নির্মল সেন জন্মদিনে তোমায় লাল সালাম

নির্মল সেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট, বাম রাজনীতির পুরোধা ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি।
১৯৪২ সালে নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় মহত্মা গান্ধীর “ভারত ছাড়” আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ১৬ দিন স্কুল গেটে ধর্মঘট করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি রেভ্যুলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি আরএসপি’তে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে জেলে থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ আউয়ালের অনুরোধে ছাত্রলীগে যোগ দেন। তখন নির্মল সেন এমএ আউয়ালের কাছে দাবি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে তিনি ছাত্রলীগে যোগ দেবেন। এমএ আউয়াল নির্মল সেনের এই দাবিটি মেনে নিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে নির্মল সেন বরিশাল জেলা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি গোলাম রব্বানি। ১৯৫৪ সালে নির্মল সেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রিয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন। তৎকালীন সময়ে ছাত্রলীগ কেন্দ্রিয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোমিন তালুকদার এবং এম এ আউয়াল। ১৯৬০ সালে নির্মল সেন আবার আরএসপিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালে আদমজি জুটমিলে রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, নির্মল সেন, সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮৮ সালে নির্মল সেন এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল প্রর্যন্ত তিনি সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে নির্মল সেনকে জীবনের অনেকটা সময় জেলে কাটাতে হয়েছে।
শৈশব থেকেই নির্মল সেনের লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয়। তিনি ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় হাতে লিখে প্রকাশিত ‘কমরেড’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। নির্মল সেন মূলত: কলাম লেখক ছিলেন। এছাড়াও তিনি প্রবন্ধ এবং ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন বেশ কয়েকটি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এদেশের সমকালীন সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির প্রক্ষিতে তৎকালীন দৈনিক বাংলায় লেখা ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ নামক একটি উপ-সম্পাদকীয় তাঁকে লেখক হিসেবে প্রভূত খ্যাতি ও পরিচিতি দান করে।

তিনি ১৯৩০ সালের ৩ আগষ্ট গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মাতার নাম লাবণ্য প্রভা সেনগুপ্ত। পরিবারের ছয় ভাই ও বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন চতুর্থ। তাঁর পিতা কোটালীপাড়ার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনের গণিত শিক্ষক ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকার ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করতেন।
১৯৪৬ সালে দেশ বিভক্তির পূর্বে নির্মল সেনের পিতামাতা তার অন্য ভাই বোনদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতা চলে যান। জন্মভূমির প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসার কারণে তিনি এদেশে থেকে যান। নির্মল সেন বড় হয়েছেন ঝালকাঠি জেলায় তার পিসির বাড়িতে।
তিনি প্রথমে কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করে পরে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি এম ই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি বি এম একাডেমী-তে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে প্রবেশিকা (এসএসসি) পাস করেন। বরিশালের বিএম কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৬ সালে আইএসসি পাস করে বিএসসি-তে ভর্তি হন। এসময় তিনি রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলে সেখান থেকে বিএসসি পরীক্ষা দিলেও অকৃতকার্য হন। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে জেলখানা থেকেই বিএ পরীক্ষায় অংশ নেন এবং কৃতকার্য হন। তিনি ১৯৬৩ সালে সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অরথনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
নির্মল সেন ১৯৬১ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতায় তার কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি ১৯৬২ সালে দৈনিক জেহাদ পত্রিকায় যোগ দেন। পরে ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান, পরবর্তীতে দৈনিক বাংলায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। প্রেস ট্রাস্টের এই পত্রিকাটি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকাই যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে নির্মল সেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফেডারের সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও যুক্ত ছিলেন।
লেখক হিসেবেও নির্মল সেনের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তাঁর লিখা বইয়ের মধ্যে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র,বার্লিন থেকে মস্কো, পূর্ব বঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ, মা জন্মভূমি, লেনিন থেকে গর্বাচেভ, আমার জবানবন্দী, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, আমার জীবনে ’৭১-এর যুদ্ধ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
নির্মল সেন ২০১৩ সালের সালের ৮ জানুয়ারি তারিখে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ইচ্ছানুসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-এ তিনি দেহ দান করে যান। তাঁর দ্বিতীয় ইচ্ছে ছিল নিজ বাড়িতে একটি মহিলা কলেজ স্থাপন করার। ইতোমধ্যে কলেজটির প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং কলেজের নামকরণ করা হয়েছে সাংবাদিক নির্মল সেন মহিলা কলেজ। তিনি এ কলেজের জন্য তার বাড়ির ১ একর ৫০ শতক জায়গা রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছেন।
ছবি ও তথ্য : সংগৃহীত
© 2013 – 2018, https:.