আদিবাসী

দোকানে তাদের জন্য আলাদা গ্লাস!

সূর্যটা তখন ডুবুডুবু। আমরা গোলাই গ্রামে। এটি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর একটি আদিবাসী গ্রাম। পাহাড়িয়া বা পাহাড়িরা গোত্র প্রধানকে বলে মোড়ল। এখানকার মোড়লের নাম রঘুনাথ সিং। তার সঙ্গে আমরা ঘুরে দেখছি গ্রামটিকে।
গ্রামের অন্যরা এরই মধ্যে কাজ থেকে ফিরতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পরই সভা বসবে। রক্ষাগোলাকে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল নির্ধারণ হবে আজ। আদিবাসীরা মুষ্টি চালের যে সমিতি তৈরি করেছে তাই রক্ষাগোলা। সবাই আজ বসবে রক্ষাগোলার কার্যালয়েই।
সভা শুরু হতে এখনো অনেক দেরি। এ সুযোগে আমরা আসি মোড়লের বাড়িতে। মাটি আর ছনে ছাওয়া বাড়ির ঘরগুলো। বারান্দায় মাদুর বিছানো বসার জায়গা। বাড়ির ভেতরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গোয়ালঘরটি শোয়ারঘরের সঙ্গেই। পাশেই রান্নাঘর। মোড়ল জানালেন পাহাড়িদের বাড়িগুলো নাকি এমনটাই হয়।
বাড়ির ঠিক মাঝে কয়েকটা সন্ধ্যাতারা ফুলের গাছ। তাদের মাঝে মাথা তুলে দিয়েছে একটি তুলসি। গাছগুলোর গোড়ার দিকটায় মাটি দিয়ে উঁচু ডিবি তৈরি করা। এটি পাহাড়িয়াদের তুলসি দেবতা। গোড়ার মাটিটা লেপে রাখা হয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির মহিলারা ভক্তি দেয় সেখানে। দেবতা পাহাড়িয়াদের কাছে গোসাইনি। সন্ধ্যায় ভক্তি দেওয়াকে এদের ভাষায় ‘কুরিপূজা’ বলে। তখন সন্ধ্যা ছিল। প্রদীপ রেখে, ধূপ জ্বালিয়ে, পানি ছিটিয়ে দেবতার সন্তুষ্টিতে ভক্তি দিচ্ছিল মোড়লের মেয়ে আমতি সিং।
কথায় কথায় মোড়ল বললেন রনজিতের কথা। রক্ষাগোলা রক্ষায় যিনি বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। মোড়লের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। আমরা আগ্রহী হতেই মোড়ল নিয়ে যান তার বাড়িতে।
রনজিতের পুরো নাম রনজিত কুমার সরদার। পিতা বিমল চন্দ্র সাওরিয়া আর মা মিনতি রানীর পুত্র রনজিত পড়াশোনা করছেন বাংলায়। অনার্স করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ‘সিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও রনজিতের নামের শেষে ‘সরদার’ কেন? এমন প্রশ্নে সে মুচকি হাসে। অতঃপর জানান নানা তথ্য।
এক সময় পাহাড়িয়াদের গোত্র ছিল চারটি। রনজিতের ভাষায়, ‘সাওরিয়া, চেটে, কুমড়ে ও মাল।’ নামের শেষের টাইটেল দিয়েই পাহাড়িয়াদের গোত্রকে বোঝানো হয়। রনজিতের মা ‘চেটে’ আর বাবা ‘সাওরিয়া’ গোত্রের। তাই মায়ের নামের শেষে রানী এবং বাবার নামের শেষে টাইটেল হিসেবে সাওরিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্ত সেটিও অনেক আগের রীতি। রনজিত দুঃখের সঙ্গে জানালেন, এখন পাহাড়িয়ারা আর আগের টাইটেলগুলো ব্যবহার করে না। বর্তমানে এরা নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ‘সরদার’ ও ‘সিং’ শব্দ দুটিই ব্যবহার করে। আদিবাসী নিয়মে পিতার টাইটেল হিসেবে রনজিতের নামের শেষেও ‘সাওরিয়া’ যুক্ত থাকার কথা। কিন্তু সবার মতো তিনিও সরদার ব্যবহার করেছেন।
নামের টাইটেল ব্যবহারে ব্যতিক্রমও আছে। জানা গেল মাল পাহাড়িদের কথা। এখনো তারা নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ‘মাল’ শব্দটি ব্যবহার করে। রনজিত জানালেন, সরকারি তালিকায় যে ২৭টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে মাল পাহাড়িও আছে। অথচ মাল পাহাড়িরা পাহাড়িয়া বা পাহাড়িদেরই একটি গোত্র। আলাদা কোনো জাতি নয়।
