আদিবাসী

ওরাওঁদের কথকতা

গন্তব্য দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী টিনপাড়া গ্রাম। এ গ্রামেই পাড়া করে বাস করে সনাতন ধর্মের ওরাওঁ আদিবাসীরা। আমরা যখন পৌঁছি তখন মধ্য বিকেল। গোটা গ্রামটিই প্রায় পুরুষ শুন্য। দিনটি ছিল বৃহস্পতি। এ দিন হাট বসে পাশ্ববর্তী বহবলদিঘীতে। আশপাশের আদিবাসীরা তখন নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে হাটে। তাই টিনপাড়া আজ পুরুষশুন্য।

গ্রামে ঢুকতেই দেখতে পেলাম এক বাড়ির উঠানের এক কোণে মাটি লেপা তুলসি তলা। সেখানে জল ছিটিয়ে গৃহঠাকুরকে ভক্তি করছেন এক বৃদ্ধ। নাম মুংলী তির্কী । বয়সের ছাপ তার চোখেমুখে। ভাজ পড়া চামড়ার পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। শুধু মুংলীর বাড়িতেই নয় সকালে সন্ধ্যায় এমন আচার চলে গোটা টিনপাড়ায়।
আমাদের বসার জায়গা হয় মুংলীর বাড়িতে। অপেক্ষার প্রহর কাটাতে তার সঙ্গে আলাপ জমাই ওরাওঁদের নানা আচার নিয়ে।
ওরাওঁ আদিবাসী সমাজে গোত্র রয়েছে বিশটির মতো। একই গোত্রের সবাই সমতুল্য বলেই বিশ্বাস তাদের। তাই এদের সমাজে একই গোত্রে বিয়ে সম্পন্ন নিষিদ্ধ ও পাপ বলে গণ্য।
ওরাওঁদের গোত্রগুলোর নামকরণ করা হয়েছে পশুপাখি ও বস্তুর নামানুসারে। মুংলীর মুখে শুনি গোত্রগুলোর নাম- টিগ্গা অর্থ বানর, বান্ডো অর্থ বনবিড়াল, বাড়া অর্থ বটগাছ, বাঁড়োয়া অর্থ বন্যকুকুর, বাখলা অর্থ এক প্রকার ঘাস, বেক অর্থ লবণ, কেরকোটা অর্থ চড়-ই পাখি, কিন্ড অর্থ এক প্রকার মাছ, কিসপট্রা অর্থ শুকরের নাড়িভুঁড়ি, কুজুর অর্থ এক প্রকার লতা জাতীয় গাছ, লাকড়া অর্থ বাঘ, মিঞ্জি অর্থ এক প্রকার মাছ,  পান্না অর্থ লোথা, তির্কী অর্থ এক জাতীয় মাছ, টপ্প অর্থ এক জাতীয় পাখি, খাখা অর্থ এক জাতীয় কাক, খালখো অর্থ এক জাতীয় মাছ, খেস অর্থ ধান প্রভৃতি।
শারীরিক গঠণ ও ভাষাগত বিচারে ওরাওঁরা দ্রাবিরিয়ান গোষ্ঠীভূক্ত। এদের বসবাস ছিল ভারতের উড়িষ্যা, ছোট নাগপুর ও রাজমহল অঞ্চলের পার্বত্য এলাকায়। দেশ ভাগের আগেও দিনাজপুরে বহু সংখ্যক ওরাওঁদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দলিলে। কিন্তু  নানা কারণে আজ এ দেশ থেকে ওরাওঁ আদিবাসীরা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।

ওরাওঁ গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকে গ্রাম পরিষদের হাতে। ওরাওঁ ভাষায় এটি ‘পাঞ্চেস’। এক সময় বয়োবৃদ্ধ সাত-আটজনকে নিয়ে গঠিত হতো এ গ্রাম পরিষদ। প্রতিটি পরিষদে থাকত একজন মহত বা মাহাতো এবং একজন পুরোহিতসহ অন্যান্য পদ। আবার পাঞ্চেস এর উপরের সংগঠণের নাম ছিল পাঁড়হা। পাঁড়হা সাধারণত  সাত থেকে ১২ টি আদিবাসী গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো। এ সকল গ্রামের মাহাতোদের মধ্য থেকে একজন পাঁড়হা প্রধান নিযুক্ত করা হতো। ওরাওঁ ভাষায় তাকে বলে ‘পাঁড়হা রাজা’। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় ওরাওঁদের আদি গ্রাম পরিষদটি আর টিকে নেই। এখন টিনপাড়ার ওরাওঁ গ্রামটি চলছে শুধুমাত্র মহত পদটি নিয়ে।
