আদিবাসী মিথ: উৎসব ও আনন্দে
মাঘ মাস। শীতে কাঁপছে গোটা দেশ। বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ হবে আজ। দেশের আনাচে-কানাচে এ নিয়ে চলছে তুমূল আলোড়ন, চলছে গ্রহণ দেখার নানা আয়োজন। এই আলোড়নের কারণও আছে। আজ থেকে আবার ১০৫ বছর পরে এ দেশ থেকে দেখা যাবে এরকম সূর্যগ্রহণ। তাই গ্রহণ দেখাটা রূপ নিয়েছে রীতিমতো উৎসবের।
কিন্তু দিনাজপুর শহরে নেমেই থমকে গেলাম রীতিমতো। কোথায় গেল সেই উৎসবমুখর মানুষেরা? সূর্যগ্রহণ নিয়ে কি এদের আগ্রহ নেই কোনো? নাকি শীতের ভয়েই ঘরের ভেতর পালিয়ে আছে সবাই?
কুয়াশার ভারী পর্দার নিচে জড়সড় গোটা জেলা। শহরবাসীর শরীরে শীত পোশাকের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। সোয়েটার, মাফলার আর নাক অবধি মাঙ্কি ক্যাপে বদলে যাওয়া মানুষটাকে চিনতে চোখ দুটোই শেষ ভরসা। বাস থেকে নেমে সেভাবেই চোখের ইশারায় চিনে নিলাম শামীমকে। জেলার প্রতিভাবান সংস্কৃতি কর্মী সে।
স্টার্ট দিতেই ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলল শামীমের মটরসাইকেল। শহরটা পেছনে ফেলে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পুর্ণভবা ব্রিজ পেরিয়ে সোজা দক্ষিণমুখো বিরলের পথ ধরি। পশ্চিমা বাতাসের ঝাপটায় হিম হয়ে আছে চারপাশের গ্রামগুলো। নানা দৃশ্য দেখতে দেখতেই রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলছি। যতই এগোচ্ছে আমাদের মটরসাইকেল, রাস্তায় জনমানব ততই কমে যাচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই গন্তব্যে।
জায়গার নাম বহবলদিঘি। যখন পৌঁছালাম, মাথার ওপর মধ্যদুপুরের সূর্য। এক পাশে সীমান্ত অবধি গহিন শালবন, অন্য পাশে আদিবাসীদের গ্রাম। সেখানেই পাড়াভেদে বাস করে নানা ভাষাভাষীর আদি মানুষেরা।
চারপাশ থেকেই মাদল, ঢোল আর আদিবাসী ভাষায় চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছিল। আমরা ভাবছি কোনো পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলছে হয়তো। কিন্তু হালজার একটি পাড়ায় ঢুকতেই আমরা অবাক হয়ে গেলাম।
দিনাজপুরে আমরা একটু আগেই দেখে এসেছি সূর্যগ্রহণকে ঘিরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু এখানে ঠিক তার উল্টো। গোটা পাড়ার সকলেই ধুপ জ্বালিয়ে, মাদল-ঢোল বাজিয়ে, বাড়ির চালে পানি ছিটিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে,‘মামা, গাহানা ছাড়’!
