ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ
সালটি ১৯৬৯। ম্যাট্রিক পাশ করেছি তখন। বাবা আমায় পাঠিয়ে দেয় চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে। আমাদের ব্যবসা ছিল সেখানে। আবুল বেকারি ও আহমেদিয়া ফুড ইন্ডাস্ট্রি সবাই এক নামে চিনত। বড় দু’ভাই ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। তাদের সঙ্গে আমিও যুক্ত হলাম।
ইচ্ছে ছিল চট্টগ্রাম পলিটেকনিকে পড়ব। বড় ভাই আবুল খায়ের মোল্লা বললেন, রেলওয়ে কলেজে ভর্তি হতে। আমার মন সায় দিল না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যোগ দিব যে কোনো বাহিনীতে। প্রথমে নেভিতে চেষ্টা করলাম। হল না। পুলিশে দাঁড়িয়েও চান্স পেলাম না। এনামুল হক চৌধুরী (বীর উত্তম) ছিলেন আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তিনি তখন আর্মির ক্যাপ্টেন। ঠিকানা জোগাড় করে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম নতুনপাড়া ক্যান্টনমেন্টে। আর্মিতে তখন লোক নিচ্ছিল।
আমার ইচ্ছার কথা শুনে ভয় দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘‘মামা, এখন তো বুক ফুলিয়ে আছেন, ট্রেনিং শুরু হলে তো পাহাড় ডিঙিয়ে পালিয়ে যাবেন।’’
আমি শুধু বললাম, ‘‘ইনশাল্লাহ, যাব না।’
উত্তর শুনে তিনি খুশি হলেন। শরীরের মাপজোকে পাশ করতেই টিকে গেলাম। ২৬ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীতে যোগ দিলাম সৈনিক হিসেবে। নামের পাশে পড়ল আর্মি নম্বর– ৩৯৩৯৯০২। খুলে গেল জীবনের নতুন দুয়ার। নয় মাসের ট্রেনিং শেষে চট্টগ্রাম থেকে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোর শানতলা ক্যান্টনমেন্টে, টোয়েন্টি ফাইভ বেলুচ রেজিমেন্টে।
দেশ তখন উত্তাল। অসহযোগ চলছে। সবার দৃষ্টি শেখ মুজিবের দিকে। কী হবে শেষ পর্যন্ত! ব্যারাকের ভেতর পাকিস্তানি সেনারা আমাদের হেয় চোখে দেখে। সেনাবাহিনীতে তাদের অফিসার ছিল বেশি। বাঙালিদের রেজিমেন্ট মাত্র আটটি। নানা বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের বচসা লেগেই থাকত। আর্মি ইউনিট এজুগেশন কোর্সের জন্য একবার আমাকে পাঠানো হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানকার একটি ঘটনা আজও মনে পড়ে।
ট্রেনিং ক্লাসে প্রতিদিন তিনটি পত্রিকা আসত– ইংলিশ, উর্দু ও বাংলা। বাঙালি ছেলে হিসেবে আমরা প্রথমেই বাংলা পেপারটি পড়তে যেতাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা এ নিয়ে আমাদের কটূক্তি করত। প্রথম দিকে প্রতিবাদ করতাম না। ক্ষোভগুলো এভাবে একে একে জমা হতে থাকল।
একদিন ফাস্ট বেঙ্গলের এক ল্যান্সনায়েক বাংলা পেপার পড়ছিল।
ঠিক তখনই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক ল্যান্সনায়েক গালি দিয়ে বলল, ‘‘মালোয়ান কি বাচ্চা, শেখ কা বাচ্চা, তুম বাংলা পেপার পড়তা হ্যায়।’’
শুনেই সে ঠিক থাকতে পারে না। প্রত্যুত্তরে ওই পাঞ্জাবি সৈনিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সঙ্গে আমরাও যুক্ত হই। পরে প্রশিক্ষক এসে তাকে উদ্ধার করে। পাঞ্জাবি সৈনিকদের সঙ্গে সেদিন আমরা মিললেও বাঙালি হিসেবে মনের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভের তীব্রতাটুকু ঠিকই টের পেয়েছিলাম।
ট্রেনিং শেষে ফিরে আসি যশোর ক্যান্টনমেন্টে। তখন থমথমে অবস্থা। বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল জেজেডিন এবং টুয়াইসি মেজর বার্টস। তারা দুজনই ছিলেন ইউরোপের নাগরিক। হেড কোয়ার্টার কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন (বীর প্রতীক)। একটা ইউনিটে ৭৫০ জন থাকে। এর মধ্যে আমরা বাঙালি ছিলাম ১৩৩ জন।
মার্চের মাঝামাঝি সময়। বাঙালি সৈন্যদের আলাদা করে রাখা হয়। ব্যারাকের ভেতর নানা গুঞ্জন। মনে নানা সন্দেহ দানা বাধতে থাকে। কী হবে? কী হতে যাচ্ছে? আমাদের কি মেরে ফেলবে ওরা? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।