এ গ্রামের ওরাওঁরা দুটি ভাষায় কথা বলে। একটি ‘কুঁড়ুখ’ অপরটি ‘সাদরী’ ভাষা। মুংলী আমাদের বুঝিয়ে দেন তাদের ভাষাটিকে। কারও নাম জানতে ওরাওঁরা কুঁড়ুখ ভাষায় বলে-‘নিহাই নাম এন্দা’, আর সাদরী ভাষায় বলে -‘তোর নাম কা’। কেমন আছেন- বাক্যটিকে কুঁড়ুখ ভাষায় বলে- ‘একাশে রাদি’, আমি খাই বাক্যটিকে বলে- ‘এঙ অনদান’, তুমি খেয়েছ? বাক্যটিকে বলে- ‘নিন ওন্ডকায়’।
ওরাওঁদের ভাষার নিজস্ব কোন লিখিত বর্ণ নেই। মাকে এরা ‘মায়া’, বোনকে ‘বাহিন’, সূর্যকে ‘বেলা’, ঝড়কে এরা ‘সাতোয়া’, মাছকে ‘মাছড়ি’, নদীকে ‘নাদি’, মোরগকে ‘কোকড়ো’, কুড়ালকে ‘টাঙিয়া’, নাপিতকে ‘নাউয়া’ বলে।
মাটির দেওয়াল ঘেরা মুংলীর পাশের বাড়িটি বেশ বড়। ভেতরের ঘরগুলো মাটি আর ছনে ছাওয়া। মুংলীর সঙ্গে আমরা পা রাখি বাড়িটিতে। আমাদের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন এক বৃদ্ধা।
নাম তার মায়া টিগ্গা। বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই। বয়সের ভার এখনও তাকে কাবু করতে পারিনি। কিন্তু বয়সের টানে তিনি হারিয়েছেন দুইপাটির দাঁতগুলো। ফোকলা দাঁতে হাসি তুলে তিনি আমাদের বসতে দেন মাদুর বিছিয়ে। খবর পেয়ে আরেকবাড়ি থেকে আসেন তার বোন পারলো টিগ্গাও।
ওরাওঁদের নানা বিষয় নিয়ে চলছে কথোপকথন। হঠাৎ আসরে আসেন এক নারী। কপালে তার লাল টিপ। মাথার সিথিতে ভরাট সিঁদুর ও হাতে শাখা-খাড়ু। নাম জানালেন মালতি খালকো। মায়া টিগ্গার ছেলের বউ। আমাদের জন্য নিয়ে আসেন চিড়া-মুড়ি। খেতে খেতে কথা হয় ওরাওঁদের বিয়ে নিয়ে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে মায়া টিগ্গা বলেন তাদের বিয়ের আচারগুলোর কথা।
অন্য আদিবাসীদের মতো ওরাওঁরাও বিয়েতে মাড়োয়া সাজায়। বিয়ে বাড়ির উঠানে এরা মাড়োয়া তৈরি করে। মাড়োয়া সাজানোর সময় এরা দলবেধে নাচগান করে এবং প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খায়। কি গান করেন? প্রশ্ন শুনে পাশ থেকে মালতি গান ধরে-
‘মাড়োওয়া যে ছান্ডেলে বাবা মাড়োওয়া
মাড়োয়া সবে দসো মিলে নিকে সবাই
কাঞ্চা বাঁশকে মাড়োয়া ছান্দেলে…’
(ভাবার্থ: সবাই মিলে বিয়ের কলা গাছ পুঁতে কাঁচা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বিয়ের বেদী তৈরি করেছে..)
