তাঁর আমলে কেন মুক্তিযোদ্ধাকে আত্মহত্যা করতে হইল
ছোট্ট একটি রুম। দখিনা জানালা। খাটের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছেন আবদুল হান্নান। বয়স ষাট। চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। দৃষ্টি তাঁর জানালার ওপাশে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছেন তিনি। আমাদের উপস্থিতিতে ফিরে আসেন চিন্তার রাজ্য থেকে।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নানের ডান পায়ের গোড়ালিতে চোখ পড়ে আমাদের। সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজের একাংশ রক্তে ভেজা। দু-এক দিন আগের কোনো ক্ষত হবে হয়তো। কিন্তু না, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নান যা জানালেন তা শুনে আমরা স্থির হয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্প্লিন্টার এখনও রয়ে গেছে তাঁর পায়ের গোড়ালিতে। এ পর্যন্ত সাতবার অপারেশন হয়েছে। তবু মুক্তি মেলেনি। গোড়ালির ভেতরটায় এখন ইনফেকশন হয়ে গেছে। ফলে কয়েক দিন পরপরই চলে ড্রেসিং। দিনের পর দিন এভাবে পায়ের ব্যথা আর ড্রেসিংয়ের যন্ত্রণা সহ্য করেই কেটে যাচ্ছে এই বীরের জীবন।
বাড়ির নাম আসমা কটেজ। সাইনবোর্ডে তেমনটাই লেখা। মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিংয়ের এ বাড়িতে ভাড়া থাকেন মুক্তিযোদ্ধা হান্নানের মেয়ে আসমা-উল হুসনা। চিকিৎসা করাতে মেয়ের বাড়িতে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধা বাবা। আরেক মুক্তিযোদ্ধার কাছে মিলেছিল সে খবর। সে সূত্র ধরেই এক সকালে আমরা হাজির হই আসমা কটেজে।
আবদুল হান্নানের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মিরাশনি গ্রামে। পিতার নাম আবদুল খালেক ভুঁইয়া। মাতা বাদশার মা। তাদের সাত সন্তানের মধ্যে হান্নান সবার ছোট। খানিকটা দুরন্ত হলেও সবার কাছে আদর পেতেন। একাত্তর সালে তিনি ছিলেন মিরাশনি পলিটেকনিক একাডেমি হাই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। এপ্রিলের ২২ তারিখ ছিল পরীক্ষা শুরুর দিন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সে পরীক্ষা আর দেওয়া হয় না হান্নানের।
১৯৭০ সালের শেষের দিকের কথা। সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের উজিরবাড়ি স্কুল মাঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আয়োজন করে মুজাহিদ ট্রেনিংয়ের। আবদুল হান্নান সে সময় তাদের কাছ থেকে তিন মাসের সশস্ত্র মুজাহিদ ট্রেনিং নেন। কিন্তু তখনও তিনি বুঝতে পারেননি, ওই ট্রেনিং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই লড়াই করতে কাজে লাগবে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মিরাশনি রেললাইনের পশ্চিমে ক্যাম্প বসায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। একটি বাড়ি দখল করে তাতে ক্যাম্প করে তারা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাঙালি নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হত ক্যাম্পে। এই কাজের দায়িত্ব ছিল রাজাকারদের ওপর।
মা-বোনকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে পাঠাত রাজাকার সিদ্দিকুর রহমান ও হুমায়ুন কবীর। চোখের সামনে নারীদের এ অপমানের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না হান্নান। গোপনে সংঘবদ্ধ হতে থাকেন আরও তিন বন্ধু আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান ও আবদুল আলিমকে নিয়ে। একদিন সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।
১ মে, ১৯৭১। পরিবারকে না জানিয়ে তিন বন্ধুসহ আবদুল হান্নান নওয়াবাদী বর্ডার হয়ে চলে যান ভারতের নরসিংহগড় ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুনুর রশিদ। ট্রেনিং থাকায় প্রথমে তাদের যুক্ত রাখা হয় নাইন বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে। পরে তিনি যুদ্ধ করেন ২ নং সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। মুক্তিযোদ্ধা হান্নান যুদ্ধ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাশিমপুর, বিষ্ণুপুর, কালারো টি গার্ডেন, হিরাতলা শ্রীপুর, কাঞ্চনপুর, কাশিমনগর, নোয়াগাঁও প্রভৃতি এলাকায়।
