পথ গেছে ভিতরগড়
কথার ফুল ঝরিয়ে পথ চলছিলাম। গাড়ির ঝাঁকুনিতে অবশ্য ছিটকে যাচ্ছিল মাঝেমধ্যে। অরণ্য তাই রেগে যাচ্ছিল, মাঝেমধ্যে ঝাড়ছিল ড্রাইভারের ওপর। আমরা তাঁর কাণ্ড দেখে হাসি চাপাতে পারছিলাম না, সে আরো রেগে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার কষে ব্রেক করলেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন- গাড়ি আর যাইব না।
অগত্যা হাঁটা শুরু। চারপাশ খুবই সুন্দর। এতটা হবে ভাবিনি। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চায়ের বাগান। নিস্তব্ধ ও নীরব পরিবেশ। দূর থেকে অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। ঘন সবুজ গাছগুলোর মাথায় ছায়া দিতে ঠায় দাঁড়িয়ে অনেকগুলো ছায়াগাছ। সবুজ আমাদের হেথা হোথা ডাকছে, দিক হারিয়ে ফেলছি। বাগানের ভেতরে বিশেষ কায়দায় বিরতিরহীন পাতা তুলছে নারী শ্রমিকরা। দেখতে লাগছে ছবির মতো। হঠাৎ মৃদুল গান ধরে- কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। স্যালিলান টি এস্টেটের বাগানের মধ্য দিয়ে ভিতরগড়ের পথ খুঁজি। দুই ধারে শুধুই সবুজ। হঠাৎ চা গাছের ঝুপড়িতে কী যেন নড়ে ওঠে। থমকে দাঁড়াই। মৃদুল হুসহুস শব্দ করে। সাদা, কালো আর বাদামি রঙের দশ-বারোটি খরগোশ ছুটে পালায়।
চা বাগান ছাড়িয়ে খুঁজে পাই ভিতরগড়। উঁচু গড়টি অনেক দূর সোজা চলে গেছে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি রাজা পৃথ্বীরাজ এসে পড়বে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। খানিকটা সময় নিশ্চুপ কাটাই। প্রাচীন গড়ে দাঁড়িয়ে চা বাগান দেখতে অদ্ভুত লাগছে।
পঞ্চগড়ে মৃণালের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি আমরা তিন বন্ধু। ইতিহাসের পাতা মৃণালই উল্টাচ্ছিল- ভিতরগড় ছাড়াও এ জেলায় রয়েছে হোসেইনগড়, মীরগড়, রাজাগড় আর দেবেনগড়। পাঁচটি গড় থেকেই নাম পঞ্চগড়।
সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার ভেতরে সীমান্তঘেঁষা ইউনিয়নটির নাম অমরখানা। ভিতরগড় ঘিরে রেখেছে এই ইউনিয়নকে। ইতিহাস আমাদের টানতে থাকে। দুপুরের পরই বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য ভিতরগড়। রাস্তার দুই পাশে অনেক তরমুজের আবাদ। মনে হচ্ছিল হালকা সবুজ বড় বড় পাথর অলস পড়ে আছে।
ভিতরগড় ও চারপাশের চা বাগান দেখে মহারাজার দিঘির খোঁজ করি। এক যুবক পথ দেখায়। হেঁটে যেতে বেশি সময় লাগে না। এখানে এখন রাজবাড়ির ছিটেফোঁটাও নেই। ধারণা করা হয়, মহারাজার দিঘি থেকে ১৩৫ মিটার দূরে পৃথ্বীরাজের বাড়ি ছিল। ‘কামরূপ বুরুঞ্জি’তে রাজা জল্পেশ্বরকে পৃথু রাজা বলা হয়েছে। অমরখানা তাঁর রাজধানী ছিল।
প্রায় ৫৪ একর জমির বুকে টলমলে জলরাশি নিয়ে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে নয়াভিরাম এই দিঘি। দিঘিটির চারপাশে উঁচু পাড়। পাড়জুড়ে শত শত গাছ। গাছগুলোর কোনো কোনোটি বেশ বয়সী। প্রচুর পাখি ঘরবাড়ি করেছে গাছগুলোতে।
বিকেল হতেই মহারাজার দিঘিতে নামে পানকৌড়িদের ঝাঁক। মাঝেমধ্যে মাছরাঙা ঝাঁপ দেয়। দিঘির পাড়ে দেখা মিলে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের। নাম আব্বাস আলী। দিঘির পাশে ‘প্রধানপাড়ায়’ তার বাড়ি। শোনালেন মহারাজার দিঘি নিয়ে প্রচলিত কাহিনী- দিঘির পানি কখনো শুকায় না। পৃথু রাজা একবার ‘কীচক’ কর্তৃক আক্রান্ত হন। নিচু জাতের সংস্পর্শে জাত-ধর্ম নাশ হয়। রাজা তাই জাত রক্ষায় দিঘিতে আত্মাহুতি দেন। আগে দিঘির ঘাটে এসে কিছু চাইলেই অমনি অমনি মিলত।
রাজার আমল থেকে প্রতি বৈশাখে দিঘির পাশেই বসে বৈশাখী মেলা। মেলার সময় সীমান্তের ওপারের বাঙালিদের ভিড় জমে এপারে। ঘাটের পাশে মাছ ধরার অনেকগুলো আধুনিক হুইল ছিপ নজরে এলো। বন্ধের দিনে টিকিটের বিনিময়ে দিঘি ঘিরে চলে মাছ ধরার ধুম। শহর থেকে দলবেঁধে চলে আসে শৌখিন মৎস্যশিকারি। দেড় মণ ওজনের রুই মাছও নাকি পাওয়া যায়! এরই মধ্যে মহারাজার দিঘি প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছে বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাস। ছেলেমেয়েদের চিৎকারে হুঁশ ফিরে পাই। বের হওয়ার পথ খুঁজি।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
© 2014 – 2019, https:.