ওরাওঁ বিয়েতে ব্যবহার করা হয় জোয়াল ও শিল-পাটা। প্রথমে ঘরের ভেতর একটি জোয়াল, জোয়ালের ওপর সামান্য খড়, খড়ের উপর পাটা এবং তার ওপর শিল রাখা হয়। বিয়ের সময় বর গিয়ে পাটার ওপর দাঁড়ায়, কনেও দাঁড়ায় একই পাটায় বরের সামনাসামনি। তারা এমনভাবে দাঁড়ায় যাতে তাদের পরষ্পরের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল স্পর্শ করে। এ সময় বর একটি পাত্রে রাখা সিঁদুর তার বাম হাতের কনিষ্ঠ অঙুলে নিয়ে কনের কপালে তিনবার পরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কনেও একইভাবে বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে সিঁদুর নিয়ে তিনবার পরিয়ে দেয় বরের কপালে। এভাবেই বিয়ের মূল আচার শেষ করা হয়। এরপর তাদের কোলে করে ঘরের বাইরে এনে মাড়োয়ার চারপাশে তিন বা পাঁচ বার ঘুরিয়ে পাশাপাশি বসানো হয়। এ সময় বরের বামপার্শ্বে কনে এবং ডানপার্শ্বে থাকে ভগ্নিপতি। এরপরই শুরু হয় বরণ পালা।
নিকটাত্মীয়রা এ সময় একে একে উপহার তুলে দিয়ে বর-কনেকে আর্শিবাদ করে। এছাড়া ওরাওঁরা বিয়ের অনুষ্ঠানে  কুটুমেত, বড়িপাড়া, মাড়োয়া প্রভৃতি পর্ব বিশেষভাবে পালন করে থাকে।
আমাদের চোখ পড়ে মুংলী আর মায়ার কপাল ও গলায়। দু’জনের চামড়ায় হালকা কালো রঙের দাগ। প্রায় একই ধরণের। কিসের দাগ? প্রশ্ন করতেই  মুংলী বলেন এটি ‘উল্কি’। ওরাওঁরা গায়ে উল্কি আঁকেন। এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। পাশে বসা পারলো টিগ্গা বলেন উল্কি নিয়ে ওরাওঁদের নানা বিশ্বাস ও আচারের কথা।
বার-চৌদ্দ বছর বয়স হলেই ওরাওঁদের বিশেষ নিয়ম মেনে নারীপুরুষ উভয়ের শরীরে উল্কি আঁকতে হয়। প্রথমে এক প্রকার লতা বেটে তার সাথে মাটির পাতিলের নিচে পোড়া কালি আর দুধ মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরী করা হয়। তারপর এক জোড়া সুচ আগুনে পুড়িয়ে দেহের যেখানে যেখানে উল্কি আঁকতে হবে সেখানে দ্রুত স্পর্শ করে আঁকা হয় নানা চিত্র। এরপর সে জায়গায় লতাবাটা, কালি আর দুধ মিশ্রণ লাগিয়ে দেয়া হয়। ঘা শুকালে কালো রঙের চিরস্থায়ী উল্কির আকার চামড়ার মধ্যে ভেসে ওঠে। এ রং সারা জীবনে এতটুকুও পাল্টায় না।
কবে এবং কেন ওরাওঁ সমাজে উল্কি আঁকার প্রচলন হলো, এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে একটি অভিন্ন আদিবাসী কাহিনী। পারলোর মুখে শুনি কাহিনীটি-
পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে মানুষ ছিল এক জাতের। কারো কোনো পেশা ছিল না। পেশা না থাকায় ছিলনা কোনো জাতও। পেশা গ্রহণের জন্য ধরমেশ সবাইকে ডেকে পাঠালেন। সবাই উপস্থিত হলো।
ধরমেশ একজনকে দিলেন লাঙল। তখন সে হলো চাষি। আরেকজনকে দিলেন কুঠার। সে হয়ে গেল কাঠুরে। একজনকে দিলেন মাছ ধরার জাল। সে হলো জেলে। একজনকে দিলেন কাপড় বোনার সুতা। সে হয়ে গেল তাঁতী।
সবাই সব কিছু পেলো। অবশিষ্ট থাকলো একটি দোতরা। শেষে এক ব্যক্তি পেল সেটি। সে ব্যক্তি দোতরা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গায়। ফলে সমাজে তার সম্মান বেড়ে যায়।
