গ্রামের নাম গোদাবাড়ী। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এই গ্রামটিতে বাস করে ৩০টি মুণ্ডা পাহান পরিবার। এ গ্রামের ছেলে সুদেব পাহান। মা-বাবার একমাত্র আদরের সন্তান। তার বয়স যখন ছয় তখন সুদেবকে নিয়ে মা-বাবার চোখে নানা স্বপ্ন জাগে।
বাবা খোসকা পাহানের ইচ্ছা সংসারের আয় বাড়াতে ছেলে তাঁর সঙ্গে কাজে যাবে। কিন্তু মা ভারতী পাহানের স্বপ্নটা ভিন্ন। বাঙালি ছেলেমেয়ের মতোই সুদেব বই হাতে স্কুলে যাবে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মুণ্ডাদের সম্মান বাড়াবে।
ছেলেকে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের একপর্যায়ে সুদেবকে স্কুলে পাঠাতে সম্মতি দেন খোসকা পাহান। বুকভরা আশা নিয়ে তাঁরা তাকে ভর্তি করান কালিয়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রথম দিনই দুরন্ত সুদেবের শিশুমনে ছন্দপতন ঘটে। মন থেকে আনন্দ-হাসি উবে গিয়ে জায়গা করে নেয় এক অজানা আতঙ্ক।
গোদাবাড়ীর মুণ্ডা পাহানরা কথা বলে সাদরি ভাষায়। এ ভাষায়ই মায়ের ঘুম পাড়ানি গান আর বাবার বকুনি খেয়েই বেড়ে উঠেছে সুদেব। মায়ের সে ভাষাটিকে সে খুঁজে পায় না বিদ্যালয়ে। সেখানে প্রচলন নেই তার আদিবাসী ভাষাটির। চারপাশের সবাই বাংলা ভাষাভাষী। বাংলা তার কাছে অপরিচিত, অন্য জাতির ভাষা। ফলে বিদ্যালয়ে এসে শিশু বয়সেই বাংলা ভাষাটি তার ওপর আরোপিত হয়।
একে তো ভাষার ভীতি, তার ওপর ক্লাসের বন্ধুদের আচরণে সুদেব কয়েক দিনেই একেবারে মুষড়ে পড়ে। আদিবাসী বলে তাকে বসতে হয় আলাদা এক বেঞ্চিতে। কেউ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না। সবাই তাকে আড়চোখে দেখে। ফলে এক অজানা আতঙ্ক ক্রমেই তার মনে বাসা বাঁধে। দিন দিন স্কুলে যাওয়া তার কাছে রীতিমতো ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে প্রথম পরীক্ষায়ই ফেল। অতঃপর সুদেবের নাম ওঠে দুর্বল ছাত্রের তালিকায়। কেউ জানতেও পারে না তার এই পিছিয়ে পড়ার কারণটি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুদেব হারিয়ে ফেলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ। এভাবে শিশু বয়সেই একদিন সুদেব বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে কাজের সন্ধানে।
সুদেবকে নিয়ে বাস্তব এ ঘটনায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষালাভের একটা চিত্র ফুটে ওঠে। কিন্তু সার্বিকভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের এ চিত্র আরো করুণ।
বাঙালি সমাজের কোমলমতি শিশুরা যখন শিক্ষার শুরুতেই বিদ্যালয়ে আনন্দ-হাসির মধ্যে নিজের মাতৃভাষায় ছড়া কাটছে, নিজের ভাষায় ভাব জমিয়ে বন্ধুত্ব করছে, তখন আদিবাসী শিশুরা নীরবে, নিস্তব্ধে চোখের জল ফেলে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয় থেকে। এমন দৃশ্য সত্যি নিজের বিবেককে নাড়া দেয়।এ দেশের মানুষ মাতৃভাষা বাংলার জন্য রক্ত দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত করেছিল নিজের বর্ণমালাগুলোকে। আমাদের ভাষাদিবস আজ সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া শহীদদের এ দেশেই আদিবাসী শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে- এ যেন প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো।
বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষরিত ‘আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ’-এর ৩০ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে, যেসব দেশে জাতিগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী লোক রয়েছে, সেসব দেশে ওই ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত শিশুকে সমাজে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ, নিজস্ব ধর্মের কথা ব্যক্ত ও চর্চা করা, তার সম্প্রদায়ের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ বর্তমান শিক্ষানীতিতেও আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
অন্যদিকে বাংলা ভাষার নৃতাত্তি্বক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আদিবাসী ভাষা থেকে বহু শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলা ভাষায়। সাঁওতালি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত দেশি শব্দগুলো প্রধানত সাঁওতালি ও মুণ্ডা ভাষা থেকে আগত। অথচ আজ হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী সে ভাষাগুলোও। এরই মধ্যে কোচ ও রাজবংশীদের ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। প্রায় পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে আদিবাসীদের কুরুখ ও নাগরি ভাষা।
কিছু মতভেদ থাকলেও বাংলাদেশে আদিবাসী ভাষার সংখ্যা ২৫ থেকে ৩৮টি। আদিবাসী ভাষাগুলোকে মূলত চারটি ভাষা পরিবারে ভাগ করা যায়। অস্ট্রো-এশিয়াটিক, তিব্বতি-চীন, দ্রাবিড় ও ইন্দো-ইউরোপীয়। বাংলাদেশে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগুলো আবার দুটি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে মোন-খমের ও মুণ্ডারি শাখা। বর্তমানে প্রায় ১০০টির অধিক ভাষা মোন-খমের শাখার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাসি ভাষা। এ ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। তবে বর্তমানে এ ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়।