পাহাড়িয়াদের গোত্রগুলোর কেন এমন নামকরণ? রনজিত বলেন, ‘আগে পাহাড়ি বা পাহাড়িয়ারা ছিল প্রকৃতি পূজারী। সে সময় কোনো পশু, পাখি, গাছ বা প্রাণীর নামে নামকরণ করা হতো গোত্রগুলোর। তারা নিজেদের শরীরেও তার ছবি এঁকে রাখত।
এক সময় পাহাড়িয়াদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে পূর্বপুরুষদের অনেক নিয়ম। এখন শুধু অন্য গোত্রই নয়, অন্য জাতির সঙ্গেও বিয়ে হচ্ছে পাহাড়ি নারী-পুরুষদের। ফলে নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি আদিবাসীদের আদি রীতিনীতিগুলো।
পাহাড়ি হিসেবে নামকরণের একটি তথ্যে আমরা অবাক হই। রনজিতের ভাষায়, ‘আমাদের জাতির আসল নামটিই তো আজ হারিয়ে গেছে! এ জাতির নাম তো পাহাড়ি ছিল না। নাম ছিল ‘তিরিংদাত’।’ খানিকটা নীরবতা অতঃপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস। একে একে রনজিত বলতে থাকে পাহাড়ি বা পাহাড়িয়া আদিবাসীদের নানা অজানা তথ্যগুলো।
পাহাড়িয়াদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতে মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও মালদহো থেকে। জঙ্গল পরিষ্কার ও রেললাইনের কাজের জন্য আসে তারা। সে সময় জমিদাররা তাদের বসিয়ে দেয় বিভিন্ন জায়গায়। তাদের কি নামে ডাকা হবে? পাহাড় থেকে এসেছে বলে সে সময় তাদের ডাকা হতো পাহাড়ি বলে। আর এভাবে ডাকতে ডাকতে হারিয়ে যায় ‘তিরিংদাত’ জাতির নামটি। তিরিংদাত হয়ে যায় পাহাড়ি।
এ গ্রামের আদিবাসীদের কাছেও ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বার বার। কিন্তু অদ্যাবধি তারা সাড়া দেয়নি। পাহাড়িয়াদের অনেকেরই এখনো নিজস্ব বসতভিটা রয়েছে। ফলে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রলোভন তাদের টলাতে পারেনি। কিন্তু  কোনো কোনো পাহাড়িয়া গ্রামের আদিবাসীদের নিজস্ব বসতবাড়ি নেই। অভাবও নিত্যদিনের সঙ্গী। সেসব গ্রামের কেউ কেউ পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে তাদের চিরচেনা জাতধর্মের অনুসারী আপনজনদের সঙ্গে সম্পর্কের দেয়াল হয়েছে পাহাড়সম। এতে পাহাড়িয়া আদিবাসীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে বিভক্তি। ধর্ম ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই পাহাড়িয়ারা হারিয়ে ফেলছে পূর্বপুরুষদের ধর্মকেন্দ্রিক আচারগুলো।
পাহাড়িয়াদের ধর্ম কি? রনজিত উত্তরে বলেন, ‘সনাতন’। তিনি জানালেন, আশপাশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে পাহাড়িয়ারা বর্তমানে  মূর্তিপূজাসহ হিন্দুদের সব আচারই পালন করে থাকে। কিন্তু পাহাড়িয়াদের পূর্বপুরুষরা এক সময় ছিল প্রকৃতি পূজারী। তারা কোনো দেবদেবীর পূজা করত না। যখন যে ফসল হতো তখন সে ফসল গ্রহণের পূর্বে পাহাড়িরা পূজা দিত। সে গাছের নিচে খুঁটি দিয়ে পূজা করা হতো। পাহাড়িয়াদের ভাষায় এটি ‘ঝা-াকুটি’।
রনজিত জানালেন, পাহাড়িরা এখন হিন্দু আচারে অভ্যস্ত। কিন্তু তবু এখনো এখানকার পাহাড়িয়ারা ভুট্টা এবং আমের সময়টিতে পূজা দিয়ে ফলন ঘরে তোলে।
