আদিবাসীকলাম

সাঁওতাল বিদ্রোহ

স্কুলমাঠের এক কোণে শহীদ মিনারটি। চুনকাম করে ধুয়েমুছে সাজানো হয়েছে সেটি। রঙিন কাগজ জড়ানো দড়িতে মাঠের চারপাশ ঘেরা। কয়েকশ’ আদিবাসী লাইন করে দাঁড়ানো। হাতে হাতে ফুলের তোড়া। নামিদামি কোনো ফুল নেই। অচেনা ফুলের ভিড়ে মুখ তুলে আছে কয়েকটি জবা। শহীদ মিনারে একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সবাই। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের এই স্কুলটির নাম মহেশপুর উচ্চ বিদ্যালয়। ফুলেল শ্রদ্ধা শেষে শহীদ মিনারের পাশে অপেক্ষারত স্কুলটির একজন শিক্ষক। পরিচয় হয় তার সঙ্গে। নাম তার সানজিলা হেমব্রম। দিনটি ছিল গত বছরের ৩০ জুন। সানজিলার ভাষায় দিনটি ‘সানতাল বিদ্রোহ দিবস’। তাই প্রতি বছরের মতো মহেশপুরেও চলছিল এই আনুষ্ঠানিকতা। এরই মধ্যে একদল সাঁওতাল তীর-ধনুক নিয়ে মাঠে নামে। দূরে থাকা একটি কলাগাছকে লক্ষ্য করে তীর ছোড়ে তারা। সাঁওতালদের ভাষায় এই খেলাটির নাম ‘আ পরী তুইন এনেইদ’। অন্য পাশে দেখি আরেক দল আদিবাসী। চোখে গামছা বেঁধে লাঠির আঘাতে তারা ভেঙে দিচ্ছে দূরে রাখা মাটির হাঁড়িগুলো। সাঁওতালরা একে বলে ‘টুকুই রাপুত এনেইদ’। এই খেলা দুটির মাধ্যমে সাঁওতালরা মূলত অশুভ শক্তির প্রতীকী বিনাশ ঘটায়।
আদিবাসীরা মেতে ওঠে নানা খেলায়। সানজিলার সঙ্গে আমাদের আলাপও জমে ওঠে। কী ঘটেছিল ৩০ জুন? সানজিলার উত্তর, ‘এটা সিদা-কানু দিবস।’ অতঃপর তিনি হড়হড় করে বলতে থাকেন সবকিছু। সিদু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব ছিল চার ভাই। তাদের জন্ম সাঁওতাল পরগনার ভাগনাদিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে। সাঁওতালরা তখন বন কেটে জমি তৈরি করে ফসল ফলাত। আর জমিদারের শকুনদৃষ্টি পড়ত সেই জমিতে। মহাজনদের কাছে সাঁওতালদের দেনার জের মিটত না ১০ গুণ পরিশোধের পরও। তাই সপরিবারে মহাজনের বাড়িতে গোলামি খাটতে হতো তাদের। সাঁওতালরা আদালত আর পুলিশ থেকেও কোনো সাহায্য পেত না। বরং ওরা কাজ করত শোষকশ্রেণীর স্বার্থে। এতে ক্রমেই সাঁওতালদের মনে চাপা ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এক সময় তারা জমিদার, মহাজন আর সরকারকে শত্রু ভাবতে থাকে।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। সিদু-কানুর ডাকে ভাগনাদিহি গ্রামে জড়ো হয় প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষক। সেদিন সিদু-কানুর নেতৃত্বে জুলুমের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা রুখে দাঁড়ানোর শপথ নেয়। বিদ্রোহের আওয়াজ সাঁওতাল ছাড়াও অন্যান্য আদিবাসী ও বাঙালি গরিব কৃষকদেরও মাতিয়ে তোলে। বিদ্রোহীদের অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক, টাঙ্গি, কুঠার আর তলোয়ার। তাদের শক্তি দেখে জমিদার, মহাজন ও ঠকবাজ বেপারীরা পালাতে থাকে। বিদ্রোহীরা ডাক ও রেল বন্ধ করে দেয়। এভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলায়। সাঁওতালদের বিদ্রোহ দমাতে বহরমপুর থেকে সেনাদল আসে মুর্শিদাবাদে। সেখানকার জেলা-শাসক টুগুডে ১৫ জুলাই মহেশপুরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে বিদ্রোহীরা পরাস্ত হয়। ১০ নভেম্বর সামরিক আইন জারি করে জেনারেল লয়েড ও জেনারেল বার্ড ১৪ হাজার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ এলাকা ঘিরে ফেলে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করে তারা বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করে। নভেম্বরের শেষ ভাগে জামতাড়া এলাকা থেকে বন্দি হয় কানু। সিদু ধরা পড়ে তার আগেই ঘাটিয়ারিতে। পরে তাকে ভাগনাদিহি গ্রামে নিয়ে হত্যা করা হয়। কানুর বিচার হয় আদালতে। বিচারে তাকেও হত্যা করা হয় গুলি করে।
সিদু-কানু কি পরাজিত হয়েছিল? উত্তরে সানজিলা বলেন, ‘না তো।’ সরাসরি বিজয়ী না হলেও সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের বসবাসের জন্য রাজমহল ও দামিন-ই-কো এলাকাসমেত বীরভূম ও ভাগলপুর জেলার বিস্তৃত অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামের একটি নতুন জেলা গঠন করে। মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল হয়। সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ও ভারতের কৃষক-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে শুধু উজ্জ্বল আর গৌরবান্বিতই করেনি; বরং বিদ্রোহীদের বীরত্ব কাহিনী পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহকেও প্রেরণা জুগিয়েছিল। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, তাদের সত্তায় সিদু-কানু বারবার ফিরে আসে। আজও অন্যায়, অত্যাচার আর নানামুখী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের রুখে দাঁড়ানোর প্রাণশক্তি সিদু-কানু।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকালে, ৩০ জুন ২০১৪

WARNING :
If anyone wants to share this content, please contact me. If any unauthorised use or reproduction of salekkhokon.me content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

© 2014 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button