জিজ্ঞেস করে জানলাম, ‘কড়া’ সম্প্রদায়ের লোক এরা। সূর্যগ্রহণ চলায় গোটা পাড়ার সকলেই উপোস। সেই উপোস অবস্থাতেই এই লোকাচার উৎসবে অংশ নেয়ার নিয়ম। গোত্রের প্রধানকে এরা বলে ‘মাহাতো’। এখানকার মাহাতোর নাম ‘জগেন কড়া’।
কড়া মানে কি? জগেন বলতে থাকেন, কড়া মানে ‘মাটি খোঁড়া’। একসময় এ আদিবাসী লোকেরা দিঘি খোঁড়ার কাজে যুক্ত ছিল। সে থেকেই এরা ‘কড়া’। ইংরেজ আমলে ভারতজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এ আদিবাসীরাও। আর সেই রেল লাইনের কাজ করতে করতেই ব্যাপক পরিমাণ আদিবাসীরা চলে আসে এ দেশে, বসতি গাড়ে। নিজেদের সংস্কৃতি ও আচারকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাই মিলে থাকতে শুরু করে একসাথেই।
জীবিকার তাগিদে দেশছাড়া সেই আদিবাসীরাই এদের পূর্বপুরুষ। নানা কারণে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এ জাতিটি। সারা দেশে এ জাতির মাত্র ১৯টি পরিবার টিকে আছে।
নানা বিশ্বাসের প্রভাবে এদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে নানা আচারের। তারই ধারাবাহিকতায় চলছে এই গ্রহণমুক্তির চেষ্টা। কেন এই সূর্যগ্রহণ হয় সে বিষয়ে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মতো কড়াদের রয়েছে আদি বিশ্বাস ও কাহিনী। ৯০ বছরের সেড়তি কড়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন সে কাহিনীটি।
‘মানব জাতি একবার খুবই অভাবের মধ্যে পড়ে। মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য চাই ধান। চন্দ্র এবং সূর্য মানুষের জন্য ধান দিতে অনুরোধ করে দোসাদ দেবতাকে। তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দোসাদ দেবতা ধান দেয় মানুষকে, তবে আবার ফেরত দিতে হবে এই শর্তে। কিন্তু সে বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মানবজাতি সে ধার আর পরিশোধ করতে পারে না। চন্দ্র ও সূর্য মানব জাতির পক্ষে সেই ধান ধার নিয়েছিল বলে দোসাদ দেবতা এখনো সুযোগ পেলেই চন্দ্র ও সূর্যকে আক্রমণ করে। এতে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ ঘটে।’ এ কারণেই কড়ারা মনে করে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় মানবজাতির দায়িত্ব তাঁদের বাঁচাতে ভগবানের সাহায্য প্রার্থনা করা।বেলা বাড়ছিল ক্রমশই। কথাও জমে উঠছিল বেলার সাথে সাথে। তাদের উৎসবের অংশ হিসেবেই এবার তাদের মধ্যে চলতে থাকে ধাঁধার খেলা। এক পাশ থেকে সেড়তি বলল, ‘দাশটা মারাত রাগদেলকে, দুটা মারত পাকারকে মারকে’।
এর উত্তর বলতে পারল না কেউ। সবাই চুপ।
কেউ না পারায় সেড়তির মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল। হাসতে হাসতেই উত্তর দিল সে,‘ঢিলা বাছা’।
মানে উকুন আনা– দুই হাতের দশ আঙুল থাকলেও উকুন মারা হয় দুই আঙুল দিয়ে।
এবার সুনিয়া বলল আরেকটি ধাঁধা, ‘ভুরুত পাংখি, একজন ডুবেলকে দুজন সাক্ষী’।
দলের মাহাতো বলল, এটি হচ্ছে সেচ দেয়ার জন্য টিনজাতীয় বালতি বিশেষের দুই দিকে দড়ি বেঁধে দুইজন টেনে ধরা।
এরকমভাবে চলতেই থাকল উৎসবের একের পর এক লোকাচার।