সাঁওতালি ও মুণ্ডা ভাষা দুটিই মুণ্ডারি শাখার অন্তর্ভুক্ত। উভয় ভাষারই নিজস্ব কোনো হরফ নেই। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রঘুনাথ মুর্মু ‘অলচিকি’ নামে সাঁওতাল বর্ণমালা তৈরি করেন এবং তা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে।
চীনা-তিব্বতি ভাষাগুলো আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন- বোডো, কুকি-চীন, সাক-লুইশ ও লোলো-বার্মিজ শাখা। মান্দি বা গারো, ককবোরক (ত্রিপুরা), লিঙ্গাম, পাত্র বা লালং, কোচ, রাজবংশী প্রভৃতি ভাষা বোডো শাখার অন্তর্ভুক্ত। মৈত্রেয় বা মণিপুরি, লুসাই, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, পাংখো ভাষাগুলো কুকি-চীন শাখাভুক্ত।
রাখাইন, ওরাওঁদের কুড়ুখ, পাহাড়িকা ও মাহালি ভাষা দ্রাবিড় ভাষা পরিবারে অন্তর্ভুক্ত। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। রাখাইন ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। ওরাওঁদের কুড়ুখ ভাষাটি আদি ও কথ্য ভাষা।
বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত ভাষার মধ্যে বাংলা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এই পরিবারে আদিবাসীর মধ্যে চাকমা ভাষা এবং সাদরি ভাষাও রয়েছে। মণিপুরিদের বিষ্ণুপ্রিয়া, হাজং প্রভৃতি ভাষাও এই শ্রেণীভুক্ত।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা। বিলুপ্তপ্রায় এসব ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেছে ইউনেস্কো। এ ভাষাগুলো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলে তা মানবজাতির জন্য হবে বিপর্যয়কর ও দুর্ভাগ্যজনক। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের বিষয়টি অতি দ্রুত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত।আদিবাসী ভাষারক্ষা কিংবা শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের বিষয়টি এলেই প্রশ্ন ওঠে বর্ণ নিয়ে। তাদের ভাষায় লিখিত কোনো বর্ণ নেই। কিন্তু বিশ্বজুড়ে প্রচলিত ইংরেজি ভাষারও নেই নিজস্ব বর্ণ। ইংরেজি বর্ণগুলো রোমান হরফ থেকে নেওয়া। তা ছাড়া চাকমা, মারমা, রাখাইন, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, গারো, খাসিয়া, হাজং, মণিপুরি, ওরাওঁ, মুণ্ডাসহ ১৫টি আদিবাসী ভাষায় লিখিত রচনা এখনো রয়েছে। ভাষা রক্ষা কার্যক্রমে যা সহায়ক হতে পারে।
গারোরা নিজেদের মধ্যে আচিক ভাষায় কথা বলে। ভারতের মেঘালয়ে অনেক আগে থেকেই গারোদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এমনকি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েও গারো ভাষায় লেখাপড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আচিক ভাষার কোনো লিখিত রূপ না থাকলেও সেখানে রোমান হরফগুলোকেই গারো ভাষার বর্ণমালা করা হয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে গারো ব্যাপটিস্ট কনভেনশন, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের ক্যাথলিক সম্প্রদায়, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ও কিছু উন্নয়ন সংস্থা গারো বর্ণমালার একটি লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
চাকমাসহ অনেক আদিবাসী ভাষায় এখনো লিখিত রচনা রয়েছে। মণিপুরিদের ভাষা মৈথয়ীর ইতিহাস বহু পুরনো। সাঁওতালি ভাষায় সাহিত্য ও অভিধান রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা হয় এ ভাষায়। মিয়ানমারে মারমা ভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। বান্দরবানে জিরকুন সাহু নামে এক আদিবাসী বম ভাষায় অভিধান করেছেন। যেগুলো ভাষা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। তাই আন্তরিকভাবে চাইলে সমন্বিত উদ্যোগে সহজেই রক্ষা করা যায় আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলো।
সরকার সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। অথচ মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী শিশু স্কুলে যায়। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ মাতৃভাষার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই ঝরে পড়ে। তাই প্রয়োজন আদিবাসী ভাষাগুলো রক্ষার পাশাপাশি শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ প্রভৃতি। এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগগুলোরও দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতেই নয়, সব সময়ই আমরা চাই- রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখার গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকারীদের এ দেশে আদিবাসী শিশুরা পড়ুক তাদের চিরচেনা মায়ের ভাষায়।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, বিশেষ সংখ্যায়, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
WARNING :
If anyone wants to share this content, please contact me. If any unauthorised use or reproduction of salekkhokon.me content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
© 2014 – 2018, https:.