মুক্তিযুদ্ধ

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না

নাম তার জয়নাল আবেদীন বাদশা। সবাই ডাকে বাদশা বলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি একটু মুডি। দেখতে সুদর্শন। কথাবার্তা বলেন কম। পরিবারের বাইরে তেমন মিশেন না। ফলে চাচাতো-ফুপাতো ভাইরাই তার খেলার সাথী। তিন ভাই, এক বোন নিয়ে সংসার। সবার বড় বাদশা। অবসর কাটান বাল্যবন্ধু জামাল ও আশরাফের সঙ্গে। ফুটবল খেলা আর হুইল ছিপ দিয়ে মাছ ধরাতেই তার বেশি আনন্দ।

অভিজাত পরিবারের ছেলে, তেমনটাই ভাব তার। ছিলেনও তাই। মা জরিনা বেগম সাধারণ গৃহিণী হলেও বাদশার বাবা আতাউর রহমান ছিলেন শিক্ষক। নওগাঁ সদরের চকগরীব স্কুলে পড়াতেন তিনি। দাদা খোদাবক্স সরদারের নামডাক ছিল বেশি। সহায়-সম্পত্তিতে তার কমতি ছিল না। ফলে দশগ্রামের সকলেই তাকে এক নামে চিনত।
সময়টা ১৯৬৩। বাদশা তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তার বাবা। বাদশাদের তখন ঠাঁই হয় দাদাবাড়িতে। দাদা খোদাবক্স সরদারই ছিলেন তার একমাত্র অভিভাবক। ফলে অর্থ ও প্রভাব দুটিই ছিল আকাশচুম্বী। ওই বয়সেই বাদশা সিগারেট খেতেন। যেনতেন ব্র্যান্ড তিনি হাতে নিতেন না! ধোয়া তুলতেন পাকিস্তানি ‘উইলস নেভিগার্ড’ সিগারেটে। দাম ছিল ৯ আনা। ওই সময় চালের দামই ছিল প্রতি সের ১২ থেকে ১৪ আনা। দাদার আদর আর স্নেহে এভাবেই বড় হতে থাকেন বাদশা।
সময় গড়িয়ে আসে ১৯৭১। দেশের অবস্থা তখন অন্যরকম। কাগজ তৈরি হত পূর্ব পাকিস্তানেই। অথচ তা কিনতে হত ৬ টাকা দিস্তায়। চিনির নাম ছিল আরও বেশি। বৈষম্যের এমন খবরগুলো বাদশা জানতেন ইত্তেফাক আর দৈনিক বাংলার খবর পড়ে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার মনের কুটিরে। মানুষকে কাছে টানতে তাঁর ভাষণই ছিল যথেষ্ট। একবার তিনি আসেন নওগাঁয়। ভাষণ দেন জলিল সাহেবের বাড়ির সামনের মাঠে। ৭ মার্চ ১৯৭১। বাদশা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘‘আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবা না…।’’ কথাগুলো বাদশার মনে দাগ কেটে যায়। তখন তার মনে একটি চিন্তাই ঘুরপাক খেতে থাকে– ‘কিছু একটা করতে হবে’।

আঘাতের চিহ্ন দেখাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা বাদশ
আঘাতের চিহ্ন দেখাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা বাদশ

২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামে। হত্যাযজ্ঞ চলে জগন্নাথ হল ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। নওগাঁ তখনও শান্ত। ২২ এপ্রিল, শুক্রবার। সকালবেলা। মানুষের আর্তনাদে ঘুম ভাঙে বাদশার। দেখলেন, বাড়ি থেকে ২০০ গজ সামনে ধুয়া। রাস্তার উপর শুয়ে আছে শত শত লোক। এমন দৃশ্যে খানিকটা ভড়কে যান তিনি।
