ভ্রমণকথা

বৈশাখের টানে আদিবাসী গ্রামে

গত বছরের কথা। বন্ধু কাজিম থাকেন দিনাজপুরে। সে ভরসায়ই পা রাখি সেখানে। রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ। আমরা পৌঁছি ঠিক সন্ধ্যার দিকে।
রাতের খাবারের গন্তব্য ছিল রুস্তম হোটেল। পেঁয়াজের সালাদে গরু ভুনা, আহা! এরপর মালেকের দোকানের মালাইয়ের চা। এখনো যেন মুখে লেগে আছে!

আদিবাসী গ্রামগুলোর বৈশাখের গ্রাম্য মেলায় ঘুরে বেড়াব। পরিকল্পনা আগেরই, আয়োজন সব কাজিমেরই। পরদিন সকাল ৭টা। কাজিমের মোটরসাইকেল ছুটে চলে বিরল উপজেলার বহবলদীঘির দিকে। আমাদের পথ চিনিয়ে নেন চারণকবি ও স্থানীয় সাংবাদিক কুদ্দুস।
পথে পথে প্রকৃতির সবুজ আলিঙ্গন। রাস্তার পাশেই নানা সাজপোশাকে মানুষের জটলা। দু-একটি জায়গায় বসেছে বৈশাখী মেলা। মুড়ি-মুড়কি আর নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই বহবলদীঘিতে, ভুনজারদের আদিবাসী পাড়াটিতে। গোত্রপ্রধান বাতাসু ভুনজার। তাঁর বাড়িতে ঢুকেই থ হয়ে যাই! তুলসীতলায় সত্তরোর্ধ্ব এক নারী ভক্তি দিচ্ছেন। চারপাশে অন্য নারীরা। মাটিতে বেশ কয়েকটি সিঁদুর ফোঁটা। আশপাশের মেঝেতে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে অনেক ফুল।
ভক্তিপর্ব শেষ হতেই মাদলে টুং টাং শব্দ। ছোট্ট দুটি ছেলে কাঁধে তুলে নিয়েছে মাদল আর ঢোল। বাজানোর আপ্রাণ চেষ্টা তাদের। তাল না উঠলেও তাদের আনন্দটুকুই আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়।
বাতাসুর ভুনজার জানালেন, বৈশাখ উদ্যাপনের অংশ হিসেবেই ভুনজারদের একটি দল তীর-ধনুক নিয়ে নাকি বেরিয়ে পড়েছে শিকারে। এটাই তাদের আদি রীতি। শুনেই আফসোস হয়। ইস, যদি আরেকটু আগে আসতে পারতাম! শিকারের সঙ্গী হতে পারতাম।
চৈত্র মাসের শেষ দিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে ভুনজাররা পালন করে বিশেষ আচারের মাধ্যমে। তাদের ভাষায়, এটি ‘চৈত-বিসিমা উৎসব’। এ উৎসবের অংশ হিসেবে এরা চৈত্র মাসের শেষ সন্ধ্যায় ‘বাসন্তী পূজা’ করে। কেন এ পূজা? মুচকি হেসে বাতাসু বলেন, একসময় আদিবাসী গ্রামগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। তখন ডায়রিয়া আর বসন্তে মারা যেত শত শত লোক। এ রোগ দুটি থেকে মুক্তি পেতেই ভুনজাররা মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারিকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের পূজা করে। বসন্ত রোগ থেকে মুক্তির পূজা বলেই এর নাম হয়েছে বাসন্তী পূজা। কেউ কেউ এ দিনেই বলি দেয় মানতের হাঁস-মুরগি কিংবা পাঁঠা। এর আগে চৈত্রের শেষ শুক্রবার এরা উপোস থাকে। উদ্দেশ্য ঠাকুরের সন্তুষ্টি ও রুজি বৃদ্ধি। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই ফলমূল আর দুধ।
বাসন্তী পূজা শেষে ভুনজাররা কালাইসহ নানা ধরনের ছাতু-গুড় খেয়ে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে ওঠে। তাই গত রাত থেকে চলছে ঝুমুর নাচ। হঠাৎ বাতাসুর ছেলে রবি ভুনজারে কণ্ঠে সুর ওঠে। সবার দৃষ্টি পড়ে তাতে-
‘পানের ডেলা পানে রইল
সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল, মা
সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল
হে সেবেল, সেবেল, ওয়াহাগলে, ওহাগলে, হে…’
গানের তালে নাচ শুরু করে একদল নারী। দলবেঁধে হাত ধরাধরি করে নাচছে তারা। মুগ্ধ হয়ে আমরা তখন ব্যস্ত হই ছবি তোলায়।
