বঙ্গবন্ধুর নাম তখন বলাই যেত না
বাবা-মায়ের আদরের সন্তান লোকমান। ৪ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তৃতীয়। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মুরাদপুর গ্রামে। নিয়ম মেনে স্কুলে যাওয়া আর বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকত আনন্দে। পছন্দের খেলা ছিল হাডুডু, মার্বেল আর ফুটবল। একই গ্রামের আনসার, মোকারম, আহসান আর খোরশেদ ছিলেন খেলার সাথী। বন্ধুদের সঙ্গে তার নানা স্মৃতি। সে স্মৃতির ভেলায় ভর করেই কেটে যায় তার দিনগুলো।
সময়টা ১৯৭০। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে লোকমান তখন কলেজে। দিনাজপুর কেবিএম কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু তখন বাঙালিদের প্রাণের নেতা। লোকমান নানাভাবে জানতেন তাঁর কথা। একবার খবর এল দিনাজপুরে আসবেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণ দেবেন গোড়া শহীদ ময়দানে।
অন্যদের সঙ্গে ওইদিন লোকমানও বেরিয়ে পড়েন। পায়ে হেঁটে ১৩ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দেখতে আসেন বঙ্গবন্ধুকে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী ভাষণ উদ্দীপ্ত করে তাকে, জাগ্রত করে তার দেশপ্রেমের বোধ। বঙ্গবন্ধু এভাবেই জায়গা করে নেন লোকমানের হৃদয়পটে।
১৯৭১ সাল। দেশ তখন উত্তপ্ত। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। মুরাদপুর গ্রামের আজিমুদ্দিনের বাড়িতে ছিল একটি রেডিও। সেখানে ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন লোকমান। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দিবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব……।’’
লোকমানের কাছে এ ভাষণই মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্ট নির্দেশনা।
এর পরপরই দিনাজপুরে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন আমজাদ, ইউসুফ প্রফেসর, শাহ মাহতাব, আবদুর রউফ চৌধুরী, গুরুদাস তালুকদার, এম আবদুর রহিম, হাজী মোহাম্মদ দানেশ প্রমুখ নেতারা। সময় গড়িয়ে আসে ২৫ মার্চ। ঢাকায় আর্মি নামে। সে খবর ছড়িয়ে পরে সবখানে।
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকণ্ঠ কুঠিবাড়ীতে। ২৮ মার্চে সেখানে বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে পাঠান-পাঞ্জাবিরা। ফলে বাঙালি জোয়ানদের সমর্থনে চারপাশ থেকে কুঠিবাড়ীতে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার মানুষ।
অন্যদের সঙ্গে দলবেঁধে সেদিন লোকমানও ছুটে যান সেখানে। লুট হয় কুঠিবাড়ীর অস্ত্রাগার। অস্ত্র চলে আসে সাধারণ মানুষের হাতে। সবাই তখন দিনাজপুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।
দিনাজপুর দখলদারমুক্ত থাকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। ওইদিন শহরের তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনী। তাদের একটি বড় দল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভূষিরবন্দর রামডুবি হয়ে শহরের নিকটবর্তী চেহেলগাজীতে আক্রমণ করে। অন্য দলটি রাজবাড়ী হয়ে এবং তৃতীয় দলটি পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী, আমবাড়ী হয়ে দিনাজপুর শহর দখলে নেয়। ফলে জীবন বাঁচাতে শহরের লোকেরা আশ্রয় নেন আশপাশের গ্রামগুলোতে।
লোকমানরা তখনও নিজ গ্রামে। সবার মনে অজানা ভয়। কী হবে দেশে! এপ্রিলের শেষের দিকে মুরাদপুর গ্রামে হানা দেয় খানরা। আবু বকর সিদ্দিক নামের একজনকে তারা গুলি করে হত্যা করে প্রকাশ্যে। জ্বালিয়ে দেয় গোটা গ্রাম। ফলে অন্যান্যদের মতো পরিবার নিয়ে লোকমানরাও পালিয়ে যান ভারতে। বড়গ্রাম হয়ে ভাতখৈর সীমান্ত দিয়ে আশ্রয় নেন প্রাণসাগরে।
শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. লোকমান হাকিমের জীবনকথা। ১৯৭১ সালে তিনি যুদ্ধ করেছেন ৭ নং সেক্টরে। মোহনপুর ত্রিশুলা ক্যাম্প অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারির স্প্রিন্টারের আঘাতে জখম হয় তার ডান পায়ের গোড়ালি। বর্তমানে তিনি দিনাজপুর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
দিনটি ছিল শুক্রবার। রমজান মাস। দিনাজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে তার সঙ্গে চলে আমাদের আলাপচারিতা।
মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিমের পিতার নাম আবদুর রহমান এবং মাতা ফাতেমা বেগম। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর সদর উপজেলার মুরাদপুর গ্রামে। পিতা ছিলেন সাধারণ কৃষক।
কথোপকথনের শুরুতেই প্রশ্ন ছিল, কেন গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ? লোকমানের উত্তর, ‘‘নিজের দেশ ফেলে আমরা তখন ভারতে। অন্যের দয়ায় বেঁচে আছি। একদিন খবর পেলাম পাকিস্তানিরা যুবতীদের ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। মনের ভেতরটা দপ করে উঠল। বারবার মনে হলো নিজের বোনদের কথা। দেশকে মুক্ত করতে হবে, বাঁচাতে হবে মা-বোনদের ইজ্জত। এ কারণেই অস্ত্র তুলে নিই।’’
ট্রেনিংয়ের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘‘আমি, মোকারম ও আজিজুল প্রথমে ভর্তি হই ইয়ুথ ক্যাম্পে। প্রাণসাগরে। আশরাফ সিদ্দিকী ছিলেন ক্যাম্পের দায়িত্বে। সেখানে কয়েকদিন চলল লেফট-রাইট। প্রশিক্ষক ছিলেন ওয়াহেদুল ইসলাম দুলু। পরে আমাদের পাঠানো হয় শিববাড়িতে। সেখানেই আমাদের রিক্রুট করা হয়। উচ্চতা কম হওয়ায় প্রথমে আমাকে নিচ্ছিল না। বাদপড়াদের দলে বসে রইলাম। পরে জানতে চাইল, কে কে মেট্রিক পাশ। আমি হাত তুলতেই বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে নিল। আমার নামের পাশে পড়ল এফএফ নং ১৪৬৬।’’
কোথায় ট্রেনিং করলেন?
লোকমানের উত্তর, ‘‘আমাদের পাঠানো হল ভারতের রায়গঞ্জে। কর্ণনঝরা নদীর তীরে। সেখানে কয়েকদিন ট্রেনিংয়ের পর বন্যা দেখা দেয়। আমাদের তখন সরিয়ে নেওয়া হয় কালিয়াগঞ্জ শালবাড়ি জঙ্গলে। কিন্তু টানা বৃষ্টির কারণে সেখানেও ট্রেনিং সম্ভব হল না। ভয়ে ওই সময় অনেকেই ট্রেনিং না করে পালিয়ে গেল। যারা থাকল তাদের পাঠানো হল শিলিগুড়ি পানিঘাটায়। পাহাড়ের ওপর চলল আমাদের ২৮ দিনের ট্রেনিং। ভারতীয় ইন্সট্রাক্টর ভিম সিংয়ের কথা এখনও মনে পড়ে। ট্রেনিংয়ের সময় এসেছিলেন কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী ও তাজউদ্দিন আহমেদ। তাদের সঙ্গে সেটিই ছিল প্রথম দেখা।’’
কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছেন ?
মুক্তিযোদ্ধা লোকমানের উত্তর, ‘ট্রেনিং শেষে প্রথমে আঙ্গিনাবাদ এবং পরে আমাদের পাঠানো হয় বড়গ্রাম ক্যাম্পে। গেরিলার বেশে আমরা অপারেশন করি দিনাজুপরের বড়গ্রাম, কোমলপুর, দাইনুর, কুতর, মোহনপুর, ত্রিশুলা, মুরাদপুর জত বহবল, ডাঙাপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।
আহত হলেন কোন অপারেশনে? প্রশ্ন শুনে লোকমান খানিকটা আনমনা হয়ে যান। অতঃপর ধীরে ধীরে বলতে থাকেন। তার ভাষায়:
‘‘অক্টোবর মাস শেষ। যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। এখন আর গেরিলা আক্রমণ নয়। ফ্রন্ট ফাইটে যেতে হবে। প্রথম প্রথম কিছুটা ভয় পেতাম। মায়ের কথা খুব মনে পড়ত। বোনদের কথা মনে হলে বুকটা হু হু করে উঠত।
মোহনপুর ত্রিশুলায় ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ক্যাম্প। আঙ্গিনাবাদে বসে পরিকল্পনা হয় ওই ক্যাম্প আক্রমণের। ৬ নভেম্বর ১৯৭১। বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা বনতারা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ি। ঢালাপুকুর পাড় হয়ে অবস্থান নিই কামদেবপুর ক্যাম্পে।
ইন্ডিয়ান আর্মিসহ আমরা ২০০ জনের উপরে। কমান্ডে ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাপ্টেন এসএস বাট ও ক্যাপ্টেন রনজিৎ সিং। রাত তখন তিনটা। পরিকল্পনামতো ভারতের ফকিরগঞ্জ থেকে ত্রিশুলার দিকে আর্টিলারি সেল চালানো হল।
সে সুযোগে আমরা সামনে এগোই। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। খানরা আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোঁড়ে। আমরাও পাল্টা গুলি চালাই। আমাদের পেছনে ইন্ডিয়ান আর্মি। গুলি ছুঁড়ে খানরা চিৎকার দিয়ে বলে ‘ইয়া আলী’। কণ্ঠ আকাশে তুলে আমরাও বলি ‘জয় বাংলা’।
পেছন থেকে ইন্ডিয়ান আর্মিরা আমাদের সাহস দেয়, ‘আগে বাড়, আগে বাড়, ডরনে কি কোই বাত নেহি।’ আমার পাশেই ছিল প্রফুল্ল। হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগে তার বুকে। সে ছিটকে পড়ে। খুব কাছ থেকে দেখি তার মৃত্যুযন্ত্রণা। বুকের ভেতরটা ধুকধুক করছিল। তখনও জানি না কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!