পাকিস্তানি আর্মিরা ওইদিন ক্যাম্প বসায় নওগাঁ সদরের সিও অফিসে। তারা জ্বালিয়ে দেয় আশপাশের গ্রামগুলো। রাজশাহী থেকে নওগাঁয় ঢোকে আর্মিদের আরও সাঁজোয়া গাড়ি। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। প্রাণ বাঁচাতে সবাই আশ্রয় খুঁজে নেয় সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। প্রথমে সালুকায় এবং পরে চাকলা বকতারপুর গ্রামে আশ্রয় মিলে বাদশাদের।
প্রায় প্রতিদিনই একেক গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি আর্মি। তাদের পথ চিনিয়ে সাহায্য করে শান্তি কমিটির লোকেরা। যুবক বয়সীরা ছিল টার্গেট। গুলি করে তাদের মেরে ফেলা হত। বাদশার বয়স তখন ষোল। দেশে থাকলে মরতে হবে। তাই জোট বাঁধেন বকতারপুর গ্রামের আনোয়ারুল, তারা ও লতিফের সঙ্গে। গোপনে পরিকল্পনা করেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। কাউকে না জানিয়ে এক সকালে তারা ঘর ছাড়েন। দেশের টানে গ্রামের সাধারণ যুবকদের হাত ধরেই পথে নামেন বাদশা।
শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জয়নাল আবেদীন বাদশার জীবনকথা। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার চকবাড়িয়া গ্রামে। লেখাপড়ায় তার হাতেখড়ি চকগরীবপুর প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি ভর্তি হন নওগাঁ ইউনাইটেড হাই স্কুলে।
মুক্তিযোদ্ধা বাদশার খোঁজটি আমরা পাই তারই এক সহযোদ্ধার কাছে। ঢাকার টিকাটুলিতে থাকেন তিনি। কে.এম দাস লেনে হরদেও গ্লাস ওয়ার্কসের একটি শ্রমিক কলোনিতে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নিজস্ব সম্পত্তি এটি। বস্তিসদৃশ এই কলোনির বেহাল দশা আমাদের আবেগতাড়িত করে। দেশের জন্য রক্ত দেওয়া এক মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা খুঁজে পাই এখানকারই ছোট্ট একটি ঝুপড়ি ঘরে।
কথথোপকথনের শুরুতেই সৌজন্যবশত আমরা প্রশ্ন করি, কেমন আছেন? উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘‘বিয়াল্লিশ বছর ধরে ডান পা ভাঁজ করতে পারি না। চলতে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পা ব্যথা করে সবসময়। প্রস্রাব-পায়খানা করতে সমস্যা হয়। তবু ভালো আছি। খারাপ আছি ভাবলে তো বেঁচে থাকতে পারতাম না।’’
বাদশার উত্তরটি আমাদের মনে নাড়া দেয়। আমরা খানিক নিরব থাকি। অতঃপর আবারও শুরু করি আলাপচারিতা।
কোথায় ট্রেনিং নিলেন ?
‘‘এপ্রিলের শেষদিকের কথা। বাড়ি থেকে ৭০ কিলোমিটার হেঁটে সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছি ভারতের বালুরঘাটে। আমাদের পথ দেখিয়ে নেয় স্থানীয় একজন গাইডার। ওখানেই ছিল মধুপুর ইয়ুথ ক্যাম্পটি। সেখানে দেখা হয় আমাদের স্কুলের শিক্ষক তৌফিক ও রহিম স্যারের সঙ্গে। তাদের পরামর্শে যাই আব্দুল জলিল সাহেবের (প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা) কাছে।
