ভ্রমণকথা

বাংলা ভ্রমণ পত্রিকার জনক শ্রী প্রমোদাদিত্য মল্লিক

সাক্ষাৎকার - দময়ন্তী দাশগুপ্ত

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রথম পর্যটন পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ইংরেজি ভাষায় – অতীন্দ্র শংকর রায়ের সম্পাদনায় ‘Indian Tourist’। এটা ষাটের দশকের শেষ দিকের কথা। সম্ভবত ১৯৭৬ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় কাছাকাছি সময়েই ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় বাংলাভাষায় প্রথম পর্যটন পত্রিকা ‘ভ্রমণ কাব্য’। ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালেখি মুখ্য হলেও এই পত্রিকাটি অনেকাংশেই ছিল সাহিত্য পত্রিকা। ত্রৈমাসিক হিসাবে শুরু হলেও ১৯৭০ সালে এটি মাসিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৫ সালে সম্পাদক মনোজ দাসের প্রয়াণে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রতাপাদিত্য মল্লিক এবং প্রমোদাদিত্য মল্লিকের উদ্যোগে বাংলাভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ পত্রিকা ‘ভ্রমণ বার্তা’র জন্ম হয়। ভ্রমণ কাহিনির পাশাপাশি এতে নানান জায়গায় বেড়ানোর নতুন নতুন তথ্য, পথঘাটের হদিস – এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। চুঁচুড়ার জোড়াঘাটে গঙ্গার জলছোঁয়া মল্লিক বাড়িতে একটা ট্রাঙ্কের ওপর আরেকটা ট্রাঙ্ক রেখে শুরু হয় পত্রিকার অফিস। রেনু বাগচী, নীতিশচন্দ্র বাগচী, সুভাষ সমাজদার, শম্ভূনাথ দাস, অবধূত, সম্রাট সেন, শঙ্কু মহারাজ, দিলীপ মিত্র, ভূপতিরঞ্জন দাস, প্রবোধ সান্যাল, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কে না ছিলেন এই পত্রিকা গড়ে ওঠার পেছনে। তারপর দীর্ঘ চল্লিশ বছর কেটে গেছে – ‘ভ্রমণ বার্তা’র ছায়ায় গড়ে ওঠা ‘ভ্রমণ বার্তা পরিবার’-এর উপরেই এখন পত্রিকার দায়িত্ব। অজস্র বাণিজ্যিক ভ্রমণ পত্রিকার ভিড়ে আজ আর সেই রমরমাও নেই, কিন্তু ছিয়াত্তর বছর বয়সেও পুরনো সেই লেটার প্রেস ঘরটায় বসে ঐতিহ্যশালী এই পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন সম্পাদক প্রমোদাদিত্য মল্লিক।

সময়ের দূরত্বটা চল্লিশ বছরের, মাধ্যমটাও আলাদা, তবু কোথাও যেন ‘ভ্রমণ বার্তা’র সঙ্গে ‘আমাদের ছুটি’র একটা নিবিড় আত্মীয়তা অনুভব করছিলাম। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ পত্রিকা ‘ভ্রমণ বার্তা’। আর ২০১১ সালের মে মাসে জন্ম হল বাংলায় প্রথম আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকা ‘আমাদের ছুটি’-র। শীতের রোদ মাখা এক সকালে চুঁচুড়ার জোড়াঘাটে গঙ্গার তীরে ‘ভ্রমণ বার্তা’র কার্যালয়ে বসে শিক্ষার্থীর পাঠ নিচ্ছিলাম ছিয়াত্তরের নবীন সম্পাদক প্রমোদাদিত্য মল্লিকের কাছে। গল্পে-কথায় উঠে এল ভ্রমণবার্তার জন্ম থেকে বড় হওয়ার নানান মুহূর্তের সুখ-দুঃখের কাহিনি – যা আমাদের জোগাল এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা।

♦ ১৯৭১ সালে যখন ‘ভ্রমণ বার্তা’ প্রকাশিত হয়েছিল তখন বাঙালির মধ্যে তো এখন যে বেড়াতে যাওয়ার উৎসাহটা দেখা যায় ঠিক সেরকমটা ছিল না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ একটা ভ্রমণ পত্রিকা করার কথাটা মাথায় এল কেন? শুধুই কি শখ নাকি পেশার জন্যও?