এরই মধ্যে বিগ্রেডের মিটিং বসে। প্রস্তাব করা হয় বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করে বন্দি করে রাখার। আমাদের কমান্ডিং অফিসাররা তা মানতে নারাজ। তাদের ভাষ্য– ‘ওরা তো আর্মি রুলের কোনো বরখেলাপ করেনি।’
মিটিং শেষ হওয়ার আগেই ইন্টিলিজেন্সের মাধ্যমে এ খবর ব্যারাকে ছড়িয়ে পড়ে। সবার মধ্যেই তখন অজানা আতঙ্ক। কিন্তু আমাদেরকে বন্দি করা হল না। বরং অগ্রিম বেতন দিয়ে দুই মাসের ছুটিতে পাঠানো হল। নানা শঙ্কা পেছনে ফেলে ২৩ মার্চ সকালে এভাবেই পা রাখি গ্রামের বাড়ি চৌদ্দগ্রামে।’
১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর ভেতরের নানা ঘটনার কথা বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের মোল্লা। তার বাড়ি চৌদ্দগ্রামের কালকোট গ্রামে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা হাজী আনসার আলী মোল্লা ছিলেন কৃষি পেশায় যুক্ত।
আবদুল কাদেরের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কালকোট প্রি-প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি পড়াশোনা করেন প্রথমে বাতিসা হাই স্কুল এবং পরে চৌদ্দগ্রাম মাতৃলেটার হাই স্কুলে। ওই স্কুল থেকেই তিনি এসএসসি পরিক্ষা দেন।
মুক্তিযোদ্ধা কাদের মোল্লার সাক্ষাৎকার–
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের বলেন, ‘ওটাই তো ছিল মূল প্রেরণা। আমি তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কোর্স শেষে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি। ওইদিন আউট পাশ নিয়ে গোপনে চলে যাই রেসকোর্স ময়দানে। খুব কাছ থেকে দেখি বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে….।’সেদিনই বুঝেছিলাম স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম অনিবার্য।
মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হলেন কোন সময়টায়?
২৫ মার্চে ঢাকায় আর্মি নামার খবর আমরা পাই রেডিওতে। লোকমুখে খবর আসে খালেদ মোশাররফ তার দল নিয়ে ভারতের মতিনগর চলে এসেছেন। ২৭ মার্চ বিকেলে ইপিআরের ৮০ জন বাঙালি সৈন্য অস্ত্রসহ আশ্রয় নেয় বাতিসা হাই স্কুলে। তাদের থাকার ও খাবারের ব্যবস্থা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হারুন ও মফিজ। বিভিন্ন ফোর্সের আরও সৈন্য এক হলে সবাই মিলে পরদিন যোগ দিব ফোর বেঙ্গলে। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।
শুনেই আমার মা আয়শা খাতুন বললেন, কাদের তুমি এভাবে যেও না, ছুটি কাটিয়ে যাও। বললাম, মা, আমি একজন ট্রেন্ট সোলজার। দেশের এ অবস্থায় বসে থাকতে পারি না। মা ছেলের মনের কথা বুঝতে পারেন। সেদিন পাশে বসে তিনি আমায় খাওয়ালেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে মন থেকে শুধু বললেন, ‘তুমি দেশের জন্য, মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য যাচ্ছ। আমি জানি, তুমি সফল হয়ে একদিন মায়ের বুকেই ফিরে আসবে।’ মায়ের সেই দোয়াই হয়তো মুক্তিযুদ্ধে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।’
আপনারা তখন কী করলেন?
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের বলেন, ‘‘আমার নেতৃত্বে বিভিন্ন বাহিনী থেকে আগত ৮০ জনের দলটি মিয়ারবাজার ইপিআর ক্যাম্প হয়ে ভারতের বিবির বাজারে আসে। সেখান থেকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাঘমারা ক্যাম্পে। আমরা যুদ্ধ করি ২ নং সেক্টরের মতিনগর সাবসেক্টরের বি কোম্পানির অধীনে। কমান্ডে ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম (বীর প্রতীক)।
আমরা যুদ্ধ করি ২ নং সেক্টরের মতিনগর সাবসেক্টরের বি কোম্পানির অধীনে
কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?
