আর দাঁড়াতে পারলাম না
বাবার কথা খুব একটা মনে নেই শুকুর আলীর। বাবা আক্তার হোসেন ছিলেন খেটে-খাওয়া কৃষক। জমি তেমন ছিল না। অন্যের জমিতে কামলা দিতেন। পরিবারে ৩ ছেলে ১ মেয়ে। স্বল্প আয়ে তাই পরিবার চলত না। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।
বাবা যখন মারা যান শুকুরের বয়স তখন চার। বড় ভাই জমদর আলী পরিবারের হাল ধরেন। তিনিই কোলেপিঠে করে মানুষ করেন শুকুরকে। সে সময় লেখাপড়ার চেয়ে মাঠে কাজ করার গুরুত্ব ছিল বেশি। ফলে ক্লাস থ্রির পরেই শুকুর লেখাপড়ায় ইতি টানেন।
তখন ১৯৬৬ সাল। ইপিআরে লোক নিচ্ছে। খবর পেয়ে শুকুর লালমনিরহাট থেকে চলে আসেন রংপুরে। দাঁড়িয়ে পড়েন লাইনে। শরীরের মাপ আর কিছু পরীক্ষা। সব ক’টাতেই টিকে যান তিনি। পরদিন সিপাহী হিসেবে জয়েন করেন মাহিগঞ্জ ইপিআর ক্যাম্পে। বেতন সত্তর টাকা। ব্যাচ নং-০৩৯১। ঠাকুরগাঁওয়ে চলে কয়েক মাসের ট্রেনিং। অতঃপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিলেট খাদিমনগর ইপিআর ক্যাম্পে।
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামে। হত্যাযজ্ঞ চলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হলসহ কয়েকটি জায়গায়। কিন্তু সে খবর পৌঁছায় না শুকুরদের কাছে। ৩০ মার্চ সন্ধ্যা। খাদিমনগর ক্যাম্প থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় পাকিস্তানি ইপিআরদের। বাঙালি সিপাহীদের মনে তখন নানা প্রশ্ন দানা বাঁধে।
ক্যাম্পে ছিলেন এক বিহারি সুবেদার মেজর। নাম ইসমাইল খাঁন। তিনি ছিলেন বাঙালিদের পক্ষে। ১ এপ্রিল ভোর। সুবেদার মেজরকে ডেকে পাঠানো হয় আর্মি ক্যাম্পে। খানিক পরই তিনি ফিরে আসেন মলিন মুখে। শুকুরদের খুলে বলেন সবকিছু। যে কোনো সময় ক্যাম্পে হানা দিবে পাকিস্তানি সেনারা। সবাইকে উদ্দেশ্য করে তিনি শুধু বললেন– ‘‘বাচ্চু, আবি তুম যা মর্জি যাতা হ্যায়, হাম তোমকো নেহি রুখনে..।’’
ক্যাম্পে ছিল তিনটি কোম্পানি। একেক কোম্পানিতে ১৪০জন। সবাই তখন খাদিমনগর চা বাগান ও পাহাড়ের ভেতর দিয়ে গোয়াইনঘাটের দিকে রওনা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালি সৈন্যরাও এসে জড়ো হয় গোয়াইনঘাট থানায়। সেখানে ছিল একটি মুজাহিদ ট্রেনিং সেন্টার। ট্রেনিং সেন্টারের অস্ত্র নিয়েই শুকুররা আবার ফিরে যায় খাদিমনগরে। প্রস্তুতি নেয় ক্যাম্প আক্রমণের।
ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ তখন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। শুকুররা অবস্থান নেন ইপিআর ক্যাম্পের কাছাকাছি। এক সকালে শুরু হয় গোলাগুলি। পাকিস্তানি সেনাদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে তারা পেরে ওঠেন না। ওইদিন শহীদ হন সরাফত, মুজিবর রহমানসহ কয়েকজন। গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সন্ধ্যের পরই পিছু হটতে বাধ্য হন তারা।
এ সময় কমান্ডে ছিলেন সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী, সুবেদার মশিউর রহমান ও মজিবুর। শুকুররা পরে ডিফেন্স গাড়েন হরিপুরে। কিন্তু সেখানেও তারা ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার হন। ফলে তামাবিল হয়ে ভারতীয় সীমান্তের নলছড়ি পাহাড়ের ওপর তাঁবু গাড়েন তারা। আশপাশের জেলার আনসার ও মুজাহিদরাও সেখানে জড়ো হতে থাকেন।
শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শুকুর আলীর জীবনকথা। একাত্তরে এক সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গুলি লাগে তার বাম পায়ের উরুতে। ফলে তার পায়ের রগগুলো ছিঁড়ে যায়। পা হারায় তার কর্মক্ষমতা। আরেকটি গুলিতে তার বামহাতের কব্জির উপর, কনুইয়ের নিচের হাড় উড়ে যায়। এছাড়াও স্প্রিন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত ক্ষত তৈরি হয় তার ডান পা ও পেনিসের কিছু অংশে। বর্তমানে হুইলচেয়ারই তার একমাত্র সঙ্গী।
মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলীর গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার দলগ্রামে। তিনি পড়াশুনা করেছেন ওই গ্রামের ঘোসাইহাট পাটকিপাড়া প্রাইমারি স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধ করেছেন ৪নং সেক্টরে। কথোপকথনের শুরুতেই আমরা প্রশ্ন করি– ‘‘কেমন আছেন?’’
উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘‘বিয়াল্লিশ বছর ধরে পঙ্গু। প্রসাব করি গ্যালনে। কোলে করে নিতে হয় বাথরুমে। বসতে হয় অন্যের সাহায্য নিয়ে। এভাবেই তো চলছে জীবন।’’
উত্তরটি আমাদের মনে নাড়া দেয়। খানিক বিরতিতে আবার শুরু হয় আলাপচারিতা।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে শুকুর আলী ছিলেন সিলেট খাদিমনগর ইপিআর ক্যাম্পে। ওই সময় ব্যারাকের ভেতরের অবস্থা জানালেন তিনি– ‘‘পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে মিশত কিন্তু মন খুলে সব কথা বলত না। বাঙালিদের প্রমোশন হত দেরিতে। তাদের তাড়াতাড়ি। নায়েক সুবেদার পর্যন্ত ছিল বাঙালি। উপরের বাকি সব পোস্টে পাকিস্তানিরা।’’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তারা কটূক্তি করত– ‘‘আপকা শেখ সাব যো বক্তব্য দিয়া, আবি তো তোম বাঙালি আচ্ছা হো গিয়া।’’
মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলীর বয়স সত্তরের ওপরে। তার স্মৃতি থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে আজ। কিন্তু এখনও প্রায় জীবন্ত হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ঘটনা।
কোন অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হলেন? এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলী আনমনা হয়ে যান। অনুমতি নিয়ে একটি সিগারেট ধরান। অতঃপর ধীরে ধীরে বলতে থাকেন।
‘‘নলছড়ি পাহাড়ে আমরা ছিলাম ২৩ দিন। একদিন আসেন ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন রাও। তিনি দেশের ভেতর গিয়ে যুদ্ধ করতে আমাদের উৎসাহিত করেন। আমাদের কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী। তাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন– ‘‘আপ লোক আবি আপকা জায়গা করো, দেশকা লাগি লড়ো, সাহায্য করনা হাম করেগা, গোলাবারুদ জো চাহি হাম দেগা।’’
রক্ত তখন টলমল করছিল। আমরা সে সময় খুব বিড়ি খেতে চাইতাম। তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন– ‘‘বাচ্চু, তোম লোগ এক দুশমন মারেগা তো হাম এক বিড়ি দে গা।’’ শুনেই আমরা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান তুলি। ওই রাতেই পরিকল্পনা হয় তামাবিল আক্রমণের।
২১ জুন ১৯৭১। রাত ১২টার পর থেকেই নলছড়ি পাহাড় থেকে ইন্ডিয়ান আর্মি আর্টিলারি ছুঁড়ে তামাবিল ইপিআর সেন্টারের ওপর। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। ভোর চারটার পর আমরা পাহাড় থেকে নামি দুটি দলে। আমার সঙ্গে ছিলেন নায়েক সুবেদার মোস্তফা রহমান, ফজলুর রহমান, পিন্টু, প্রমুখ। আমরা নলছড়ি দিয়ে হেঁটে আসামি বস্তির কিনার দিয়ে এসে তামাবিলে উঠি। আরেকটি দল তামাবিল চেকপোস্ট দখল করে নেয়।
তখন ভোর পাঁচটা। আমরা অবস্থান নিই তামাবিল ইপিআর সেন্টারের কাছাকাছি। প্রবল আর্টিলারির আঘাতে কোনোভাবেই সেখানে পাকিস্তানি সেনা থাকার কথা নয়, এই ভেবে আমরা সামনে এগোতে যাব অমনি বৃষ্টির মতো গুলি ও সেল এসে পড়তে থাকে। একটি গোলা এসে পড়ে ফজলুর রহমানের মাথায়। সে ছিল আমার পাশেই। চোখের সামনেই তার মাথাটা ছিটকে গেল। শরীরটা মাটিতে পড়েই ছটফট করতে থাকল। অন্যপাশে ছিলেন নায়েক সুবেদার মোসলেম উদ্দিন। তার নিতম্বের পুরো মাংস গেল উড়ে।
তখনও জানি না কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। নিজেকে সামলে পজিশন নিই। পাল্টা গুলি ছুঁড়তে থাকি। হঠাৎ কয়েকটা গুলি এসে লাগে আমার শরীরে। আমি ছিটকে পড়ি। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি। খানিক পরেই দেখলাম আমার বাম পায়ের উরু রক্তে ভিজে গেছে। হাত দিতেই দেখি পায়ের সব রগ ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড ব্যথা করছিল পায়ে।
ধীরে ধীরে শরীরটা অবশ হতে লাগল। বাম হাতের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম কবজির ওপরে কনুইয়ের নিচ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ডান হাতের আঙুলের স্পর্শেই বুঝে গেলাম, হাড়টি উড়ে গেছে। স্প্রিন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে আমার ডান পা ও পেনিসের কিছু অংশও।
তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল মরে যাচ্ছি। ব্যাথায় আমি ‘মা গো’ বলে চিৎকার করি। ধীরে ধীরে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। পাশেই ছিলেন নায়েক সেকান্দার। তিনি আমাকে তুলে নিয়ে যান তামাবিল ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাম্পে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল শিলং হাসপাতালে। হাত ও পায়ের অপারেশন হয় সেখানেই। তখনও আমার বাম পা অকেজো।
৫-৬ মাস পর ফিরে আসি স্বাধীন বাংলাদেশে। চিকিৎসা চলে প্রথমে সিলেট মেডিকেলে ও পরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। কিন্তু তবুও আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না।’’
স্বাধীনতার পরের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই মুক্তিযোদ্ধা। তার কান্না আমাদের বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তিনি বলেন, ‘‘শিলং হাসপাতালে বসে বসে ভেবেছি দেশে যাব, সবাই দেখতে আসবে, শান্তিতে জীবন কাটাব, সবাই অন্যরকম সম্মান করবে। কিন্তু ফিরে এসে দেখি সব মাটি। বাড়ি ফিরে শুনি শহীদ হয়েছেন আমার বড় ভাই সিরাজ। তিনি মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। টের পেয়ে রাজাকার মন্টু গাজীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি আর্মি তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার লাশটাও ফিরিয়ে দেয়নি। স্বাধীন দেশে ফিরে দেখি ওই রাজাকার বেঁচে আছে, কিন্তু বেঁচে নেই আমার ভাই। আর আমি পঙ্গু ও অক্ষম।’’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্নবাসনের জন্য ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুর গজনবী সড়কে (কলেজগেট) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারের জায়গায় সরকারিভাবে তৈরি হয়েছে বহুতল ভবন। ৩২টি যুদ্ধাহত পরিবারকে ওই ভবনে ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্রও দেওয়া হয়েছে এবং আরও দেওয়া হবে। অথচ ওই বিশ্রামাগারে বসবাসরত ও হুইল চেয়ারধারী হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে বহুতল ভবনে মিলেনি এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার কোনো আবাসন।
এ প্রসঙ্গে কথা উঠতেই শুকুর আলী বলেন, ‘‘আমি বিশ্রামাগারে আছি ১৯৭৮ সাল থেকে। ০২-০৩-২০১১ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটির স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বিশ্রামাগারে (১/১,১/২,১/৩,১/৬ গজনবী রোডে) বসবাসরত যুদ্ধাহতদের যে তালিকা উপস্থাপন করেন সেখানে আমার নাম ছিল দ্বিতীয় (কোড নং-০০৩৮) সারিতে। তবু আমি ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পাইনি। কেন পাচ্ছি না, তাও জানি না। বিষয়টি তুলে ধরে কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর আবেদন করেছি ২৯-০৯-২০১৩ ও ২৯-০৩-২০১১ তারিখে। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছি। সবাই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে নেই কোনো অগ্রগতি।’’
মুক্তিযুদ্ধের পরে বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হন এই মুক্তিযোদ্ধা। অতীতের জমে থাকা কষ্টগুলো তার চোখ বেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। আমরা শুধুই চেয়ে থাকি এই বীরের মুখপানে। তিনি বলেন, ‘‘১৯৭৩ সালে ভাতা পেতাম ৭৫ টাকা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি না হলে আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ভিক্ষা করতে হত। আমি তাই মন থেকে দোয়া করি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে।’’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনের পরপরই এদের গুলি করে মারা উচিত ছিল। যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি তারা কীভাবে এদেশে থাকে? এদের বিচার না হলে দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।’’
বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা ছিল বড় ভুল।’ তবে তিনি মনে করেন সাধারণ ক্ষমা নয় বরং দালাল আইন বাতিলের ফলেই এদেশে রাজাকাররা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার ভাষায়, ‘‘স্বার্থের কারণে জিয়ার হাত ধরেই রাজনীতিতে জায়গা করে নেয় গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদের মতো রাজাকারা। ফলে পরবর্তীতে দেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হয় রাজাকাররা। আমি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, রক্ত দিয়ে পতাকা এনেছি। অথচ সে পতাকা রাজাকারদের গাড়িতে। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসত। খুব কষ্ট হত।’’
বিয়াল্লিশ বছর পর হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে– এ বিষয়ে শুকুর আলী বলেন, ‘‘জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে, এটাই বড় কথা। আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার করতে পারিনি বলে বিয়াল্লিশ বছর পর তো তারা ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যায়নি। খুনি তো খুনিই থাকে।’’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য– ‘‘বাহাত্তরেই এ তালিকা চুড়ান্ত করা উচিত ছিল। যারা অস্ত্র জমা দিয়েছিল তাদের তালিকা ছিল মিলিশিয়া ক্যাম্পগুলোতে। যারা চিকিৎসা নিচ্ছিল তারা ছিল হাসপাতালে। ফলে খুব সহজেই তখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা যেত।’’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘কথায় বলে, সত্য কথা বললে মা মাইর খায়, না বললে বাপে হারাম খায়’’– আমাদের অবস্থাটা ও রকমই। আমরা বাঁচব নাকি মরব তাই জানতাম না। স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই দিইনি। এখন কেন সবাই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিচ্ছে! সবই সুবিধা লাভের আশায়।’’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘‘এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এটাও বলা উচিত নয়। এটা ছাপা হলে এই গল্প মুখস্ত করে অনেকেই একসময় মুক্তিযোদ্ধার তালিকার জন্য আবেদন করবে। এমনটাও হয়েছে এ দেশে।’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খারাপ লাগার বিষয়গুলো জানতে চাই আমরা। শুকুর আলী বলেন, ‘‘আমরা এখনও সৎ হতে পারিনি। টাকা ও মামার যোগ্যতা ছাড়া এদেশে চাকুরি হয় না। কেউ যদি ঘুষ দিয়ে চাকুরি নেয় তবে সে তো ঘুষ খাবেই, এটাই স্বাভাবিক।’’
ভালোলাগার কথা উঠতেই তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘‘দেশটা স্বাধীন, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী আছে।’’
মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলীর ৬ মেয়ে ২ ছেলে। ছোট ছেলে জাহেদুল ইসলাম জন্টু। পড়ছে অনার্সে। মিরপুর বাংলা কলেজে। নিজের মুক্তিযোদ্ধা বাবা প্রসঙ্গে সে বলে, ‘‘আমার বাবা একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। তার জন্য আমরা গর্বিত। ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করে পড়াশোনা করছি। তবুও কোনো খেদ নেই। আমি চাই আমার বাবার স্বপ্ন পুরণ করতে।’’
পরবর্তী প্রজন্ম দেশটাকে বদলে দিবে, এমনটাই মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলী। বুকে আশা নিয়ে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘তোমরা লেখাপড়া করে বড় মানুষ হও। মানুষকে ঠকিও না। মিথ্যা কথা বল না। মিথ্যা তোমার ভালো কাজগুলোকে ঢেকে দিবে। মিথ্যা তোমাকে ধবংস করে দিবে।’’
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, ২৫ জানুয়ারী ২০১৪
© 2014 – 2021, https:.