• ‘ভ্রমণ বার্তা’ আমার পেশা, নেশা সবকিছুই। সেইসময় বাঙালি খুব কমই বেড়ানোর জন্য বেড়াতে যেত। বেশিরভাগই তীর্থ করতে যেতেন তার বাইরে বড়জোর পুরী-দার্জিলিং। তাওতো পুরীও তীর্থক্ষেত্রই হয়ে গেল। ‘ভ্রমণ বার্তা’র মাধ্যমে আমরা চেষ্টা শুরু করেছিলাম বাঙালিকে ভ্রমণমুখী করে তুলতে – সব দিক দিয়েই। ‘ভ্রমণ বার্তা’র আগে একটি বাংলা ভ্রমণ পত্রিকা ছিল – মনোজ দাসের ‘ভ্রমণ কাব্য’। কিন্তু সেটা ছিল পুরোপুরিই সাহিত্যভিত্তিক। ভ্রমণের লেখায় তথ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরাই প্রথম বলি। ‘ভ্রমণ বার্তা’র পরিচয় হল ‘তথ্য বিষয়ক ও তথ্যমূলক’। ‘ভ্রমণ বার্তা’র চতুর্থ সংখ্যায় আমরাই প্রথম বলেছিলাম – ট্যুরিজম ইজ আ ইন্ডাস্ট্রি। আমার টাকা পয়সা ছিল না, এখনও নেই, তাই ‘ভ্রমণ বার্তা’কে দাঁড় করাতে পারলাম না, কিন্তু দেখ, আমার কথাটা আজ কিন্তু সত্যি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ভ্রমণকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের রুজি রোজগার হয়েছে, হচ্ছেও। এইসবের পেছনে হয়তো ‘ভ্রমণ বার্তা’রও কিছুটা অবদান আছে। আজকের হলিডে হোম-এর পরিকল্পনাও শুরু করেছিল ‘ভ্রমণ বার্তা’ই। আমরা বলেছিলাম, চার-পাঁচজন বন্ধুবান্ধব মিলে কোন দর্শনীয় স্থানে গিয়ে একটা বাড়িভাড়া নিন। একেকসময় একেকজন গিয়ে কিছুদিনের জন্য সেখানে থাকুন আবার যাঁরা ওখানে বেড়াতে যেতে চান তাঁদেরকেও ঘরগুলো কয়েকদিনের জন্য ভাড়া দিন। তাহলে আপনাদের ব্যবসাও হবে আবার বেড়াতে গিয়ে থাকার জায়গাও হবে। এই পত্রিকাই প্রথম ডাক দিয়েছিল – ভ্রমণ করুন, ভ্রমণের মাধ্যমে দেশকে দেখুন ও জানুন আর সঙ্গে রাখুন একটি পত্রিকা। আসলে ‘ভ্রমণ বার্তা’ ছিল একটা আন্দোলন, পত্রিকাটি হল সেই আন্দোলনের একটা অন্যতম উপকরণ।

♦ ‘ভ্রমণ বার্তা’র প্রথম দিককার গল্প একটু বলুন না। কীভাবে পথ চলা শুরু হল? কারা ছিলেন সেদিন আপনাদের পাশে?