আমাদের চর্তুমুখী আক্রমণের মুখে টিকতে পারে না খানরা। ভোরের দিকে আমরা তাদের ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিই। সেখান থেকে উদ্ধার করি কয়েকজন যুবতীকে। তাদের শরীর ছিল ক্ষত-বিক্ষত। ক্যাম্প দখলের পরই খবর আসে পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণের।
আমরা সর্তক হওয়ার আগেই শত শত আর্টিলারি সেল এসে পড়ে ক্যাম্পের ভেতর। চু..চু.. শব্দে স্প্রিন্টার ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মাটিতে শুয়ে আমরা নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করি। কিন্তু তার আগেই একটি স্প্রিন্টার এসে লাগে আমার পায়ে।
প্রথমে টের পাইনি। পাশেই ছিলেন লিডার মোকসেদুর রহমান। তিনি বলাতেই চোখ পড়ে ডান পায়ের গোড়ালির দিকে। টপ টপ করে তখন রক্ত পড়ছিল। ঝিমঝিম করছিল সারা শরীর। অল্প সময়ের মধ্যেই পাটা অবশ হয়ে যায়। আমার চিকিৎসা চলে বালুবাড়ি ক্যাম্পে। আটদিন পর আবার ফিরে আসি যুদ্ধে। ১৩ জন ভারতীয় সেনাও ওই অপারেশনে শহীদ হয়েছিলেন।’’
স্মৃতি হাতড়ে লোকমান বলেন আরেকটি অপারেশনের কথা। তার ভাষায়, ‘‘জয়দেবপুর লাঠুয়াপাড়ায় ছিলাম আমরা ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। আমি প্লাটুন কমান্ডার। মোকসেদুর রহমান কমান্ডার। আবদুল লতিফ মিয়া নামে একজনের বাড়ি ছিল মুরাদপুর দামপুকুরে। সে ছিল শান্তি কমিটির সদস্য। সবাই জানত সে খানদের সহযোগী। কিন্তু আসলে সে ছিল আমাদের লোক।
খানদের সে নিজ বাড়িতে দাওয়াত করবে আর আমরা আক্রমণ করব তাদের ওপর। এমন পরিকল্পনা হলে, এক দুপুরে আমরা মুরাদপুর ডাঙাপাড়া হাইস্কুলের কাছে অ্যাম্বুস করে পজিশন নিয়ে থাকি। সময়টা ধানকাটার। আমরা নানা বেশ ধরে বসে রইলাম। খানরা মাঝে মাধ্যেই উপরের দিকে গুলি ছুঁড়ে আসতে থাকল।
আমাদের টার্গেটের ভেতর পৌঁছাতেই সবাই একসঙ্গে ট্রিগার চাপলাম। অমনি মারা পড়ল ৫-৬ জন। বাকিরা পালিয়ে গেল বটে, কিন্তু খানিক পরেই ফিরে এল আরও সেনা নিয়ে। আমরা তখন অবস্থান নিই পাশের জঙ্গলে। আমাদের খোঁজে তারা ডাঙাপাড়া ঘিরে বাড়ি বাড়িতে আগুন দিতে থাকল।
পরের দিনটিই ছিল ১৬ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীনের খবর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। যুদ্ধ করতে করতে এভাবেই আমরা পেলাম স্বাধীনতার স্বাদ। সেটা ছিল এক অন্যরকম অনুভূতি।’’
মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের ভূমিকার কথা উঠতেই লোকমান বলেন নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা। ‘‘রাজাকাররা একবার আমার বাবা ও চাচাতো ভাইকে ধরে নিয়ে যায় খলশিদীঘি আর্মি ক্যাম্পে। আমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে তাদের ওপর চলে শারীরিক নির্যাতন। কোমলপুর এলাকায় মাঈনুদ্দিন মৌলভি, উলিপুরে হবিবুল্লাহ মওলানা, উতরাইলে গফুরখান, দারাইলে মনসুর হারিয়া ছিল নামকরা রাজাকার। তারা খানদের বিভিন্ন বাড়ি চিনিয়ে দিত। যুবতীদের তুলে নিয়ে যেত আর্মি ক্যাম্পে। আর হিন্দুদের ধন-সম্পদ লুট করত। লোকমুখে আমরা এসব খবর পেতাম।’
কথা উঠে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারদের বিচার নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা লোকমান বলেন, ‘‘বিচার তো আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। স্বাধীনের পর যেমন আনন্দ হয়েছিল এবার রাজাকারদের বিচারের রায় শুনে তার চেয়ে বেশি আনন্দ লেগেছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এদের সঙ্গে কারও কারও রাজনৈতিক সন্ধি থাকলেও মনে মনে সকলেই চায় এদের বিচার হোক। বিচারপ্রক্রিয়া যেহেতু শুরু হয়েছে তাই এদের শাস্তি হবেই।’’
