মুক্তমনাদের কি হত্যা করা যায়!
সবচেয়ে সহজ কাজটি করেছে ওরা। হত্যা করেছে লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। কেন? অভিজিতের লেখায় তাদের গাত্রদাহ হয়েছে। তাই ধর্মের নামে হত্যা করা হয়েছে তাকে। শান্তির ধর্ম ইসলামকে তারা বানিয়েছে হত্যার ধর্ম। কেমন করে হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎকে। পেছন থেকে ধারালো চাপাতির আঘাতে। সামনা-সামনি হওয়ার মানসিক শক্তি হয়তো তাদের ছিল না। তাই কাপুরুষের মতো, পেছন থেকে অস্ত্রের আঘাতেই তাকে মেরেছে তারা!
হত্যাকারীরা কি লেখাপড়া জানত? তারা কি অভিজিতের লেখার যুক্তি খণ্ডন করে কোনও লেখা লিখেছেন? না। সে জ্ঞান ও বুদ্ধি কোনোটাই তাদের নেই। তাই বেছে নিয়েছে সহজ কাজটিকে- পেছন থেকে আঘাত করে হত্যা।
এর আগেও ওরা হত্যা করেছিল। একইভাবে হত্যা করেছিল ব্লগার রাজীব হায়দারকে, আক্রমণ করা হয়েছিল ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে আর ১১ বছর আগে একইভাবে পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করেছিল হুমায়ুন আজাদকেও। পরে তারও মৃত্যু হয়। অভিজিতকে তারা চিনত। কিন্তু অভিজিত, সে কি চিনত এই নরপশুদের? যদি তাই হতো, তবে কি এভাবে খুব সহজেই তারা হত্যা করতে পারত অভিজিতকে। কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার খবরে দেখলাম জঙ্গী সংগঠন ‘আনসার বাংলা সেভেন’ এর নামটি। যারা অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করে এটিকে বিজয় উল্লেখ করে উল্লাস প্রকাশ করেছে। এর আগেও আমরা নাম শুনেছি- ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ ও ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ জঙ্গী সংগঠনটির।
কি এদের কাজ? ইসলামের নামে নিজের পরিচয় আড়াল করে পেছন থেকে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা। মানুষ হত্যার পর যারা উল্লাস প্রকাশ করে তারা কোন ধর্মের অনুসারী আমার জানা নেই !
বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ নেই, ব্লগার রাজীব নেই, নেই লেখক অভিজিৎ রায়ও। আসলে কি মৃত্যু হয়েছে তাদের ? হুমায়ুন আজাদের লিখা আমাদের অন্তরে গেথে আছে। তাকে বুঝতে এ জাতির অন্তত আরও ২০ বছর সময় লাগবে। আমাদের চিন্তা, চেতনা আর প্রতিবাদে আমরা হুমায়ুন আজাদকে পাই। ব্লগার রাজীবের হত্যার পর গণমানুষের বিস্ফোরণ ঘটেছিল শাহবাগে। লাখ মানুষের কণ্ঠ মিলেছিল একই সুরে। যারা তাকে হত্যা করেছে নিশ্চয়ই তারা তা দেখেছে। অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরই কি সব শেষ হয়ে যাবে? কক্ষনোই না। এরই মধ্যে তার সব বই শুদ্ধস্বর থেকে বিক্রি হয়ে গেছে। অনলাইনে তার লিখাগুলো এ প্রজন্মের শত শত তরুণরা খুঁজে ফিরছে। মুক্তমনা মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে মিছিল হচ্ছে, যেখানে অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে পড়েছে ফুলেল শ্রদ্ধা। মোমবাতি জ্বালিয়ে তার প্রতি সম্মান জানানো হচ্ছে। অনলাইনে চলছে নানা প্রতিবাদ। তরুণরা লিখছেন, বলছেন, মিছিল করছেন- ধর্মান্ধতা আর জঙ্গীদের বিরুদ্ধে, মুক্তমনার পক্ষে। অভিজিতের জন্য যে চেতনাটুকু জাগ্রত হচ্ছে এটাকে কি হত্যা করতে পারবে ওরা। কতজনকে হত্যা করবে? মুক্তমনাদের কি হত্যা করা যায়!
অভিজিৎ রায়ের খুনিদের আমরা দেখিনি। ছবিতে দেখেছি রক্তাক্ত হয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকা অভিজিতের লাশের পাশে দাঁড়ানো পুলিশ আর শত শত সাধারণ মানুষকে। যারা এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেনি। আসেনি তাদের চিকিৎসার জন্য সাহায্য করতেও। পরক্ষোভাবে খুনি তারাও। আইন কিন্তু তাই বলে। অভিজিৎ মরে গেছে, কিন্ত প্রশ্ন রেখে গেছে মানবতার আর নিরাপত্তার নামে রাষ্ট্রের উদাসিনতার বিরুদ্ধে।
কেন মরতে হলো অভিজিতকে? রাষ্ট্রের কাছে কি কোনও জবাব আছে? পুলিশের নাকের ডগার ভেতর নিয়ে অভিজিৎকে হত্যা করে পালিয়ে গেল হত্যাকারীরা। এখনও কোনও আসামি গ্রেফতার হয়নি। দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি কোনও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনও কোনও কথা বলেননি। এগার বছরেও হুমায়ুন আজাদ আজাদের হত্যাকারিদের বিচার হয়নি। বিচার হয়নি ব্লগার রাজিবের হত্যাকারিদেরও। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আসামীদেরও জামিন দেওয়া হয়েছে।
আমরা দেখেছি, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির হাত ধরেই এদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটেছে। কিন্তু তবুও, এখনও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং ভোটের রাজনীতির কারণে এক ধরণের আনুকূল্যই পাচ্ছেন ধর্মান্ধরা। সেই আনুকূল্যের ভেতর দিয়েই পরক্ষোভাবে বেড়ে উঠছে জঙ্গীরা। প্রশ্ন হলো- সরকার কি সেটা জানে না, বোঝে না? তাহলে আর কয়টা অভিজিৎ লাশ হলে সরকারের টনক নড়বে?
ছবিটি বিডিনিউজ২৪.কম থেকে নেওয়া।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন-এ দুপুর ০১:৩৭ মার্চ ০২, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.