• আমার দাদা প্রতাপাদিত্য মল্লিক হেঁটে ও সাইকেলে সারা ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেছেন সেই পঞ্চাশের দশকেই। দাদার স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। সে স্বপ্নও একসময় পূরণ করেছেন অনেক পরিশ্রম করে। ফিরে এসে উনি একটা ট্যুর কনডাক্ট অফিস খোলেন। ভ্রমণ পত্রিকা বার করার কথাটাও দাদার মাথাতেই প্রথম আসে। নীতিশচন্দ্র বাগচী ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। নীতিশবাবুই আমাদের পাঠিয়েছিলেন সুভাষ সমাজদারের কাছে। সুভাষ সমাজদার তখন ন্যাশনাল লাইব্রেরীর রিডিং বিভাগের ইনচার্জ। এটা পত্রিকা বেরনোর আগের কথা। ওনার কাছে গেছিলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে ভ্রমণ সম্পর্কে কী পত্র পত্রিকা আছে সেটা দেখার জন্য। পরবর্তীকালেও ওনার কাছ থেকে নানাভাবে খুব সাহায্য পেয়েছি। সুভাষদাই শঙ্কু মহারাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। শঙ্কুদা দিয়েছিলেন শম্ভুনাথ দাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে প্রবোধ সান্যালের বাড়িতে। প্রবোধ সান্যালের বাড়িতে তখন হিমালয়ান ফেডারেশনের অফিস ছিল। সেখানে নিয়মিতই যেতাম। সেইসময় অনেক খ্যাতনামা পর্বতারোহীর সংস্পর্শে এসেছি। আর উত্তরপাড়ায় ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশন আর ইয়ুথ হস্টেল অ্যাসোসিয়েশন। ইয়ুথ হস্টেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অরুণ বাগচি। তাঁর কাছ থেকেও অনেক সাহায্য পেয়েছি। পরে মেজদা বলতাম যাঁকে সেই ভূপতিরঞ্জন দাসও প্রচুর উৎসাহ দিয়েছেন, নিয়মিত লিখেছেন ‘ভ্রমণ বার্তা’য়। ইনিও সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছেন। শঙ্কু মহারাজ অর্থাৎ জ্যোতির্ময় ঘোষ দস্তিদার, সম্রাট সেন, শম্ভুনাথ দাস, ‘হিমবন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক কমল গুহ – এঁরা তো নিয়মিতই আসতেন। প্রবোধ সান্যাল, উমাপ্রসাদও এসেছেন।
ভ্রমণবার্তা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের মহালয়ায়। ডবল ক্রাউন, লালচে নিউজ প্রিন্টে ছাপা শরৎ ভ্রমণ। দাম ৪ আনা। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এই পত্রিকা টিঁকবে তো? সাবধান করেছিলেন যে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হবে, তাতে বিপদ আছে। প্রথম সংখ্যা পনের দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল আর দেখলাম মোষ তাড়াতে বেশ মজাই পাচ্ছি। সেই শুরু। তখন পত্রিকা নিয়ে সাইকেলে চড়ে চক্কর দিয়েছি শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটি, ব্যান্ডেল, ত্রিবেণী, মগরা। কলকাতার স্টলে স্টলে নিজের হাতে পত্রিকা দিয়ে এসেছি। বিজ্ঞাপনের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছি। তবে সেইসব দিনগুলো অন্যরকম ছিল। চল্লিশ বছর আগে যখন ‘ভ্রমণ বার্তা’ প্রথম ভ্রমণ রসিকদের হাতে আসে তখন ভ্রমণ বিষয়ে আর কোন পত্রিকা ছিলনা। সকলে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, কতভাবে সাহায্য করেছেন। এখনতো কর্মী পাওয়া যায়না, পয়সা দিয়ে কর্মচারী রাখতে হয়। আমার সেই সামর্থ্য নেই।
প্রথমে ছিল মাসিক, পরে পাক্ষিক। একসময়ে সাপ্তাহিকও করেছিলাম। অনেকেই বলেছেন পত্রিকার গ্ল্যামারটাই আসল। কিন্তু আমার মনে হয়েছে পত্রিকার একটা সংখ্যা হয়তো দারুণ করে বের করলাম, তারপরে আর বের করতেই পারলাম না, তার তো কোন মানে হয় না। আমি যেভাবে একে বাঁচিয়ে রাখতে পারব সেভাবেই এগোবো। অনেকে সাবধান করেছেন এই বলে যে তুমি যখন প্রথম এটা শুরু করেছ, প্রথম সংখ্যা থেকেই দেখবে বড় বড় যারা পত্রপত্রিকা করে তারা তোমার প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে নজর রাখবে। একদিন তুমি হয়তো সফল হবে, এর একটা মার্কেট তৈরি করবে, কিন্তু জানবে সেই মার্কেটটা ক্যাপচার করবে ওই বড় বড় পত্রপত্রিকা। তার সুযোগটা তুমি পাবে না। তোমার পত্রিকা হয়তো উঠে যাবেনা, কিন্তু ফলটা ভোগ করবে ওরা। আমি কিন্তু এই সব কিছু প্রথম থেকে জেনে বুঝেই এগিয়েছি। তবু খারাপ লাগা একটা থেকেই যায়।
♦ ১৯৭২ সালের অক্টোবরে হুগলীতে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন সম্মেলন হয়। উদ্যোক্তা ছিল ‘ভ্রমণ বার্তা’। এরপরেও আপনারা বিভিন্ন জায়গায় ট্যুরিস্ট ফেস্টিভ্যাল করেছেন। শুধু একটা পত্রিকা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই বেশ শক্ত কাজ। তার সঙ্গে এত কিছু করা মানে বনের মোষ তাড়ানোটা একটু বেশি হয়ে গেল না কি?