তার সঙ্গে সেটিই আমার প্রথম সাক্ষাত। কিন্তু তার আন্তরিকতায় মনে হল যেন অনেক দিনের পরিচয়। আমার দিকে তিনি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুই তো যুদ্ধ করতে পারবি না। তুই ট্রেনিং নিয়ে কী করবি? ইয়ুথ ক্যাম্পে তুই থাকেক। সেখানে তোর স্যারেরা আছে। আমি তাদের বলে দেব। দেশ স্বাধীন হলে আমরা দুভাই বাড়ি চলে যাব।’ আমার প্রচণ্ড রাগ হল। বললাম, ‘তাহলে আমাদের আর থাকার দরকার নাই। আমরা ভেতরে যাই। আমাদের মাইরা ফালাক।’ আমার কথায় তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। অতঃপর একটা চিরকুট লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘ক্যাম্পে যা’।

মধুপুর ক্যাম্পে যেতেই আমাদের রিক্রুট করে নিল। রাত পোহাতেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রতিরামপুর ক্যাম্পে। সেখানে ৪-৫ দিন চলল লেফট-রাইট। অতঃপর আমাদের পাঠানো হয় শিলিগুড়ি পানিঘাটায়। আমরা ট্রেনিং নিই ২১ দিন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন কচ্চপ ছিলেন ক্যাম্পের দায়িত্বে। আমরা ছিলাম সি কোম্পানিতে। প্রশিক্ষক হায়দার আলীর মুখটি আজও মনে ভেসে ওঠে। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল ৫২৪৬।’’
ভারতীয় সেনাদের আন্তরিকতার কথা জানাতে তিনি শোনালেন একটি ঘটনা। তার ভাষায়, ‘‘প্রতি সন্ধ্যায় জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে আমাদের তাঁবুতে ফিরতে হত। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় চুল পরিমাণও নড়া যাবে না, এমনটাই ছিল নিয়ম। ওখানে একটু পরপরই বৃষ্টি হত। একদিন আমাদের ফলিং করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে। হঠাৎ শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আমরা জোরে দৌড় দিই।
বৃষ্টি থামতেই আবার আমাদের ডাকা হল। ভারতীয় আর্মির অফিসারা তখন প্রচণ্ড রেগে বললেন, ‘বৃষ্টির কারণে আপনারা তো দেশের জাতীয় সঙ্গীতের প্রতিই শ্রদ্ধা জানাতে পারেননি। আপানার কীভাবে দেশ স্বাধীন করবেন? বি কোম্পানি ছিল আমাদের পাশেই। ওরাও একই অপরাধ করেছিল। শাস্তি হিসেবে ওই রাতেই বৃষ্টির মধ্যে ওদের ক্রলিং করানো হল। আমাদের শাস্তি দেওয়া হয় পরদিন সকালে। পিটি করতে হয়েছিল কয়েক ঘণ্টা। আজও জাতীয় সঙ্গীত শুনলে শ্রদ্ধা জানাতে দাঁড়িয়ে যাই। মনে পড়ে যায় সে দিনটির কথা।’’
তিনি বলেন, ‘‘নয় মাসে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার মতো মুক্তিযোদ্ধা আমরা নই। ভারত সরকার যদি ট্রেনিং, অস্ত্র ও তাদের আর্মি পাঠিয়ে সাহায্য না করত তবে নয়শ বছরেও এ দেশ স্বাধীন হত না। মুক্তিযুদ্ধে তাদেরও বহু সৈন্য শহীদ হয়েছে। তাদের ঋণ আমরা কোনোদিনও শোধ করতে পারব না।’
ট্রেনিং শেষে কোথায় কোথায় যুদ্ধ করলেন ?