‘‘কুমিল্লার আলীশহর, বাগমারা, ফরিদগঞ্জ ও বুড়িচংয়ে। আমরা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করেই হাতিয়ার নিয়ে সরে পড়তাম। তাদের গাড়ি, রেললাইন ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতাম। তখন কোনো ভেদাভেদ ছিল না। কত হিন্দুর বাড়িতে খেয়েছি, তাদের সহযোগিতা পেয়েছি। কারও বাড়িতে উঠলে পরে এ খবর পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্পে চলে যেত। তারা এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষ আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল।’’
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে আবদুল কাদের মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন। পরে তার বাম পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। স্মৃতি হাতড়ে রক্তাক্ত ওই দিনটির আদ্যোপান্ত বলেন তিনি। তাঁর ভাষায়–
‘‘এক বাঙালি ছিল বুড়িচং থানার ওসি। মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করতে ১৭ জন পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে সে শক্ত ক্যাম্প গড়ে তুলে। এমন খবর পেয়ে আমরা থানা আক্রমণের প্রস্তুতি নিই। ফোর বেঙ্গলের হাবিলদার আবুল ছিল ওই এলাকার লোক। রাস্তাঘাট সব তার চেনা। ক্যাপ্টেন দিদার সাহেব তাকে পাঠালেন রেইকি করতে। ফিরে এসে তাদের বাঙ্কার ও পজিশনসহ সকল তথ্য সে জানাল।
পরিকল্পনা করে ১১ জনের দুটি সেকশনে আমাদের ভাগ করে দেওয়া হল। একটি সেকশনের কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার তাহের (বীর প্রতীক)। আরেকটিতে হাবিলদার আবুল। আমি ছিলাম আবুল সাহেবের সেকশনে।
থানার খুব কাছেই রাজাপুর ও ফকিরেরপুরে পাকিস্তানি সেনাদের আরও দুটি বড় ক্যাম্প ছিল। যেখান থেকে সহজেই ওরা থানা ঘিরে ফেলতে পারবে। তাই অপারেশনের আগেই নির্দেশ দেওয়া হয় দ্রুত আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে সরে পড়ার।
১৭ জুলাই, ১৯৭১। ক্যাম্প থেকে রাত ১১ টার দিকে রওনা হয়ে ১২ টার মধ্যেই পজিশন নিই। প্রথমে আমরাই ফায়ার ওপেন করি। পশ্চিম দিক দিয়ে থানার ভেতর আক্রমণ করি। দুটি বাঙ্কারে দুটি গ্রেনেড চার্জ করে এলএমজি বাঙ্কারে একটি রকেট শেল নিক্ষেপ করা হয়। ফলে তাদের সকলেই মারা পড়ে।
এর মধ্যেই রাজাপুর ও ফকিরেরপুর ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ঘিরে ফেলতে থাকে। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে। কমান্ডার বললেন, উইথ ড্র। আমরা পশ্চিম দিক দিয়ে সরে পড়ার পরিকল্পনা করি।
ওইদিকে দৌড় দিতেই হঠাৎ উত্তর দিক থেকে দুই ঘরের ফাঁকা জায়গা দিয়ে একটা ব্রাশ এসে লাগে আমার বাম পায়ে। প্রথমে মনে হল পা যেন কীসের সঙ্গে বাড়ি খেল। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি লাফ দিয়ে ঘরের দিকেই পড়ে গেলাম। পায়ে কোনো বোধ নাই। পিনপিন করে রক্ত বেরোচ্ছে।
দূরে দেখলাম সেকশন কমান্ডার হাবিলদার তাহেরের দেহ পড়ে আছে। মাথায় গুলি লেগে স্পটেই মারা যান তিনি। সহযোদ্ধারা আমায় কাঁধে তুলে নিয়ে দূরে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। কাঠের তক্তায় শুইয়ে সেখান থেকে খাল পাড়ের নৌকায় তোলে। চারপাশে পাঞ্জাবি সৈন্যরা ওত পেতে ছিল। আমি গোঙাচ্ছিলাম। সহযোদ্ধারা বললেন, ‘কাদের, তুমি আওয়াজ করলে আমরা সবাই মারা পড়ব।’
সেই যে চুপ হয়ে গেলাম তারপর আর কিছুই মনে নেই। সকালের দিকে ক্যাম্পে এবং পরে আমাকে নেওয়া হয় আগরতলার মেলাঘর হাসপাতালে। সেখানে আমার পা থেকে ৮-১০টি গুলি বের করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জিবি হাসপাতালে। ২৬ দিনের মাথায় পায়ে পচন ধরে। কী যে কষ্ট পেয়েছি সে সময়। একবার এক ডাক্তার এসে সেন্সলেস না করেই কেটে পায়ের পুঁজ বের করল। কষ্টে ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। এত কষ্ট পেয়েছি, মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। পরে অপারেশন করে আমার বাম পাটি হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়।’’
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের খানিকটা সময় নিরব থাকেন। তার চোখ দুটো সিক্ত।
দু-একফোটা জল চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে শুধু পা নয়, স্বাধীনতার জন্য কাদেরের মতো বীরেরা উৎসর্গ করেছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু। কিন্তু পেয়েছেন কতটুকু?