•ওই যে তোমাকে বললাম, ‘ভ্রমণ বার্তা’ শুধু একটা পত্রিকা নয়, একটা আন্দোলন। ‘ভ্রমণ বার্তা’র মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ভ্রমণ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলা এবং ভ্রমণকে একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। পশ্চিমবঙ্গেই প্রচুর দেখার জায়গা আছে অথচ মানুষ যায় না। এটা আমরা সেই শুরুর থেকে বলে এসেছি। আসলে জানেনা বলেই যায়না। পর্যটন সম্মেলনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটা জেলা ধরে মানচিত্র দিয়ে, তথ্য দিয়ে মোট ১৫০টা স্পট তুলে ধরি। ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নিয়মিত খোঁচাতাম যে পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে প্রচার করেন না কেন? সুন্দরবনকে আমরাই প্রথম প্রচারের আলোয় আনি।
আমার বাবা গোপেশ চন্দ্র মল্লিক ছিলেন ফ্রিডম ফাইটার, নেতাজীর অনুগামী। সেই সূত্রে আমি প্রথমবার আন্দামানে গিয়েছিলাম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটা দলের সঙ্গে। ফলে আন্দামানে নেমেই বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আন্দামানে ট্যুরিস্ট ফেস্টিভ্যাল করার প্রস্তাব, উৎসাহ, সহায়তা সবই এঁদের কাছ থেকেই পেয়েছি। মজার কথা এই যে ওখানে কাগজে, রেডিওয় সর্বত্র প্রচার হয়েছিল যে ‘ভ্রমণ বার্তা’ই এটা করছে। যখন গভর্নর উদ্বোধন করলেন তখন সবাই জানতে পারল যে এটা সরকারের সঙ্গে যৌথ প্রয়াস। এছাড়া নেপালের কাঠমান্ডুতেও আমরা ট্যুরিস্ট ফেস্টিভ্যাল করেছি। সেও আরেক গল্প।

♦ইদানীং পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিয়ে নানান চিন্তা ভাবনা নতুন করে শুরু হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?

•দেখো, প্রথম সংখ্যা থেকেই আমরা লিখেছিলাম যে ঘরের পাশে অনেক দেখার জায়গা আছে। সপ্তাহে একটা দিন বাড়িতেই যা খাবার আছে বেঁধে নিয়ে যদি কাছাকাছি যাওয়া যায় তাহলে পরিবারের সবার মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেমন ধরো, খড়দাতেই কত দেখবার জিনিস আছে। আমরা ‘ভ্রমণ বার্তা’র ব্যাজ লাগিয়ে খড়দার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। লোকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে এরা আবার কারা? আমরা বললাম আপনারাও আসুননা আমাদের সঙ্গে। ঘুরে টুরে বলে, বাবা এখানে এত দেখার জিনিস আছে জানতাম না তো!
‘ভ্রমণ বার্তা’য় প্রথমদিকে ভূপতিরঞ্জন দাসের নিয়মিত কলাম বেরোত, ‘দুয়ার থেকে অদূরে’। কাছাকাছি জায়গায় ভ্রমণ করতে হবে পাঁচ টাকা বাজেটে। খাবারদাবার সব যে যার নিজেরা গুছিয়ে নিয়ে যাবে, গাড়ি ভাড়াটাড়া সব ওই পাঁচ টাকার মধ্যে। সেখানে তিনি একজায়গায় লিখেছেন যে একবার ঠিক হল ছ’জনে মিলে কোথাও একটা যাওয়া হবে। শেয়ালদা স্টেশনে এসে দেখা গেল চারজন এসেছে, দু’জন আসেনি। ঠিক আছে, যতজন এসেছে ততজনই চল। সেখানে নেমে দেখে চায়ের দোকান একজন হাঁকছে, এই যে, আমি এখানে বসে আছি। তিনি এসেছে অন্য একটা রুটে। রুটটা বলা হয়ে গেল। আবার কিছুটা এগিয়ে আরেকজনের সঙ্গে দেখা। তিনি আবার আর এক পথে এসে পৌঁছেছেন। তাঁদের কথার মধ্যেই কিন্তু ওই জায়গাটায় যাওয়ার তিনটে রাস্তার কথাই বলা হয়ে গেল। এরপর তিনি করেছিলেন ‘রেললাইনের দুধারে’ অর্থাৎ ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে কাছের রেলস্টেশন গুলিতে কী কী দর্শনীয় আছে।

পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণকে জনপ্রিয় করার আরও একটা চেষ্টা করেছিলাম আমরা। ‘পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন গবেষণা ও প্রচার সমিতি’ -এই নামে সংগঠনের রেজিস্ট্রেশনও করা হয়েছিল। পরিকল্পনাটা এরকম ছিল যে আগ্রহীরা এখানে বসে ‘ভ্রমণ বার্তা’ পড়বেন, এখানে প্রচুর বই আছে, সেসব দেখবেন। তারপর একেকজন একেকটা জায়গা বেছে নেবেন ও তার ওপরে গবেষণা করবেন। আমরা সেইসব জায়গায় ট্যুর করব। ট্যুরে তাঁরা বিনা খরচায় যাবেন। তাঁরা যেটা লিখছেন সেটাকে মিলিয়ে দেখবেন ঠিক হয়েছে কিনা, প্রয়োজনে আপডেট করবেন। যদি এই রিসার্চ প্রজেক্টটা আমরা ঠিকমত গড়ে তুলতে পারতাম তাহলে সরকারী সাহায্যও নিশ্চয় পেতাম। তখন তাঁদেরও আমরা কাজের জন্য অর্থ দিতে পারতাম।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজম থেকে যখন প্রথম ট্যুরিস্ট গাইডবুক তৈরির পরিকল্পনা হল, ডিরেক্টর আমা্কে ডেকে পরামর্শ চেয়েছিলেন কীভাবে করা যায়। আমি মেজদাকে নিয়ে গিয়ে দুজনে মিলে ছকে দিলাম কীভাবে কী হবে। যদিও তার কোন স্বীকৃতি পাইনি। ‘ভ্রমণ সঙ্গী’-র কথা নিশ্চয় জানেন, ওদের বইটাও প্রথম এখান থেকে একটা ফাইল নিয়ে গিয়ে শুরু হয়েছিল, পরবর্তীকালে ওরা লোক পাঠিয়ে বিভিন্ন জায়গার অজস্র তথ্য সংগ্রহ করে একটা অসাধারণ কাজ করেছে।

♦আপনার নিজের বেড়ানোর গল্প একটু বলুন। সবচেয়ে প্রিয় জায়গা কোনটা?