এরই মধ্যে আমরা কড়া পাড়া থেকে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম গিরিডোবার ওঁরাও পাড়ায়। ভাঙাচোরা রাস্তার দুদিকে সারি সারি তুঁতগাছ। পথেই দেখা মিলল নিপেন টিগ্গার। নিপেন টিগ্গা এই ওঁরাও পাড়ারই একজন। পরিবারের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে, চিকিৎসা সহায়তা পেতে আর বিনামূল্যে বাচ্চার শিক্ষা প্রাপ্তির প্রলোভনে এখানকার কয়েকটি পরিবার খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও অধিকাংশই পালন করছে তাদের পূর্বপুরুষদের আদি ধর্ম।
চন্দ্র ও সূর্য ওঁরাওদের দেবতা। ওঁরাও ভাষায় বিড়ি নাদ ও চান্দু নাদ। চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি নিয়ে এদের বিশ্বাসে আছে প্রাচীন এক কাহিনী। আধো কুরুক ও আধো বাংলায় নিপেন বলতে শুরু করলেন কাহিনীটি:
‘ধরমেশ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করল তখন আকাশ ও মাটি ছিল খুবই কাছাকাছি। মানুষ চলাফেরা করার সময়ই আকাশ মাথায় ঠেকত। একবার মানুষের কোনো এক অপরাধে আকাশ উপরে উঠে গেল। এতে চলাফেরায় মানুষের সুবিধা হলেও সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
বনের মধ্যে ছিল এক মহুয়া গাছ। সে গাছে ফুল যতক্ষণ ফুটে থাকত ততক্ষণ পৃথিবী আলোকিত থাকত। আর যখন ফুল শুকিয়ে যেত তখন আবার অন্ধকার নেমে আসত।
সবাই ভাবল, গাছটিই অন্ধকারের মূল কারণ। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, গাছটিকে কেটে ফেলে আলো উদ্ধারের। গাছটিকে কাটা হলো। কিন্তু তারপরও সেটি মাটিতে পড়ছে না। দৈববাণীর মাধ্যমে জানা গেল, গাছটিতে রয়েছে চিলের বাসা। চিলটিকে না মারলে গাছটি মাটিতে পড়বে না। তাই হলো। চিলটিকে মারার পরপরই গাছটি মাটিতে পড়ে গেল। পড়ার শব্দে কেঁপে উঠল গোটা পৃথিবী ।
সে দেশের রাজা ভাবল,শত্রুরা তার রাজ্য আক্রমণ করেছে। তিনি সৈন্য নিয়ে এসে দেখলেন মহুয়া গাছটি কাটা। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে শাস্তির হুকুম দিলেন। উভয় পক্ষের সাথে চলল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। রাজার সৈন্য পরাজিত হলো।
অতঃপর গাছটিকে দুই ভাগ করে কাটা হলো। দেখা গেল নিচের দিকের বড় অংশটিতে সূর্য আর উপরের দিকের ছোট অংশটিতে চন্দ্র।
কিন্তু তাদের জীবন দান হবে কীভাবে?আবারও দৈববাণী এল। এক চাষির আদরের পুত্রকে চুরি করে এনে হত্যা করে তার রক্ত ঢেলে দেয়া হলো গাছের কাটা অংশে। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র ও সূর্য জীবিত হয়ে আকাশে উঠে গেল।’
সে সময় থেকেই ওঁরাওরা মনে করে সূর্য পুরুষ এবং সে বেশি রক্ত পান করেছিল বলে তেজী ও লাল। একইভাবে চন্দ্র নারী এবং সে কম রক্ত পান করেছিল বলে স্নিগ্ধ ও সাদা।
ওরাও গ্রামের পাশেই নিপেন দেখিয়ে দিলেন সাঁওতাল পাড়াটি। সাঁওতালরা নিজেদের ‘সানতাল’ বলতেই অধিক পছন্দ করে। নিজেদের মধ্যে এরা একে অপরকে ডাকে ‘হর’ বলে। ‘হর’ অর্থ ‘মানুষ’। এদের আদি দেবতা সূর্য। সাঁওতালি ভাষায় ‘সিং বোঙ্গা’। সূর্য পূর্বদিকে উঠে বলেই পূর্বদিক সাঁওতালদের কাছে পবিত্র। তাই পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরা পূর্বদিকে মুখ করে বসে। এছাড়া নানা পূজা-পার্বণেও এরা তীর-ধনুককে ব্যবহার করছে পূর্বপুরুষদের আমল থেকে। শিকারসহ তীরধনুকের ব্যবহার নিয়ে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী। গোত্রের ষাটোর্ধ্ব রাগদা হেমব্রন গল্পের ছলে বলতে থাকেন কাহিনীটি:
