চাপাতির আঘাতে কি থেমে যাবে মুক্তচিন্তার কলম?
দিন কয়েক ধরেই বেশ আতঙ্কে ভুগছি। প্রকাশ্যে একজন ব্লগারকে মাথায়, মুখে ও গলায় আঘাত করে, জবাই করে হত্যা করবে- এমনটা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছি না।পরিচিতজনদের মুখে-মুখে প্রশ্ন। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনের ভেতরও। কিন্তু উত্তর মিলে না। প্রশ্নগুলো তাই প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়।
লেখক ও ব্লগার অভিজিতের মতোই প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। নামকরা ব্লগার তিনি নন। বরং তিনি সরব ছিলেন ফেসবুকে। কী তার অপরাধ? নানা কথায় তিনি প্রতিবাদ করেছেন অভিজিৎ হত্যার বিরুদ্ধে, মৌলবাদী আর ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। এ সমাজে বহু চিন্তার মানুষ থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু না, তা মেনে নিতে পারে না ধর্মান্ধ উগ্র জঙ্গিরা। তারা ছাড়া অন্য চিন্তার মানুষকে তারা মেনে নেয় না। বাবুর লেখায় তাদের গাত্রদাহ হয়েছে। তাই অভিজিতের মতোই বাবুকেও মাথায় ও মুখে চাপাতির আঘাতে নিহত হতে হয়েছে।
ব্লগার বাবুকে খুব সহজে গুলি করে কেউ পালিয়ে যায়নি। বরং মধ্যযুগীয় অস্ত্র চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবেই হত্যা করছে মুক্তচিন্তার মানুষদের। শুধু হত্যা নয়, এর মাধ্যমে তারা সমাজকে তাদের হিংস্রতা আর নির্মমতার বার্তা দিচ্ছে।ব্যক্তিকে হত্যার মাধ্যমে তারা হত্যা করছে মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা আর আমাদের মুক্তচিন্তার মানসিকতাকে। মানুষ হত্যা করে তারা নিজেদের শক্তিটাকেই সবার কাছে জানান দিচ্ছে।
কারা হত্যা করেছে ব্লগার বাবুকে? জঙ্গিরা। একইভাবে যারা হত্যা করেছিল হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজিব, অভিজিৎকে। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে এসব হত্যাকাণ্ডের ধরন ও উদ্দেশ্য হুবহু একই। হত্যার পর পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের দুই মাদ্রাসা ছাত্র। গণমাধ্যমে তাদের ভাষ্য আমাদের মনে নানা ভয় ও নানা প্রশ্নের উদ্ভব ঘটায়। তারা কখনোই জানে না ব্লগার বাবু কী লিখতেন? তার লেখাও পড়েনি তারা। হুকুমদাতার মুখে শুধু শুনেছেন বাবু ইসলামের শত্রু। তাই তাকে হত্যা করে তারা ঈমানের দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। কিছু মানুষ ধর্মের নামে মাদ্রাসা পড়ুয়া কিছু যুবককে হিপনোটাইজ করে কিলিং মিশন পরিচালনা করছেন। মানবতার ধর্মে তারা বিশ্বাসী নন। হত্যাই তাদের ধর্ম। যা কোনও ধর্মেই বৈধ নয়!কাকে হত্যা করেছে জঙ্গিরা? একজন ব্লগারকে। ব্লগার মানেই নাস্তিক, ইসলামবিরোধী- এমন ধারণা অনেক শিক্ষিতজনের মনেও বদ্ধমূল হয়ে আছে। ব্লগে লেখার অর্থই নাস্তিকতা নয়। বরং যারা হত্যাকাণ্ডগুলো পরিচালনা করছে তারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি ব্লগে সরব। একটি হত্যার সঙ্গে-সঙ্গেই তারা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর ছড়াতে থাকে ওই ব্লগার ইসলাম ধর্মের কী ক্ষতি করেছেন, কী লিখেছেন। লেখাগুলোর অপরাধেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। অতএব এই হত্যাও জায়েজ। এভাবে হত্যার বৈধতা তৈরি করতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিছুটা সফলও হয়। হত্যার অপরাধটিকে ভুলে অনেকেই তার লেখার বিচার বিশ্লেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই শুধু জঙ্গিরাই নয়, এভাবে আমরাও ওই ব্লগারকে, মুক্তচিন্তার মানুষকে আরেকবার হত্যা করছি। এভাবে আমরাও বৈধতা দিচ্ছি ধর্মান্ধ আর উগ্র জঙ্গিবাদকে!