•অনেক জায়গাতেই তো গেছি, তাই সবচেয়ে প্রিয় কোনটা বলা মুশকিল। আন্দামানের কথা বলা যেতে পারে। তবে আমার চিন্তাভাবনা সবসময় পশ্চিমবঙ্গকে ঘিরেই। কী করে পশ্চিমবঙ্গকে আরও সবার সামনে তুলে ধরা যায়। শিবনিবাস গেছ? চূর্ণী নদী দিয়ে ঘেরা একটা দ্বীপ। বর্গীর হামলার সময় কৃষ্ণনগরের মহারাজা এটা করেছিলেন। ’৭৪ সালের কথা। তখন জল এত স্বচ্ছ ছিল যে পা দিলে পায়ের নখ পর্যন্ত দেখা যেত, এখন শুকিয়ে গেছে। দু’টো মন্দির আছে। শিবলিঙ্গটি লম্বায় আট ফুট, বেড় চোদ্দ ফুট। সিঁড়ি বেয়ে উঠে মাথায় জল দিতে হয়। তখন লোকে নামও জানত না। আমরা ‘ভ্রমণ বার্তা’য় বার করি, এখান থেকে লোকজনকে বেড়াতে নিয়ে যাই। অন্য একটা গল্প বলি, একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে – আমরা একবার পাণ্ডুয়ার মিনারে গেছি সদলবলে। বসে আছি, কেয়ারটেকার এসে চাবি খুলে দিলে মিনারে উঠব। হঠাৎ দেখি একটা বিরাট বাস এসে দাঁড়াল। আমি একজনকে বললাম, দেখতো কোথা থেকে বাসটা এল, কারা এল? খোঁজ নিয়ে দেখে ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট। আপনারা? ‘ভ্রমণ বার্তা’। ‘ভ্রমণ বার্তা’! প্রমোদ মল্লিক আছেন? হ্যাঁ আছেন। ওঁকে ডাকুনতো। আমিতো গেছি। গিয়ে জানতে চাই, আপনারা এখানে কেন? আপনিই তো মশাই, আপনার জন্যই তো এসব হয়েছে। কোথায় শিবনিবাস, কোথায় কালনা, কোথায় ইয়ে -আপনিই তো ঢুকিয়েছেন সব জোর করে। আপনারা এখানে কী জন্য এসেছেন? বললাম, মিনারে ওঠার জন্য। হাতজোড় করছি মশাই, এঁদের সামনে আর বলবেন না, তাহলে এঁরাও বলবেন আমরা মিনারে উঠব, আমাদের ট্যুরটার বারটা বেজে যাবে।

♦প্রতি মাসে‘ভ্রমণ বার্তা’র বৈঠক বসে। এও কি সেই প্রথম থেকেই?

• মাসের দ্বিতীয় শনিবারে আমাদের মিটিং বসে, ভ্রমণ আলোচনা হয়, কাগজেই দেওয়া থাকে পরের বারের তারিখ-সময়, যাতে নতুন কেউও পত্রিকা পড়ে ওই দিন হাজির হতে পারেন, এও সেই প্রথম থেকেই। এই আড্ডায় বিখ্যাত সব ভ্রামণিক, ভ্রমণ লেখকেরা এসেছেন। এখন এই ঘরটাতেই সকলে বসেন, তিরিশ-চল্লিশ জন লোক হয়ে যায়। আগেতো বাইরে হোত। তখন দেড়শো-দুশো জন হয়ে যেত। ‘ভ্রমণ বার্তা’র এই আড্ডাতেই আলাপ হয়ে কত মানুষ পরস্পরের আজীবন বন্ধু হয়ে গেছেন, একসঙ্গে বেড়াতে গেছেন, ক্লাব তৈরি করেছেন। আবার ‘ভ্রমণ বার্তা’কে নিয়ে কত আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সব সমালোচনা মাথা পেতে নিয়েছি, চেষ্টা করেছি কী করে আরও ভালো করা যায়। একবার কলকাতায় আড্ডা বসেছে। আমাদের নিয়ম হচ্ছে, নতুন যাঁরা তাঁরা প্রথমে নিজের পরিচয় দেবেন। এক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি প্রথমেই আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কেন? এক বন্ধু আমায় একটা ‘ভ্রমণ বার্তা’ দিচ্ছিলেন। আমার কাছে দাম চাইতে আমি বললাম কী হবে এটা দিয়ে, ছেলের দুধ গরম করা যাবে? তারপর সেইদিনই খুব বৃষ্টি হচ্ছে, দমদম স্টেশনে একটা স্টলে দাঁড়িয়ে আছি। বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখি একটা ‘ভ্রমণ বার্তা’। পড়তে পড়তে ট্রেন এসে গেছে। জিজ্ঞাসা করলাম কত? বলল ২৫ পয়সা। আমি দামটা দিয়ে পত্রিকাটা নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। সেইটাতে দেখেই আপনাদের এখানে এসেছি আমি। আমি যে মন্তব্যটা করেছিলাম, সেটা আমার সত্যিই অন্যায় হয়েছে, আমাকে আপনাদের আজীবন গ্রাহক করে নিন।

♦ দীর্ঘ চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায়‘ভ্রমণ বার্তা’কে ঘিরে আপনার সবচেয়ে ভালোলাগা-মন্দলাগার অনুভূতি কি?