মুক্তিযোদ্ধা বাদশা উত্তরে বলেন, ‘‘অস্ত্র নিয়ে আমরা চলে আসি মধুপুর ক্যাম্পে। আজমলের গ্রুপে আমাদের মিক্সড করে পাঠানো হয় বগুড়ায়। আমরা ৮৫ জন গেরিলা। আজমল ছিলেন কমান্ডে। দিনের বেলায় বিচরণ করতাম না। রাতে চলত সব অপারেশন। ৭ নং সেক্টরের অধীনে আমরা যুদ্ধ করি বগুড়ার তিলকপুর, আক্কেলপুর ও আদমদিঘীতে।’’
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ভালবাসত। তারা আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে সাহায্য করত। তা না হলে আমরা সহজে জয়ী হতে পারতাম না।’’
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের ভূমিকা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বাদশা বলেন, ‘‘রাজাকাররা না থাকলে পাকিস্তানি সেনারা এত মানুষ হত্যা করতে পারত না। তাদের পথ চিনিয়ে, খাদ্য দিয়ে, তথ্য দিয়ে সাহায্য করত রাজাকারেরা। আবার এটা ঠিক, সে সময় কেউ কেউ জীবন বাঁচাতেও রাজাকারের তালিকায় নাম লিখায়। কিন্তু তারা মনেপ্রাণে ছিল আমাদের পক্ষে। গোপনে ওরা আমাদের নানা খবর দিয়ে সাহায্য করত।’’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া একটি গুলি বাদশার ডান পায়ের উরুর ভেতর দিয়ে ঢুকে হাড়ের কিছু অংশ গুঁড়ো করে দেয়। অপারেশনে তার ডান পা ছোট হয়ে যায়। তিনি পা ভাঁজ করতে পারেন না। চলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পায়ে ব্যথা হয় সবসময়।
সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। শুক্রবার। বেলা ১২টা। তিলকপুর থেকে রওনা হয়ে বিকেল ৪টায় আমরা আদমদিঘী পৌঁছি। পরিকল্পনা ছিল আদমদিঘী থানা উড়িয়ে দেওয়ার। পাকিস্তানি আর্মির একটি ক্যাম্প ছিল ওখানে। আমরা ৮৫ জন। কমান্ডে আজমল। ক্রলিং করে উত্তর-পশ্চিম দিকটা আমরা ঘিরে ফেলি। আমার কাছে একটি এলএমজি। হঠাৎ শুরু হয় গোলাগুলি। ডান পাশ থেকে আমি কাভারিং ফায়ার দিই। অন্যরা তখন পজিশন নেয়।
পাকিস্তানিদের কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র। তারা আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে। আমরা থেমে থেমে তার প্রত্যুত্তর দিই। আমাদের গোলাবারুদ তখন শেষের দিকে। গোলাগুলি হঠাৎ থেমে গেল। কমান্ডার বললেন, ‘উইড্রো’। আমি অবাক হলাম। দুই খেজুর গাছের মাঝে হাঁটুগাড়া অবস্থায় ছিল আমার পজিশন। পাশেই সহযোদ্ধা মুসলিম। গুলি কেন বন্ধ? সেও কিছু বলতে পারে না। আমি পেছন ফিরে অন্য সহযোদ্ধাদের দেখার চেষ্টা করি।

ঠিক সে সময়ই পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি আমার ডান পায়ের উরুতে এসে লাগে। প্রথম টেরই পাইনি। মনে হল উরুতে কী যেন কামড় দিচ্ছে। ভাবলাম জোঁকে ধরেছে। হাত দিতেই হাড়ের ভেতর আঙুল ঢুকে গেল। খানিকটা হাড়ের গুঁড়ো ও মজ্জা বেরিয়ে এল আঙুলে। আমার পা তখন কাঁপছে। পা’টা সোজা করতেই চামড়ার মাঝে ভাঁজ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে গেলাম।
শরীর তখন ঘামছে। পা’টা নাড়াতে পারছিলাম না। হাতে ভর দিয়ে আমি পেছনের দিকে যেতে থাকি। ধানক্ষেতের আইলের ওপর দিয়ে পা’টা টানতেই, খটাশ শব্দে বাড়ি লাগে। যন্ত্রণায় আমি তখন কাতরাচ্ছি। মনে হল মারা যাব। মায়ের কথা বারবার মনে হচ্ছিল। আমাকে দেখে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল আনোয়ারসহ দুজন। ওদের ঘাড়ে ভর দিয়ে আমি পেছনে সরে আসি।
মরা মানুষের খাটিয়া দিয়ে আমাকে নেওয়া হয় ঝালঘরিয়া গ্রামের আফজাল ডাক্তারের বাড়িতে। সেখানে চলে প্রাথমিক চিকিৎসা। ২৪ তারিখ উত্তরবঙ্গ স্বাধীন হলে আমি খাটিয়া দিয়েই বাড়ি ফিরি ২৭ তারিখ। আমার কষ্ট দেখে মা খুব কেঁদেছিলেন। প্রথমে নওগা সদর হাসপাতাল, পরে রাজশাহী এবং সবশেষে ঢাকা মেডিকেলে চলে আমার চিকিৎসা।’’
স্বাধীনতার পর কী করলেন ?