বৈশাখের প্রথম প্রহরে ভুনজাররা কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে সেরে নেয় পান্তা খাওয়া। তাদের বিশ্বাস, পান্তা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও তারা কষ্ট পাবে না। পান্তার পানি বছরজুড়ে শরীরকে ঠাণ্ডা রাখবে। শিকার থেকে ফিরে ওই দিন বিকেলেই শিকারগুলো দিয়ে এরা খিচুড়ি রান্না করে খায়। রাতভর চলে নাচ-গান আর প্রিয় পানীয় ‘হাঁড়িয়া’ খাওয়া। সে অনুষ্ঠানে বাতাসু আমাদের নিমন্ত্রণ করে। মনের ভেতর আফসোস পুষে হাসিমুখে আমরা বিদায় নিই। রওনা হই কালিয়াগঞ্জের পথ ধরে।
আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। অতঃপর সীমান্তবর্তী বিশাল শালবন। লাল মাটির পথ পেরিয়ে পৌঁছে যাই শালবনের গহিনে। চারপাশে গা ছমছমে পরিবেশ। বাতাসে শালপাতার শব্দে আমরাও আন্দোলিত হই।
বনের ভেতরেই খুঁজে পাই মুণ্ডা পাহানদের একটি আদিবাসী পাড়া। তাদের ঘরগুলো মাটি আর ছনে ছাওয়া। একটি বাড়ির মাদুর বেছানো মেঝেতে জায়গা হয় আমাদের। চৈত্র-বৈশাখের উৎসব নিয়ে কথা চলে সবুজ পাহানের সঙ্গে।
বৈশাখের প্রথম দিনে আদি রীতি অনুসারে মুণ্ডা পাহানদের ভাতের সঙ্গে খেতে হয় বারো ভাজা অর্থাৎ ১২ পদের তরকারি। ওই দিন সকালে এরাও পান্তা খায়। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে চলে নাচ-গানের আসর।
সবুজকে প্রশ্ন করি, ‘কেন পান্তা খান?’ প্রশ্নের উত্তর আসে গানে সুরে-
‘হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই
পন্তা ভাত ভালোবাসি…’
গানে আমরা বেশ মজে যাই।
বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষ দিনেও মুণ্ডা পাহানরা আয়োজন করে নানা আচারের। ওই দিন তারা বাড়িঘর পরিষ্কার করে একে অপরের গায়ে কাদা আর রং ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাদা বা রং দেওয়া হয়, তাকেই খেতে দিতে হয় ‘হাঁড়িয়া’। এদের বিশ্বাস, এতে বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষ দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে এরা বলে ‘সিরুয়া বিসুয়া।
দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। হাঁড়িয়া খেতে খেতে মুণ্ডারা শুরু করে নাচ-গানের পর্বটি। বৈশাখের আনন্দে সুর ওঠে আদিবাসীদের ঢোল-মাদলে। শালবনের নীরবতা ভাঙে আদিবাসী কণ্ঠে।
বিদায় নিয়ে অন্য গ্রামের পথ ধরি। গন্তব্য এবার লোহাডাঙ্গায়। তুরিদের আদিবাসী পাড়ায়। যখন পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যা হলো বলে। কীর্তন চলছে গোটা পাড়ায়। জটলা ঠেলে ভেতরে যেতেই দেখা হয় গোত্রপ্রধান লবানু সিংয়ের। তিনি জানালেন, চৈত্র মাসের শেষ পাঁচ দিন তুরিরা পালন করে চৈতাবালির অনুষ্ঠান। শুরুর দিন এরা ছাতুগুড় খেয়ে নাচ-গান করে। চৈত্রের শেষ দিন এরা সাত পদ দিয়ে ভোজ সেরে চৈত্রকে বিদায় জানায়। চলে নাচ-গান ও হাঁড়িয়া খাওয়াও। বৈশাখ শুরু হতেই তুরিদের মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ থাকে। পুরো এক মাস এরা নিরামিষ খায়। এ সময় প্রতি রাতেই চলে কীর্তন। বৈশাখের শেষের দিকে এরা প্রতি বাড়ি থেকে চাল তুলে একত্রে খিচুড়ি রান্না করে। রাতভর চলে আনন্দ-নৃত্য।
তুরিপাড়ার কীর্তন তখনো চলছে। জোনাকির আলো ভেঙে আমরা শহরের পথ ধরি। দূর থেকে ভেসে আসে আদিবাসী কণ্ঠগুলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠের এ টু জেট পাতায়, প্রকাশকাল: ১৩ এপ্রিল ২০১৫

© 2015 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button