‘সাঁওতাল রাজা তখভনের রানীর এক গোপন প্রেমিক ছিল। প্রেমিকটি বনের মধ্যে সর্পরাজের বেশ ধরে থাকত। রাজা যখন শিকারে যেতেন রানী তখন তাকে জঙ্গলের বিশেষ একটি দিকে যেতে নিষেধ করতেন।
একবার শিকার করতে গিয়ে কৌতূহলবশত রাজা ওই বিশেষ দিকে যান এবং সর্পরাজকে দেখতে পান। নিজের প্রাণ রক্ষার্থে তীর দিয়ে রাজা হিংস্র সর্পরাজকে মেরে ফেলেন।
শিকার থেকে ফিরে রাজা ঘটনাটি রানীকে খুলে বলেন। সর্পরাজের মৃত্যুর কথা শুনে রানী ভেতরে ভেতরে বেশ ব্যথিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। তিনি রাতের আঁধারে জঙ্গলে গিয়ে সেখান থেকে সর্পরাজের হাড়গোড় কুড়িয়ে এনে বাগানে পুঁতে রাখেন। কিছুদিন পর ওই জায়গা থেকে একটি গাছ এবং ওই গাছে একটি আধফোটা ফুল সারা বাগানকে আলোকিত করে তোলে।
প্রতিহিংসাপরায়ণ রাণী কৌশলে রাজার সঙ্গে মেতে ওঠে সর্বনাশা বাজির খেলায়। রাজা যদি বাগানের সব ফুলের নাম বলতে না পারেন তবে রানীর হুকুমে প্রজারা রাজার প্রাণদণ্ড দেবে। নিজের বাগানের ফুলের নাম বলাটা খুবই সহজ ভেবে আত্মবিশ্বাসী রাজা রাজি হলেন।
অতঃপর গ্রামে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে এ খবর সর্বত্র জানিয়ে দেয়া হলো। রাজা একে একে সব ফুলের নাম বলতে পারলেন কিন্তু অদ্ভুত আধফোটা ফুলটির কাছে এসে রাজা আটকে গেলেন। সে সময় রাজার পক্ষে প্রজারা রানীর কাছ থেকে আরো সাত দিন সময় চেয়ে নেয়।খবর পেয়ে রাজাকে বাঁচাতে অন্য রাজ্য থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হয় রাজার এক বোন। হাঁটতে হাঁটতে ষষ্ঠ রাতে সে বিশ্রাম নিচ্ছিল বনের ভেতর একটি শিমুল গাছের তলায়। হঠাৎ গভীর রাতে বোনটি শুনতে পায় গাছের মগডালে এক শকুনি তার ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে যে, পরদিনই সে বাচ্চাদের জন্য রাজার দেহের মাংস তাদের খাওয়াবে। উৎসুক বাচ্চারা কীভাবে তা সম্ভব, মায়ের কাছে জানতে চাইলে গল্পচ্ছলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সমস্ত ঘটনা এবং ফুলের নাম ও জন্মবৃত্তান্ত সে খুলে বলল। গাছের নিচে বসে রাজার বোনটি সব কথা শুনে ফেলল।
ভোরের মধ্যেই বোনটি রাজার কাছে পৌঁছে ফুলের নামসহ সমস্ত ঘটনাটি বলল। সাত দিনের দিন রাজা, প্রজা ও রানীর সম্মুখে বললেন, ফুলের নাম হলো,‘কারি নাগিন হাড় বাহা’ আর তখনই ফুলটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত হলো। রাজা প্রাণদণ্ড থেকে মুক্তি পেলেন।
কিন্তু ক্ষুব্ধ প্রজারা প্রতিহিংসাপরায়ণ রানীকে তীর মেরে ঝাঁঝরা করে দিল এবং তাতেও তাদের ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় লাঠির আঘাতে রানীর মাথা গুঁড়িয়ে দিল।’
আর সে থেকেই কলাগাছে তীর বিদ্ধ করা ও লাঠি দিয়ে হাঁড়ি ভাঙাকে সাঁওতালরা অশুভ শক্তির প্রতীকী বিনাশ বলে মনে করে।
যখন ফিরছি তখন চারদিক নিস্তব্ধ, অন্ধকার । আকাশে অজস্র তারা। হঠাৎ থমকে গেলাম। চোখের সামনেই আকাশের একটি তারা খসে পড়ে। আবার তা নিমিষেই হারিয়ে যায়। দূরে কোনো একটি গ্রাম থেকে ভেসে আসে আদিবাসী গানের সূর: ‘হে ভগবান, পতিসে পাবনে সিতারাম, জেয় ভগবান’।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, ঈদ সংখ্যায়
© 2013 – 2018, https:.