মাইন্ড ট্রেনিংয়েই সাফল্য !
সৈয়দ হারুন
আপনি কে? একজন মানুষ। এই পৃথিবীতে আপনার দায়িত্ব কি, আপনি তা কিভাবে সে দায়িত্ব পালন করবেন? দায়িত্ব পালনের জন্য সব উপাদান কি আপনার আছে ? আছে একটি দেহ আর তার সঙ্গে একটি মন। এই দুই উপাদান নিয়েই একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। একটিতে যদি কোন ঘাটতি থাকে তখন আপনি কি নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবী করতে পারেন ? নিশ্চয় না।
আপনি যে শারীরিক কাজটি করছেন, সেটি আপনার দেহ দিয়েই। আপনার হাত, পা, চোখ, কান সহ দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই সেই কাজ আপনার পক্ষে করে দেয়। অপরদিকে সমস্ত কাজ এবং দেহকে নিয়ন্ত্রণ করছে মন। কিন্তু এই মনের শক্তি সম্পর্কে কি সবাই অবগত?
সঠিক মনোযোগ স্থাপন না করেত পারলে কি কাজের উৎকর্ষ সাধন সম্ভব? শক্তিকে ব্যবহার করে কোন কাজ করা কি সম্ভব? মনের কতটুকু শক্তিকে কাজের সঙ্গে যোগ করা যায়?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে, প্রথমেই চিনতে হবে মনকে। জানতে হবে মনের শক্তি সম্পর্কে। কোথায় তার বাস, আর রপ্ত করতে হবে মনের সেই শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর কৌশল। এ প্রয়োজন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মাইন্ড ট্রেনিং, ধ্যান বা মেডিটেশনের।
দীর্ঘদিনের সাধনায় মাইন্ড ট্রেনিংয়ের পদ্ধতি নিজেরাই নিজেদের মত করে রপ্ত করে নিয়েছেন সাধু সন্ন্যাসীরা। আত্ম-সম্মোহন জাতীয় পদ্ধতিতে শারীরিক ও মানসিক রিল্যাক্সজেশন আয়ত্ব করছেন তারা, সেই সাথে মনের চোখে পরিষ্কার ছবি ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা অর্থাৎ নিজের মধ্যে কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
ফলে তারা তাদের আয়ত্বে আনা এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এমন কিছু করে ফেলছেন যা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য কিংবা অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হচ্ছে। যদিও তারা এটাকে সবার জন্য করতে পারেন নি। এটা ছিল ব্যক্তি কেন্দ্রিক সাধনা।
কিন্তু তাই বলে কি সবার সাধু সন্ন্যাসী হতে হবে! নির্জন জায়গা বেছে ধ্যান করতে হবে? মোটেই না। মাত্র কয়েক মিনিটের নিয়মিত মাইন্ড ট্রেনিংয়ের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এই নতুন জ্ঞান এবং দক্ষতাকে যে কেউ নিজের আয়ত্তে আনতে পারে।
প্রতিটি মানুষের অগ্রগতি, মানসিক শক্তি, ব্যক্তিগত অর্জন, লেখাপড়া, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং নিজের কাজে আকাঙ্খিত ফল লাভের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যাবে। যে কোন ধর্মের মানুষ, বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী, সবাই মাইন্ড ট্রেনিং চর্চা করতে পারেন।
মাইন্ড ট্রেনিং বা মেডিটেশন কী ? মেডিটেশন একটি মানসিক টেকনিক যার মাধ্যমে অশান্তি ও অস্থির মনকে প্রশান্তিতে ভরপুর করে দিতে পারে। মনকে যাবতীয় উদ্বেগ উৎকন্ঠা থেকে মুক্ত করা যায়। এটি একটি নির্দিষ্ট চিন্তা-ধারা যা মনকে বিক্ষিপ্ত চিন্তা ভাবনা থেকে দূরে রাখে। এটি মনের প্রশান্তি, স্বকীয়তা অর্জন করার পথ দেখায় এবং মনকে সত্য এবং পরম সুখের দিকে ধাবিত করে।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করেছেন এসব প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু এর কোন সঠিক জবাব কোনদিনই পাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে বিজ্ঞানীদের এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আকাঙ্ক্ষা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ মন কখনো ফিজিক্যাল ডাইমেনশনে থাকে না। এটা কোন বস্তু নয়। নন ফিজিক্যাল জিনিসের উপর কখনো ফিজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট চলে না। তাই মন নিয়ে বিজ্ঞানীদের ফিজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট বার বার ব্যর্থ হয়েছে।
উনিশ শতক অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নতুন করে মন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন জার্মান বিজ্ঞানী হ্যান্স বার্গার। উনি একটি বিষয় উপলব্ধি করেন, মন যেখানেই থাকুক, তার রঙ কিংবা আকার যেমনি হোক না কেন, মানুষের ব্রেইনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা নিবিড়।
কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি মনকে পাবার জন্য তিনি ব্রেইনকে নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ১৯২০ সালে তিনি আবিষ্কার করেন, প্রতি মিনিটে হৃদপিন্ডের যেমন একটি রিদম আছে, তেমনি ব্রেইনের এক রকম রিদম আছে এবং সেটা প্রতি সেকেন্ডে। মানুষের বিভিন্ন মুডে তা উঠানামা করে থাকে । মানুষ যখন শান্ত এবং স্থির থাকে তখন তার ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি কমে যায়, আর যখন রেগে থাকে বা উত্তেজিত থাকে তখন ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি বেড়ে যায়। ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি কম এবং স্থির থাকলে অসুস্থ মানুষ খুব দ্রুত সুস্থ হতে পারে।
এই ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সিকে বিজ্ঞানীরা মাত্রাভেদে চারটা ভাগে ভাগ করে নাম দিয়েছেন বিটা, আলফা, থিটা ও ডেলটা । যারা ইলেকট্রনিক্স সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা জানেন, সবচেয়ে ভালো সার্কিট সেটাই যার প্রতিরোধ ক্ষমতা সবচেয়ে কম। কারণ এই সার্কিটই নিজের বৈদ্যুতিক শক্তিকে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাতে পারে। মস্তিষ্কের ব্যাপারেও কথাটা সত্য। ব্রেইন যখন সবচেয়ে কম তৎপর থাকে তখন তার ক্ষমতা থাকে সবচেয়ে বেশি। কম ফ্রিকোয়েন্সিতে অনেক বেশি তথ্য সংগ্রহ ও জমা রাখতে পারে ব্রেইন।
মূলত মেডিটিশন চর্চার ফলে মানুষ তার ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সিকে ইচ্ছেমত বিটা লেভেল থেকে আলফা, থিটা ও ডেলটা লেভেলে ওঠানামা করতে শিখে। ফলে মিলে মনের অসীম ক্ষমতা। সেই অসীম ক্ষমতায় উপনীত হয়ে মানুষ খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। মেডিটেশন দুই প্রকার। ডাইনামিক ও প্যাসিভ। যারা প্যাসিভ মেডিটেশন করেন তাদের জাগতিক কোন চাহিদা থাকে না।পৃথিবীর সকল লোভ লালসা , মোহ, কামনা বাসনা ইত্যাদি ত্যাগ করে তারা শুধু সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যের জন্য ধ্যান করেন। আর ডাইনামিক মেডিটেশন তাদের জন্য, যারা ধ্যান বা মেডিটেশনের মাধ্যমে জাগতিক সাফল্য অর্জন করতে চান। পৃথিবীতে মেডিটেশনের নানা পদ্ধতি চালু রয়েছে। তার মধ্যে অর্ধ শতাব্দী ধরে গবেষণা করে সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে তৈরিকৃত হোঁজে সিলভার আলট্রামাইন্ড ইএসপি সিস্টেমটি আধুনিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ও স্বীকৃত। যা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই চর্চা করা হয়ে থাকে। তবে খেয়াল রাখা বিশেষ প্রয়োজন মেডিটেশন শিখতে গিয়ে কেউ যেন হিপনোটিজমের স্বীকার বা প্রভাবিত না হন।
নিয়মিত মেডিটেশন চর্চায় আপনার আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, স্বভাব চরিত্র মনের অবস্থান এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রভাব নিজের চিন্তা ভাবনার প্রভাব বিস্তার করে। ফলে ধৈর্য, সহনশিলতা, মনের প্রশান্তি, আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলাবোধ প্রভৃতির উন্নতি হয়। অপর দিকে হিপনোটিজমে আপনি অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হন। যেটা কোন ক্রমেই আপনার কাম্য হতে পারে না।
দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে, সংসার ধর্ম পালন করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেও মেডিটেশন বা মাইন্ড ট্রেনিংয়ের চর্চা করা যায়। এ জন্য নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের অনুসারী বা মতালম্বিও হতে হবে না, বিশেষ কোনো পোষাক বা নির্দিষ্ট জীবনধারারও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ই এটি চর্চা করা যায়।
জীবনের ফল পেতে চাইলে, নিজের কাজের সাফল্য অর্জন করতে হলে, মনের মত জীবন যাপন করতে চাইলে, মনের শক্তিকে কাজে লাগানোর টেকনিক তথা মাইন্ড ট্রেনিং বা মেডিটেশন শিখে নিন কোন একটি স্বীকৃত ও আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে। জীবনকে সাজিয়ে তোলা সম্ভব সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিতভাবে।
সৈয়দ হারুন : কান্ট্রি ডাইরেক্টর, সিলভা আল্ট্রামাইন্ড ইএসপি সিসটেম
ছবি : এমকিউ মিশন
অনুলিখন : নুরুল আমিন
silvabangladesh@yahoo.com
তথ্যসূত্র : বাংলানিউজ২৪.কম, ১০ অক্টোবর ২০১৩
© 2013 – 2018, https:.