বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কথা
বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের অগ্রণী যোদ্ধা এবং রাষ্ট্রনৈতিক সংকটের ভরসাস্থল ছিল বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। বাঙালির ইতিহাসের উচ্চতম আকাঙ্ক্ষা, বিচারক-জীবনের ভারসাম্যপূর্ণ মানস, জ্ঞানের বিভিন্ন শৃঙ্খলার প্রতি অদম্য কৌতূহল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের চরিত্রে এক সুসমন্বিত রূপ নিয়েছিল। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, কিন্তু অসাম্প্রদায়িক। বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতামত থাকলেও তাঁর ঔৎসুক্য ছিল বিচিত্র মত ও পথে। গণতন্ত্রের জন্য তাঁর তৃষ্ণা ছিল অপার। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় বলতেন, সোনার বাংলা অপ্রাপণীয় নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটে দেওয়া তাঁর অন্তর্দৃষ্টিময় মন্তব্যের জন্য জাতি তাঁকে অভিভাবকের আসন দিয়েছিল।
শিক্ষাসনদে হাবিবুর রহমানের জন্মতারিখ ১ মে ১৯৩০ হলেও তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুরের দায়রামপুর গ্রামে জন্ম হয় এবং শৈশব ও কৈশোরকাল কাটে। বাবা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন আইনজীবী৷ জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। তিনি প্রথমে আঞ্জুমান এবং পরে মুসলিম লীগ আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হাবিবুর রহমানের পিতা জাতীয় যুদ্ধ ফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা ছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বহরমপুর কারাগারে পাঠায়, অবশ্য কয়েকদিন পরই জহিরউদ্দিন বিশ্বাস মুক্তি লাভ করেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে মুশির্দাবাদ ছেড়ে জহিরউদ্দিন বিশ্বাস রাজশাহীতে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন৷ হাবিবুর রহমানের মা গুল হাবিবা ছিলেন গৃহিণী৷পূর্ববাংলায় আসার পরে এ দেশের ইতিহাসের সঙ্গে হাবিবুর রহমানের জীবন ওতপ্রোত হয়ে যায়। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র।
১৯৫১ সালে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর করার পরের বছরই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা জারির পর ছাত্রদের যে খণ্ড খণ্ড মিছিল বেরোয়, তার একটিতে তিনি নেতৃত্ব দেন।
শিক্ষার্থী হিসেবে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কৃতিত্ব অসাধারণ। ইতিহাসের ছাত্র হয়েও তিনি ১৯৫৫ সালে এলএলবি পড়েন। এর পর লন্ডনের অক্সফোর্ডে গিয়ে আবার ১৯৫৮ সালে ইতিহাসের স্নাতক ও ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এর ঠিক পরের বছর লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টার হন।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আনুষ্ঠানিক কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৫২ সালে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে, এর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঁচ বছর শিক্ষকতার পর পেশা বদলে হন আইনজীবী। ১৯৭৬ সালের ৮ মে-তে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন। নিজের মেধা ও সৃজনশীলতায় ধীরে ধীরে আরোহণ করেন কর্মজীবনের শীর্ষে। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বৃত হন প্রধান বিচারপতি হিসেবে।
বাংলাদেশের অবিশ্বাসের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সুচারুভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বিদ্রোহ করলে জাতির উদ্দেশে এক নেতাসুলভ প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে সুসংবদ্ধ ও পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
মননশীল লেখক হিসেবে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আগ্রহ ও দখল ছিল বিচিত্র বিষয়ে। পবিত্র কোরআন শরিফের কাব্যময় অনুবাদ করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিল তাঁর গবেষণার অন্যতম বিষয়। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ। তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল অভিনব ধরনের অভিধান প্রণয়নে। বাংলা ভাষার একই ভাবধারার শব্দ নিয়ে রচিত তাঁর অভিধান যথাশব্দ দেশে-বিদেশে গুণীজনদের সমীহ অর্জন করে। কোরআন শরিফের বিষয়ভিত্তিক উদ্ধৃতি নিয়ে প্রকাশ করেন কোরানসূত্র। বিভিন্ন বিষয়ে লেখা তাঁর মোট বইয়ের সংখ্যা ৭০টিরও বেশি। গবেষণায় কৃতিত্বের জন্য ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ২০০৭ সালে ভূষিত হন একুশে পদকে। এ ছাড়া তিনি আরও বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর স্ত্রী ইসলামা রহমান ও তিন মেয়ে রুবাবা রহমান, নুসরাত হাবিব, রওনাক শিরিন এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত
© 2014 – 2018, https:.