বিয়াল্লিশ বছর পরেও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে লোকমান খানিকটা নিরব থাকেন। অতঃপর বলেন, ‘‘যারা যুদ্ধে গিয়েছিল তাদের সবার তালিকা ছিল ক্যাম্পে ক্যাম্পে। তাই স্বাধীনের পরই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার উপযুক্ত সময়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারা যাচ্ছে সে হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমার কথা। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। বরং এখন তো কাগজ নিয়ে এসে সবাই কাগুজে মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক কারণেই এ কাগুজে তালিকা বাড়ছে।’’
বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে এ মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন, ‘‘ছোট ছোট অপরাধের যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করাটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দয়াবান। তাই ছোট ছোট অপরাধী বা যারা বাধ্য হয়ে শান্তি কমিটিতে নাম লিখিয়েছিল তাদের ক্ষমা করেছেন। কিন্তু সে তালিকায় তো ছিল না বড় কোনো রাজাকারদের নাম।’’
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর নাম তখন বলাই যেত না! তার ছবি লুকিয়ে দেখতে হত। বঙ্গবন্ধুর জন্য মন কাঁদত, কিন্তু কেউ তা প্রকাশ করতে পারত না। সবাই ছিল ভয়ে তটস্থ। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তার হাত ধরেই রাজাকাররা এদেশের রাজনীতিতে আসে। পরবর্তীতে তার দলের মাধ্যমেই মুজাহিদ ও মতিউর রহমান মন্ত্রী হন। রাজাকারদের গাড়িতে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা। জাতির জন্য এটি ছিল লজ্জাজনক অধ্যায়।’’
আপনি কি স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলেন?
মুক্তিযোদ্ধা লোকমানের উত্তর, ‘‘না, সেটার কেনো প্রয়োজনই ছিল না। আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা।’’
স্বাধীন দেশে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাইলে লোকমান বলেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে যখন তরুণরা একত্রিত হয়েছে, তখন বুকটা ভরে গেছে। এটা তো করার কথা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। সেটি করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। ফলে নতুন প্রজন্ম নতুন করে দেশের ইতিহাস জানতে পারছে।’’
খারাপ লাগার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দেশের স্বার্থে খোলা মন নিয়ে যখন রাজনীতিবিদরা এক টেবিলে বসতে পারেন না, দেশের চেয়েও যখন বড় হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিস্বার্থ– তখন সত্যি খুব কষ্ট লাগে।’’
আলাপচারিতার শেষে বুকভরা আশা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম বলেন, ‘‘এ দেশটা এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। তাই তোমরা বিভ্রান্ত হয়ো না। পূর্বসূরীদের ত্যাগের ইতিহাসগুলো জান। নিজের দেশের ইতিহাস না জানলে দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে না। তোমরা দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেও। মনে রেখ, দেশকে পেছনে ফেলে তুমি কখনও-ই এগিয়ে যেতে পারবে না।”
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছেবিডিনিউজ২৪.কমে, অক্টোবর ১৪, ২০১৩ এ
© 2013 – 2021, https:.