একদিন সে বাড়ি ফিরে রান্না ভালো না হওয়ায় স্ত্রীকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী চলে যায় বনে। বনের মধ্যে ছিল এক দেবতা। তাকে দেখে তার দয়া হলো। তিনি তার কান্না থামিয়ে বললেন, আমি তোমাকে এমন কাজ দেবো যে কাজের জন্য সবাই তোমাকে কদর করবে।
দেবতা তাকে উল্কি আঁকার সব পন্থা শিখিয়ে দিল। সে থেকেই পৃথিবীতে উল্কির প্রচলন শুরু হয়। তাই শুধু উল্কি চিহ্ন নয়, উল্কি শিল্পীও ওরাওঁদের কাছে পবিত্রতার প্রতীক।’
আদিকালে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সনাক্তকরণের একমাত্র চিহ্ন ছিল এই উল্কি। ওরাওঁরা উল্কি আঁকার পূর্বে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে পূজা করে। উল্কি যেন ভালোভাবে আঁকা হয়, ঘা যেন তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় আর অপদেবতাদের দৃষ্টি যেন কোনোভাবেই না পড়ে সেটিই থাকে পূজার উদ্দেশ্য।
সাধারণত উল্কি আঁকার স্থান হাতের তালু, হাতের এপিঠ ওপিঠ, বুক এমনকি গন্ডদেশ। উল্কি হিসেবে আঁকা হয় লতাপাতা, গোলচক্র,পশুপাখি, সূর্য, চন্দ্র, তারা প্রভৃতি।
ওরাওঁরা বিশ্বাস করে কোনো নারী বা পুরুষ যদি উল্কিবিহীন মারা যায় তবে যমরাজা তাকে মানবরূপে গ্রহণ করে না। ফলে অনন্তকাল তাকে নরকে পড়ে থাকতে হয়। আর এ কারণেই ওরাওঁ সমাজে মৃত্যুর পরে দাহ করার আগে মৃতের শরীরে উল্কি একে দেয়া হয়।

পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তাকে ওরাওঁরা বলে ‘ধরমী’ বা ‘ধরমেশ’। ওরাওঁরা বিশ্বাস করে তিনি সর্বশক্তিমান এবং তাঁর ইচ্ছাতেই সবকিছু ঘটে। ধরমেশ ছাড়াও এদের সমাজে গ্রামদেবতা, গার্হস্থ্য দেবতা, অরণ্যদেবতা, রোগ-জরার দেবতা, মনসা প্রভৃতি পূজার প্রচলন রয়েছে। মুংলীর মুখে আমরা শুনি ওরাওঁদের আদি একটি পূজার কথা। এটি পাদ্দা বা গ্রাম পূজা।
মূলত ফসল বোনার আগে ফলন বৃদ্ধি, ফসল ভালোভাবে ঘরে ওঠা প্রভৃতির উদ্দেশ্যে এ পূজার আয়োজন করা হয়। বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ মাসে বাড়ির বাইরে কোনো একটি বট বা পাকুড় গাছের নিচে এই পূজাটি করা হয়।
সাধারণত এ পূজা দিনে হয়। পূজায় উপকরণ হিসেবে লাগে- লাল এবং সাদা রংয়ের নিশান, সালু কাপড়, ধুপ-ধুনা, সিঁদুর, আতপ চাল, চিড়া, দুধ, বাতাসা, মালভোগ কাল, কাঁঠাল, পান সুপারি, কলাপাতা, কলা গাছের ডোঙ্গা, একটি কালো রংয়ের ছাগল, দু’টি কবুতর, একটি হাঁস, পাঁচ রঙের পাঁচটি মুরগি, কালো রঙের একটি ছোট মুরগির বাচ্চা, দু’টি গামছা, সরুচালের পিঠা, সাদা সুতা, দুর্বাঘাস, বেলপাতা প্রভৃতি।
ওরাওঁদের গ্রাম পূজায় কোনো পুরোহিত লাগে না। গ্রামের বয়ষ্ক পুরুষরাও এই পূজা করতে পারে। পূজার দিন নারী পুরুষ সবাই উপোস থাকে। পুরুষরা পূজাস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গোবর-জল দিয়ে লেপে নেয়। পরে পূজার উপকরণ নিয়ে গ্রামের প্রত্যেকটি পুরুষ উপস্থিত হয় সেখানে। পূজার জায়গাতে থাকে রান্নার ব্যবস্থা। প্রথমে একটি লম্বা বাঁশের মাথায় সাদা নিশান বেঁধে যে গাছের নিচে পূজার আয়োজন হয় সেই গাছের সাথে বেঁধে দেওয়া হয়। পরে লাল-সাদা নিশান কমপক্ষে ১৫-১৬ জোড়া ছোট বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে পূজা প্রাঙ্গনের চারদিকে পুঁতে দিতে হয়।