• ‘ভ্রমণ বার্তা’-ই আমার সবকিছু। যদিও ‘ভ্রমণ বার্তা’ করার যাবতীয় কৃতিত্ব ‘ভ্রমণ বার্তা’র লেখকদের। আমি কেবল সতরঞ্চি পেতেছি আর তুলেছি। লেখক, গ্রাহক, পাঠকরাই সেখানে এসেছেন, পরস্পরের অভিজ্ঞতা আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে ‘ভ্রমণ বার্তা’-কে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘ভ্রমণ বার্তা’ সম্পাদনার সুবাদে অনেক স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান পেয়েছি। এটাই আমার ব্ড় পাওনা। ভালোলাগার স্মৃতি বলতে তো অনেক কিছু -শুরুর সেই দিনগুলো, এতবছরের কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, ভদ্রেশ্বরের সংগঠন ‘ভ্রমণ আড্ডা’-র দেওয়া মুসাফির পুরস্কার সবকিছুই মনে পড়ে।
আমি নিজে অন্য কিছুই করিনি, এমনকী চাকরি বাকরি-ও ছেড়েছি এই ভ্রমণবার্তার জন্যই। দুঃখ লাগে যে টাকা পয়সা না থাকায় পত্রিকাটাকে সেভাবে দাঁড় করাতে পারলাম না। যখন বুঝলাম যে আর চালাতেই পারব না তখন সবাইকে ডেকে ট্রাস্ট বানিয়ে ‘ভ্রমণ বার্তা পরিবারে’র হাতে পত্রিকাটা তুলে দিয়েছি। কিন্তু তাতেও যে বিশেষ কিছু সমাধান হয়েছে তা নয়। সবচেয়ে আক্ষেপ লাগে যে সত্যিকারের কোন উত্তরসূরী তৈরি করতে পারলাম না।

♦‘ভ্রমণ বার্তা’র জন্মের চল্লিশ বছর পরে প্রথম আন্তর্জাল ভ্রমণপত্রিকা ‘আমাদের ছুটি’র জন্ম। আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের পাথেয়। ‘আমাদের ছুটি’র জন্য আপনার বার্তা কী?

•নিশ্চয় তোমাদের এই উদ্যোগ সফল হবে। যাঁরা ঘুরে বেড়ান তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে হবে, সেটাই আরেকজনের কাজে লাগবে। তাহলে মানুষও তোমাদের পত্রিকাটি সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। তবে একটা কথা মনে রাখবে অর্থের জোর না থাকলে কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকাটা শক্ত। তুমি একটা নতুন কিছু করলে, তার সুযোগটা সদ্ ব্যবহার করবে অন্যে। এইটা মাথায় রেখেই এগিয়ো।

ভ্রমণ করুন, ভ্রমণের মাধ্যমে দেশকে দেখুন ও জানুন আর সঙ্গে রাখুন একটি পত্রিকা’ – এই আদর্শ নিয়েই ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রতাপাদিত্য মল্লিক এবং প্রমোদাদিত্য মল্লিকের উদ্যোগে বাংলাভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ পত্রিকা ‘ভ্রমণ বার্তা’-র জন্ম হয়েছিল। ভ্রমণ শিল্প এবং পত্রিকাকে দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই করে ২৭ জুন ২০১৩ একপ্রকার নিশব্দেই চলে গেলেন ৭৩ বছরের যুবক প্রমোদাদিত্য। আমাদের অগ্রজকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।

ছবি :  রত্নদীপ দাশগুপ্ত

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আন্তর্জাল ভ্রমণপত্রিকা  ‘আমাদের ছুটি’র তৃতীয় সংখ্যায়

© 2013 – 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

One Comment

  1. ভ্রমণ পত্রিকা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে লেখা পাঠাবার e mail add কোনটি যদি বলেন? লেখা পাঠাতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button