যে অপারেশনে তিনি আহত হন, সেটির কথা শুনি তাঁর জবানিতে:
‘‘আগস্টের ২ তারিখ। রাত ২টা। নরসিংহগড় ক্যাম্প থেকে আমরা পজিশন নিই নোয়াবাদী রেললাইনের পাশে। আমরা ছিলাম দশজন। আমার সাথী ছিলেন হাবিলদার নবী। টার্গেট ছিল পূর্ব পাশের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের একটি ক্যাম্পে আক্রমণ করা। গোলাগুলি শুরু হতেই আমি ও হাবিলদার নবী টুইন্স মর্টারের গুলি আরম্ভ করি। এই মেশিনটা চালাতে লাগে দুজন। আমরা ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত গুলি চালাই। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া একটি টুইন্স মর্টার এসে পড়ে আমাদের থেকে ৩০ হাত দূরে। সঙ্গে সঙ্গে ওই জায়গায় বিরাট গর্ত হয়ে যায়। বিকট শব্দে সেখান থেকে স্প্লিন্টার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছু স্প্লিন্টার ঢুকে যায় আমার পায়ে।
তবু তখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু গুলি চালাচ্ছিলাম। বরং মনে হচ্ছিল, ডান পায়ে কেমন যেন আরাম লাগছে। সেখান থেকে তখন রক্ত বেরোচ্ছিল। খেয়াল করতেই দেখলাম, ডান পায়ের গোড়ালি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ওই পা অবশ হয়ে যায়। দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসে।
ভোর পাঁচটার পর বন্ধু আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান ও আবদুল আলিম আমাকে উদ্ধার করে। প্রথমে চিকিৎসা হয় আগরতলার জেবি হাসপাতালে। তিন-চার দিন আমার জ্ঞান ছিল না। হাসপাতালেই আমাকে দেখতে আসেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। পরবর্তীকালে আমার চিকিৎসা হয় কলকাতা, লক্ষ্মৌ, গোহাটি এবং সবশেষে রামগড়ে। হাসপাতালে বসেই খবর পাই দেশ স্বাধীনের। ওই দিন ভারতীয় সৈন্যরা এসেছিল কোলাকুলি করতে। কী যে আনন্দ লেগেছিল সেদিন!”
আরেকটি কষ্টের কথা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা হান্নান। তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন বলে রাজাকাররা লাঠিপেটা করেছিল তাঁর বৃদ্ধ বাবাকে। সেই পেটোয়া বাহিনীর লোকগুলো এখনও এদেশে রাজনীতি করছে ভেবে কষ্ট পান তিনি। সে প্রসঙোগ আলাপ আসতেই হান্নান মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বললেন:
‘‘এহন যারা মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখাচ্ছে তারা অনেকেই তো মুক্তিযোদ্ধা না। এ কথা বললে তো পরের দিনই আমারে মেরে ফেলবে। এটা কিন্তু সরকারের দোষ না। এটা আমাদের নিজের দোষ। আমরা টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা বানাচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যুদ্ধের পরপরই করা উচিত ছিল।’’
তাঁর মতে, একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা আরেক জন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করতে পারে না। অথচ বিভিন্ন সরকারের আমলে এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার হয়েছে অনেকেই।
স্বাধীন দেশে একজন রাজাকার হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি, এমন উক্তি করে মুক্তিযোদ্ধা হান্নান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে কথোপকথনের একটি স্মৃতির উল্লেখ করেন:
‘‘আবদুর রহমান বিশ্বাস তখন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে ডাকা হয় আমাদের। হাত মেলাতে তিনি কাছে এলে আমি প্রশ্ন করি, ‘একটা রাজাকার হইয়া আপনি কীভাবে প্রেসিডেন্টের পদ দখল করলেন?’
উনি উত্তরে বললেন, ‘এগুলো কি আপনারা ভুলে যেতে পারেন না?’