মুক্তিযোদ্ধা বাদশার উত্তর, ‘‘অনেক খুঁজেও কোনো চাকরি পাইনি। জমিগুলো বিক্রি করে জীবন চালাতাম। ১৯৭৭ সালের দিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাজ পাই কল্যাণ ট্রাস্টে।’’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে বাদশা বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের পরের দুই বছরের মধ্যেই এ তালিকা হওয়া উচিত ছিল। প্রত্যেক সেক্টরে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছিল। তালিকা এখন বাড়ছে রাজনীতিবিদ আর কিছু আদর্শহীন মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে।’’
যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের বিচার প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বাদশা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তার ভাষায়, ‘‘স্বাধীনতার পরই এদের বিচার করা উচিত ছিল। বুড়া বয়সে এদের ফাঁসি দিয়ে কী হবে! রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিচ্ছে, আমরা আনন্দের সঙ্গে জাতীয় দিবসগুলো পালন করছি, স্বাধীন দেশে আমরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি– রাজাকারদের বাঁচিয়ে রেখে তাদের চোখের সামনে এগুলোই দেখানো উচিত। তাদের উদ্দেশে বারবার বলা উচিত– তুই রাজাকার, তুই স্বাধীনতাবিরোধী, তুই হত্যাকারী, তুই লুণ্ঠনকারী। এই বয়সে এটাই হবে তাদের উপযুক্ত শাস্তি।’’
বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ওই সময় দেশের অবস্থা যা ছিল, তাতে যুদ্ধে ছোট ছোট অপরাধীদের ক্ষমা করাটা সঠিকই ছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নয়, সে সময় মূল সমস্যা তৈরি করেছিল পাকিস্তান সরকারের অনুগত কিছু আমলারা।’
তিনি বলেন, ‘‘ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না। ক্ষমতার জন্য জিয়াউর রহমান রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেছেন, তাদের রাজনীতি করার বৈধতা দিয়েছেন। তার দলের হাত ধরেই এদেশে রাস্ট্রপতি, মন্ত্রী হয়েছে রাজাকাররা। তাদের গাড়িতে উড়েছে লালসবুজ পতাকা। মুক্তিযোদ্ধা জিয়া স্বাধীনের পর হয়েছেন রাজাকারদের বন্ধু। এর চেয়ে দুঃখের আর কী আছে। যারা এ দেশ চায়নি, স্বাধীন দেশে তারা রাজনীতি করে কোন যোগ্যতায়!’’
মুক্তিযোদ্ধা বাদশা মনে করেন, দুর্নীতি না থাকলে দেশটা আরও এগিয়ে যেত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যখন মাঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গায়, খেলাধুলা করে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে তখন মন ভরে যায় এই মুক্তিযোদ্ধার।
স্বাধীন দেশে খারাপ-লাগার মতো কী আছে জানতে চাইলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। অতঃপর বললেন, ‘‘দুর্নীতি খেয়ে ফেলেছে দেশটাকে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করে তখন খারাপ লাগে। এসব করে কী হয়, কী হচ্ছে! রাজনীতিবিদরা নিজেদের মধ্যে দেশপ্রেম তৈরি করতে পারেননি। তাদের আছে শুধু টাকাপ্রেম। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। এখন ওই দলেও দেখি আদর্শবান, সৎ লোকের অভাব।’’
তবু পরবর্তী প্রজম্মের কথা উঠতেই আশায় বুক বাঁধেন মুক্তিযোদ্ধা বাদশা। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা হুজুগে বাঙালি হইও না। প্রকৃত সত্য খুঁজে নিও। মিলেমিশে থেকো। কাজের প্রতি সৎ থেক। মনে রেখ, দেশটা এগিয়ে যাবে সৎ লোকদের সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে, নভেম্ভর ৮, ২০১৩

© 2013 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button