কীভাবে তা করা হয়? রনজিত জানালেন, পূজার আগে ফল বা শস্য খাওয়ার নিয়ম নেই। ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তবে তা গ্রহণ করাই নিয়ম। ভগবানকে ‘গোসাইনি’ ছাড়াও কেউ কেউ বলে ‘পার মাসনি’। গাছের নিচে একটি উঁচু মাটির ডিবি তৈরি করে সেখানে ধূপ, সিন্দুর, কলা, বাতাসা, আমপাতা, আমের কিছু মুকুল, ভুট্টার কিছু ফুল, জল, দুর্বাঘাস, ধান, চাল দিয়ে পূজা করা হয়। পূজার শুরুতে ভগবানের সন্তুষ্টিতে বলি দেওয়া হয় কবুতর। গ্রামের সবাই মিলে এটি করে। তাই একে বলা হয় সরকারি। এছাড়া প্রতি ভোরে এরা সূর্যকে ভক্তি দেয়। এদের কাছে সূর্য হলো ‘বেরি গোসাইনি’।
রনজিতের মতে, শুধু ধর্মান্তরিত হয়েই নয়, সময়ের বিবর্তনে সংখ্যাগুরু ধর্মের প্রভাবেও হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়িয়াদের আদি বিশ্বাস ও আচারগুলো। অন্য জাতির কৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়িদের নিজস্ব কৃষ্টিগুলো।
পাহাড়ি আদিবাসী গ্রামটিতে শিক্ষার হার অনেক কম। শুধু আর্থিক দৈন্যই নয়, অসচেতনতাও এর মূল কারণ। রনজিত বলেন, ‘আদিবাসী শিশুরা বিদ্যালয়ে গেলেও অনেকেই ঝরে পড়ে। পড়াশোনা করতে হয় বাংলায়। আমাদের ভাষাটা অনেক দিন আগেই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এখন শিশুদের বাংলায় পড়তে ততটা কষ্ট হয় না।’
পাহাড়িদের ভাষার ব্যবহার একেবারেই কমে যাচ্ছে। বয়স্করা কথা বলছে পাহাড়ি ভাষায়। কিন্তু যাদের বয়স ত্রিশের মতো, তারা সবাই কথা বলে বাংলায়। তবুও নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভাষা পাহাড়িরা হারাতে চায় না। পাহাড়িদের ভাষার কোনো বর্ণ নেই। মাসে একবার এ গ্রামেই চলে শিশুদের পাহাড়ি ভাষা শেখার চেষ্টা।
নিজের জাতি নিয়ে রনজিতের তথ্যজ্ঞান আমাদের মুগ্ধ করে। মোড়ল ও রনজিতসহ আমরা এগোই রক্ষাগোলার কার্যালয়ের দিকে। যেতে যেতে কথা ওঠে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে বৈষম্যের বিষয়টি। রনজিত বলেন, ‘বৈষম্য আচরণে আর চালচলনে। চায়ের দোকানে আমাদের পানি খেতে দেওয়া হতো বদনায়। ভাঙা বা ময়লা কাপে খেতে হতো চা। এখনো আদিবাসীদের জন্য দোকানে রাখা হয় আলাদা গ্লাস। মাঠের কাজে গেলে আগে আদিবাসীদের খাবার জুটত কলা পাতায়।’ নিজের অভিজ্ঞতার কথা রনজিত বলেন ঠিক এভাবে, ‘স্কুলে প্রথম প্রথম কোনো বাঙালি আমার সঙ্গে এক বেঞ্চিতে বসত না। কোনো শিক্ষকের ধমকে বসলেও লক্ষ্য রাখত নিজের শরীর যেন আমার সঙ্গে না লাগে। ধীরে ধীরে যখন ভালো রেজাল্ট করতে থাকি তখন কিছু ছেলে মিশতে থাকে। এখন তো প্রিয় বন্ধুটিই বাঙালি।’
তার মতে, ‘আদিবাসী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই আমাদের দেখা উচিত। শরীর কাটলে উভয়েরই লাল রক্তই বের হবে। সৃষ্টিকর্তা তো পার্থক্য করেননি, তবে কেন এ বৈষম্য?
রনজিতের কথায় আমরা নীরব হয়ে যাই। আদিবাসীদের প্রতি আশপাশের বাঙালিদের আচরণের কথা জেনে লজ্জিত হই। মনে আসে নানা ভাবনা। দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। বৈষম্যমূলক আচরণ তাদের নিত্যপ্রাপ্তি। তবুও নিজের জাতিটাকে বুকের ভেতর বাঁচিয়ে রাখা যাদের মূল লক্ষ্য-সেই আদিবাসীরাই তো সত্যিকারের মানুষ।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক এই সময়ে,

WARNING :
Copyright © 2010 – 2014. All rights of Data, Photographs, Audio & video clips on this site are reserved by SalekKhokon.me. If anyone wants to share this content, please contact me. If any unauthorised use or reproduction of salekkhokon.me content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

© 2014 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button