অভিজিৎ হত্যার মাত্র একমাসের মাথায় কেন আরেকটি হত্যার ঘটনা ঘটল? এমন প্রশ্ন সবার মনে। উত্তরটি খুব সহজ। বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রের আন্তরিকতা। অতীতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কোনওটিরই সুরাহা আমরা করতে পারিনি। বরং তদন্ত নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা। সে সুযোগে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে উগ্রজঙ্গিরা। এভাবে ধীরে-ধীরে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে তারা।
ধর্মের নামে মানুষ হত্যার ঘটনাগুলোই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তি কিংবা রাজনীতিকদের সুস্পষ্ট বক্তব্য আমরা পাইনি। অথচ রাজনীতির মাঠে তারা বলেন, জঙ্গিবাদের বিপক্ষে তারা। অভিজিৎ হত্যার পর তার বাবা অজয় রায় জানিয়েছেন, তাকে ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দু’চারজন মন্ত্রীও নাকি বাড়ি পর্যন্ত এসেছিলেন। কিন্তু তা হয়েছে চুপিসারে। কেন? তারা যে অভিজিতের হত্যায় ব্যথিত হয়েছেন, এমন হত্যাকাণ্ড তারা যে চান না, সেটি প্রকাশ করতে ভয় কিসের? এটি কি কোনও রাজনৈতিক কৌশল? রাজনীতি কিংবা ক্ষমতায় ধর্মকেন্দ্রিক সমর্থন নিয়ে টিকে থাকা! কিন্তু কৌশল আর আপসকামিতা যে এক নয়, তারা কি তা ভেবে দেখেছেন!
অভিজিতের মতো ব্লগার বাবুর হত্যাকাণ্ড নিয়েও সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য আমরা এখনও পাইনি। যারা প্রকাশ্যে ধর্মের নামে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তাদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে উগ্রজঙ্গিবাদ রাজনীতির ডালপালা বেয়ে আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। প্রতিবছর, প্রতিমাসে কিংবা প্রতিদিনে ধর্মের নামে তারা হত্যা করবে একেকজনকে। মানুষের বাকস্বাধীনতা হবে রুদ্ধ। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে সে অন্যায় কিন্তু সবাইকেই এক সময় স্পর্শ করবে। তখন হত্যার মতো অধর্মের কাজগুলোও সমাজে একের পর এক ঘটতে থাকবে।
লাখো শহীদের রক্ত আর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আমরা বলি। যার মূল ভিত্তি হচ্ছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। সরকার দাবি করে, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেন। যদি তাই হয়, তবে তো বাস্তবেই তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিকতার মতো মূল ভিত্তিগুলোর প্রতি। বাস্তবে কিন্তু আমরা তা দেখছি না। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ কিংবা ধর্মান্ধতার উত্থানের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকির মুখে পড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদেরই।
এদেশের অনেক বেশি লোক চায় অসাম্প্রদায়িক হিসেবে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে। তাই উচিত ধর্মের নামে মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে, উগ্রজঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে চাপাতির আঘাতে মানুষকে হত্যা করা যায় বটে, কিন্তু তার চিন্তাকে নয়। চাপাতির আঘাতে কি থেমে যাবে, মুক্তচিন্তার কলম?
ছবি : বিবিসি বাংলা
প্রকাশিত: বাংলা ট্রিবিউন-এ, রাত ০৮:০১ এপ্রিল ০৫, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.