়ুয়ার বিল গণহত্যার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মো. আফজাল হোসেন প্রামাণিকের। সেদিনের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা শুনি তার জবানিতে। তার ভাষায়, ‘পথেঘাটে পড়েছিল লাশ। ছোপ ছোপ রক্তের ওপর পড়েছিল অনেকের অসার দেহ। বাড়িঘরগুলো জ্বলছিল। চারপাশে ছিল ভীতিকর পরিবেশ। ওইদিন রাজাকার বাচ্চু খান, কারুজ্জামান ও আজহারের তাণ্ডবলীলায় লাল হয়ে গিয়েছিল ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুরের পানি।’ তিনি বলেন, ‘বানিয়াপাড়ার মেনহাজুল বিএসসি ও হিন্দুপাড়ার প্রাণকৃষ্ণ স্যারকে ওইদিনই হত্যা করা হয়।’
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইসলামি ছাত্রসংঘের রংপুর জেলার সভাপতি ছিলেন। এ কারণেই তিনি আলবদর বাহিনীর জেলা কমান্ডের দায়িত্ব পান। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় অতিসম্প্রতি তাকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার মামলা চলছে। ওই মামলায় মেছের উদ্দিনও একজন সাক্ষী। ফেরার পথে দৃঢ় কন্ঠে তিনি শুধু বললেন, ‘আলবদরদের শাস্তি না হলে এ জাতি কোনোদিনই দায়মুক্ত হবে না। ঝাড়ুয়ার বিলে হাজার হাজার লোককে যারা নির্বিচারে হত্যা করেছিল, তাদের বিচার যেন হয়।’
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকারিপোট২৪.কমে, ০৯ জুন ২০১৩
© 2013 – 2021, https:.