আমি বলি, ‘আপনি যে রাজাকার ছিলেন মরবার আগ পর্যন্ত ভুলব না।’
উনিও প্রশ্ন ছুঁড়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষ যদি আমারে বানায়, তাহলে আপনারা কী করবেন?’
সেদিন আমরা তার সঙ্গে হাত মেলাইনি। বলেছিলাম, ‘একজন রাজাকারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা হাত মিলাতে পারে না।’
কিন্তু তার কথা শুনে আমরা সত্যি কষ্ট পেয়েছিলাম।’’
মুক্তিযোদ্ধা হান্নান দুঃখ করে বলেন, ‘‘নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন না হয়ে দেশটা ভিয়েতনামের মতো যদি ৬ বছরে স্বাধীন হত, তা হলে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারত, স্বাধীনতার মানে কী।’’
মুক্তিযুদ্ধের পরের বাংলাদেশ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এই যোদ্ধা। তাঁর মতে,
‘‘রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু কই, এ দেশের সাধারণ ঘরের একজন শিক্ষিত ছেলে তো চাকরি পাচ্ছে না। তদবির আর টাকা ছাড়া এখন চাকরি হয় না। তাহলে এ স্বাধীনতার কী মূল্য আছে? এ দেশের জন্য একটা পতাকা আমার এনে দিয়েছি। এ পতাকা রক্ষা করার মালিক জনগণ। জনগণ যত দিন সচেতন হবে না তত দিন দেশ ঠিক হবে না।’’
কথাগুলো বলতে বলতে তাঁর চোখের কোণে জল জমে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘পায়ে স্প্লিন্টার নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলি। বিবর্ণ কাপড় দেখে অনেকেই মনে করে ভিক্ষুক যাচ্ছে। ধার-কর্জ করে পায়ের চিকিৎসা চালাচ্ছি। আর দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধারা অট্টালিকা বানাইছে। এসব দেখে নিজের পরিবারও আজ প্রশ্ন করে, তুমি কেমন মুক্তিযোদ্ধা? তুমি কী করতে পেরেছ?’’
আমাদের সঙ্গে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নানের সহধর্মিনী জহুরা বেগমের। তিনি জানালেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একবার উনার চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল । মহাখালীর হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। হাসপাতালে তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়। পরে নাম কাটিয়ে আমরা চলে আসি। বলেছি, এ চিকিৎসার দরকার নেই।’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নান অকপটে বলেন:
‘‘স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আমার দেশের ছেলেরা সারা পৃথিবীতে বড় বড় জায়গায় যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছে। আমার দেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা সারা পৃথিবীকে জানান দিচ্ছে বাংলাদেশ খুব দুর্বল দেশ নয়। এই সব দেখলে বুকটা ভরে যায়।’’
খারাপ লাগে কখন? প্রশ্ন শুনেই নিরব হয়ে যান এ মুক্তিযোদ্ধা। অতঃপর বলেন:
‘‘শেখের ডাকে যুদ্ধে গেছিলাম। এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা। তাঁর আমলে কেন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আত্মহত্যা করতে হইল? এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। শেখ হাসিনা তো মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করেছেন। ভাতা বৃদ্ধি ও আবাসনের ব্যবস্থা করে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারগুলোকে বাঁচিয়েছেন। তিনি তো সৎ। কিন্তু তাঁর আমালের সচিবরা কেন দুর্নীতিবাজ? সচিব হোক আর দলের লোকই হোক, অন্যায় যে করবে তাকেই কঠিন শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে সরকারের সব অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে। যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা নিজের স্বার্থের জন্য আজ দুর্নীতির পথে হাঁটছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মিলে না যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নানের। তবু নতুন প্রজন্মের প্রতি বিশ্বাস ও বুকভরা আশা তাঁর। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন:
‘‘দেশের স্বাধীনতা রক্ষার পবিত্র দায়িত্বটুকু তোমাদেরকেই নিতে হবে। মনে রাখবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়া এই দেশ সঠিক পথে এগোবে না।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : জুলাই ২০, ২০১৫
© 2014 – 2021, https:.