একজোড়া করে নিশান লাগানো হয় বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিটি নিশানের পাশে সাজিয়ে দেওয়া হয় কলা গাছের ডোঙ্গায় ১ জোড়া করে পান সুপারি, বেলপাতা, চিড়া, দুধ, কলা, বাতাসা, কাঁঠাল ইত্যাদি। পূজাস্থলের চার-পাঁচ জায়গায় জ্বালানো হয় ধুপ-ধুনা ।
অতঃপর সেখানে প্রথমে কালো রংয়ের ছাগলের বাচ্চাটিকে মাথায় সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে, পা-ধুয়ে জল ছিটিয়ে, সামনে কিছু আতপ চাল ছড়িয়ে দিয়ে বরণ করা হয়। পরে ছাগলটিকে কালীর নামে বলি দিয়ে মাথাটি রেখে দেওয়া হয়।
কবুতর দু’টিকে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে, আতপ চাল মাটিতে রেখে খাওয়ানো হয়। তিন চার বার খাওয়ানোর পরে কবুতর দু’টিকেও একইভাবে শিবের নামে বলি দেওয়া হয়।
এভাবে হাঁসটিকে চাল, সিঁদুর, ধূপ দিয়ে প্রথমে বরণ করে পরে বলি দেওয়া হয় দেবী মনসার নামে। এ সময় কলার ডোঙ্গায় আলাদাভাবে দুধ-খই দেওয়া হয় প্রসাদ হিসেবে। অতঃপর পূজাস্থল থেকে কিছুটা দূরে নরসিংহ দেবতার স্থানে একটি লাল-সাদা মোরগ জীবিত অবস্থায় মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দেয় ওরাওঁরা। সেখানেও দুধ, কলা, ফলমুল দেওয়া হয় কলার ডোঙ্গায়। অতঃপর লাল মোরগ এবং মুরগিগুলোতে প্রথমে পা ধুয়ে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে আতপ চাল খাওয়ানোর পর ধূপ, ধুনা ইত্যাদি দেওয়া হয়। এভাবেই ওরাওঁদের গ্রাম পূজা বা পাদ্দা পূজাটি শেষ হয়।
এ পূজায় ওরাওঁ নারীদের পূজাস্থলে যাওয়া আগে কিছু আচার পালন করতে হয়। ওইদিন তারা সংসারের যত ভাঙা জিনিসপত্র আছে যেমন- ভাঙা কুলা, ঝাড়–, ঘর মোছার ন্যাকরা ইত্যাদি উঠানে একত্রিত করে তাতে সিঁদুরের ফোঁটা, চালের তৈরি পিঠা, দুধ, হাড়িয়ার জল, হলুদ, দুর্বা, তুলসি দিয়ে তার ওপর তামার পয়সা ধোয়া জল ছিটিয়ে দেয়। অতঃপর কালো মুরগির বাচ্চাটিকে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে আতপচাল, চালের তৈরি পিঠা খাওয়ানো হয়। পরে পূজার সব উপকরণ, ভাঙা জিনিসপত্র, মুরগির বাচ্চাসহ উঠিয়ে নিয়ে গ্রামের একটি ফাঁকা জায়গায় ফেলে দেয় এরা। এরপরই নারীরা একত্রে গ্রাম পূজায় অংশ নেয়।
পূজা শেষে বলি দেওয়া কবুতর, পাঁঠা, হাঁস ইত্যাদির মাংস দিয়ে রান্না করা হয় খিচুড়ি। রাতভর চলে হাড়িয়া খাওয়া ও ওরাওঁদের ঝুমুর নাচ।
রাত বাড়তে থাকে। হাট থেকে ফিরে সবাই ভিড় করে মায়া টিগ্গার বাড়িতে। মুখে মুখে চলে ওরাওঁদের বিশ্বাসের নানা কাহিনী। হঠাৎ চোখ পড়ে আকাশে। অজস্র তারার মাঝে জ্বলজ্বল করছে মায়াবী চাঁদ। চাঁদের সিগ্ধ আলোক ছটা এসে পড়েছে গোটা গ্রামে। আলো-আধারীর মায়াবী আলোয় আদিবাসী মুখগুলো দেখতে সত্যি অন্যরকম লাগে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কম, প্রকাশকাল: ২২ নভেম্বর ২০১৩

© 2013 – 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button