প্রশ্ন ছিল যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছিলেন তা কী পেয়েছেন?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘বাবা, স্বাধীনতা পেয়েছি, দেশও পেয়েছি। কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তা তো আজও পাইনি।’’
কেমন দেশ চেয়েছিলেন?
‘‘কেউ কোটিপতি, আর কেউ রাস্তার ফকির। এই রকম বৈষম্যের দেশ তো চাইনি।’’
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। আবদুল কাদের বলেন, ‘‘স্বাধীনের পরপরই এ তালিকা চুড়ান্ত করা যেত। এখন তো অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের নামও উঠেছে তালিকায়। এটা আমাদের জন্য কলঙ্কজনক।’’
তালিকা কেন বাড়ে?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক কারণে ও কিছু মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিস্বার্থে।’’
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হওয়াকে মুক্তিযোদ্ধা কাদের বড় ভুল বলে মনে করেন। তাঁর ভাষায়, ‘‘স্বাধীনের পর আমরা আমাদের আদর্শ ধরে রাখতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান– এই একটি ব্যানারই থাকা উচিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের।’’
যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তাঁর ভাষায়, ‘‘এত বছর পরও যে বিচার হচ্ছে এটাই শান্তি। এ সরকার না হলে এটাও হত না। বিচার নিয়ে টালবাহানা করলে সরকারকেই এর ফল ভোগ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এ বিচার আরও আগেই হত।’’
কিন্তু তিনি তো সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন।
‘‘দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই অভাব বা ভয়ের কারণেই রাজাকার বা শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বড় কোনো অপরাধে যুক্ত হয়নি। বঙ্গবন্ধু তাদেরই ক্ষমা করেছিলেন। যারা হত্যা করেছে, মা-বোনদের ইজ্জত লুটেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, তাদের তো তিনি ক্ষমা করেননি!’’
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী সময়ের কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘‘যে মানুষটি নিজের জীবনের অধিকাংশ সময়ই দেশের জন্য বিলিয়ে দিয়েছিলেন। যার উদ্দীপনায় বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বাদ পেল। পাকিস্তানিরা যাকে মারতে পারল না। অথচ তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় স্বাধীন এ দেশে। জাতির জন্য এরচেয়ে দুঃখের আর কি আছে! আমরা মুক্তিযোদ্ধারাও তখন আতন্কে ছিলাম। সব জায়গায় আমাদের কোনঠাসা করে রাখা হয়েছিল।’’
মুক্তিযোদ্ধা বাবার জন্য গর্ববোধ করেন সালাউদ্দিন
পচাঁত্তরের পর রাজাকাররা রাজনীতিতে পাকাপোক্ত আসন গাড়ে। এক সময় তারা এ দেশেরই রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হন। লালসবুজের পতাকা ওড়ে তাদের গাড়িতে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের কেমন লাগত?
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধা কাদের বলেন, ‘‘এটা ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। জিয়াউর রহমান এদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেন অথচ তিনি নিজেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। যারা আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, মা-বোনদের তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তাদেরই তিনি মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এটা ভাবলেই মাথাটা হেড হয়ে যায়।’’
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন– ‘‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। আমরা যদি প্রকৃত ইসলাম ধর্মের মানুষ হই তবে তো অন্যধর্মের লোকদের ক্ষতি করতে পারি না। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মারামারিও করতে পারি না।’’
মুক্তিযোদ্ধা কাদেরের ছোট ছেলে মোহাম্মদ সালাউদ্দিন মোল্লা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবার জন্য তিনি গর্ববোধ করেন। শুধু বললেন, ‘‘সবাই-ই তার পিতার সন্তান। কিন্তু সবাই বলতে পারে না তার বাবা দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন। আমি পারি। এই বোধটা যখন আসে তখন সত্যিকারভাবে কোনো খারাপ বা স্বার্থচিন্তা কাজ করে না। দেশের জন্য অন্যরকম টান অনুভব করি।’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগা জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা কাদের বলেন, ‘‘যখন দেখি আমার দেশে বড় বড় উন্নয়নকাজ হচ্ছে, তখন খুব ভালো লাগে, গর্ববোধ করি দেশের জন্য।’’
কী করলে দেশটা আরও এগিয়ে যাবে?
‘‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। রাজনীতিবিদরা যদি এটা মনেপ্রাণে পালন করে তবে দেশটা সত্যি বদলে যাবে।’’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের মোল্লার বিশ্বাস পরবর্তী প্রজন্মই এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের উদ্দেশ্যে আশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তোমরাই আশা-ভরসা। মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ একদিন তোমরাই প্রতিষ্ঠিত করবে। যে যেখানেই থাকো দেশের স্বার্থ বড় করে দেখ। সত্যিকারভাবে তাহলেই তোমরা বড় হবে।’’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমের মতামত -বিশ্লেষণ কলামে, মে ৩০, ২০১৪
© 2014 – 2021, https:.