মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিভেদ ছিল না

এক্সরে রিপোর্টে শ্বাসনালীর ভেতরে থাকা গুলি
এক্সরে রিপোর্টে শ্বাসনালীর ভেতরে থাকা গুলি

প্রকৃতির ছোঁয়াতে বেড়ে ওঠেন ধীরেন্দ্র। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ডানপিটে। গাছের মগডালে বসে পেয়ারা খাওয়া আর বন্ধু রসু, সাধন, রবীন্দ্র ও ইজ্জাত আলীর সঙ্গে মাছধরাতেই ছিল আনন্দ। ডাউকি নদীর তীরে ধীরেন্দ্রর গ্রাম। বড় বড় কদম গাছ ছিল নদীর ঘাটে। দুপুরের প্রখর রোদে কদমের ছায়াতলে বসে বাঁশি বাজাতেন তিনি। বাঁশির সুরে যেন ঢেউ উঠত নদীর জলে।
গ্রামে থাকতেন কালিমাইস্য দাশ, নামকরা দোতারা বাদক। তাঁর কাছ থেকেই ধীরেন্দ্র শিখে নেন দোতারাটা। বাঁশি আর দোতারায় সুর তুলতেন হামেশা। তাতে বন্ধুদের কাছ থেকে মিলত বাড়তি কদর। আনন্দ-হাসি-আড্ডায় এভাবেই কেটে যায় ধীরেন্দ্রর দিনগুলো।
তখন ঊনিশ’শ পয়ষট্টি সাল। ক্ষমতায় ছিলেন ইয়াহিয়া খান। চলছে মার্শাল ল। মানুষ তখন আর্মিদের ভয়ে তটস্থ থাকত। ওদের আসার খবর পেলেই পাল্টে যেত গ্রামের চেহারা। মুহূর্তের মধ্যে পারিষ্কার করা হয়ে যেত গ্রামের ছোট ছোট ডোবার কচুরিপানা।
ধীরেন্দ্র তখন আটপাড়া প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। হেডমাস্টারের রুমে টাঙ্গানো ছিল ইয়াহিয়ার বড় একটি ছবি। বন্ধুদের নিয়ে একদিন মতলব আঁটেন। ছুটির পর ইয়াহিয়ার ছবিতে ঝুলিয়ে দিয়ে আসেন ছেঁড়া একটি স্যান্ডেল। এ খবর পরদিন গোটা স্কুলে জানাজানি হয়ে যায়। বেত খেতে হয় ধীরেন্দ্রকে। কিন্তু বেতের আঘাতের চেয়ে আত্মতৃপ্তির বোধটা সেদিন তিনি বেশি অনুভব করেছিলেন তিনি।
সত্তরের নির্বাচনের সময় শেখ মুজিব এসেছিলেন সাতনা বাজারে। বঙ্গবন্ধুকে তখনই প্রথম দেখেন ধীরেন্দ্র। তাঁর ভাষায়: ‘‘এমন নেতা কখনও দেখিনি। যেমন ফিগার তেমন তার কণ্ঠ।’’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তিনি শোনেন রেডিওতে– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ওই দিনের নির্দেশেই তিনি বুঝে ফেলেন সংগ্রাম ছাড়া উপায় নেই।

এভাবেই পেছন দিকে কেটে ধীরেন্দ্রর শরীর থেকে গুলি বের করা হয়
এভাবেই পেছন দিকে কেটে ধীরেন্দ্রর শরীর থেকে গুলি বের করা হয়

যুদ্ধদিনের কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র কুমার দেবের মুখে। পিতার নাম দ্বিজেন্দ্র কুমার দে এবং মাতা শান্তি রানী দে। বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার মুলারগাঁও গ্রামে। দুই ভাই ও এক বোনের সংসারে ধীরেন্দ্র ছিলেন সবার বড়। তিনি পড়াশোনা করেছেন ক্লাস সেভেন পর্যন্ত।
কথার পিঠে আমাদের কথা চলে। পঁচিশে মার্চ-পরবর্তী সময়টার কথা বললেন। তাঁর ভাষায়:
‘‘ঢাকায় আর্মি নামার খবর তখনও আমরা পাইনি। পাশের বাড়ির আসাদ্দোর আলীর কাছে ছিল একটা পুরানা রেডিও। আমরা সেটাতে ব্যাটারি লাগিয়ে অন করি ২৭ মার্চ রাতে। সে সময় শুনি মেজর জিয়ার কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি। জিয়াকে তখন চিনি না। তবে সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকেরা মুক্তিযুদ্ধে আছেন এটা জেনেই সেদিন আমাদের মনোবল বেড়ে গিয়েছিল।’’
যুদ্ধে গেলেন কোন সময়টাতে?
ধীরেন্দ্র বলেন:
‘‘পাকিস্তানি সেনারা তখন গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দলে দলে মানুষ ভিড় জমায় সীমান্তপথে। জীবন বাঁচাতে সবাই চলে যাচ্ছে ভারতে। কিন্তু দেশ থাকছে শক্রর দখলে। এসব দেখে ঠিক থাকতে পারি না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। ৩ এপ্রিল, ১৯৭১। কাউকে কিছু না জানিয়ে দুপুরের পর বাংলাবাজার সীমান্ত হয়ে চলে আসি ভারতের বালাটে। সঙ্গে ছিলেন গ্রামেরই আরও ১১ যুবক। সেখানে আলফাত মোক্তার আমাদের রিক্রুট করেন। ১২ জন নাম লেখালেও রিক্রুটিং ক্যাম্প থেকে ভয়ে পালিয়ে যায় অনেকে। কিন্তু শহীদ আলী, মজুমদার আর আমি নিজ নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকি। বাড়ি ফিরে গেলেও মরব, যুদ্ধ করলেও মরব। তাই মুক্তিযুদ্ধ করেই মরা ভালো।
এভাবে প্রতি রাতেই ছেলেরা পালিয়ে যাচ্ছিল। ফলে কোনোভাবেই আড়াইশ জন হচ্ছিল না। আমাদের ট্রেনিং তাই বিলম্বিত হয়। পনের দিন পর আড়াইশ পূর্ণ হলে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইকো ওয়ান ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ছিল মেঘালয়ের দুর্গম পাহাড়ের ভেতর। ভারতের রাজপুত ও গুগরা রেজিমেন্টের অধীনে আমরা ট্রেনিং নিই তিন সপ্তাহ। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল ০৭০৭৫৩। ট্রেনিংয়ের সময়টাতে একবার এসেছিলেন আতাউল গণি ওসমানী। উৎসাহ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা ভালোভাবে ট্রেনিং শেষ কর। নিশ্চয়ই আমরা সবাই মিলে দেশটা স্বাধীন করব।’’’
কোথায় কোথায় অপারেশন করেন?
‘‘ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠানো হয় শিলং ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকে মিলে অস্ত্র। অতঃপর চলে আসি প্রথমে বালাট সাব সেক্টরে; পরে বনগাঁ নাইকনতলায়। ৫ নং সেক্টরের সি কোম্পানির হেডকোয়ার্টার ছিল সেখানে। দায়িত্বে ছিলেন এনামুল হক চৌধুরী বীর প্রতীক। আমরা ডিফেন্স গাড়ি বৈশেরপাড়। পাকিস্তানি আর্মির ডিফেন্স ছিল বেরিগাঁ ষোলঘর নামক স্থানে। তিন সপ্তাহ টানা যুদ্ধ করার পর আমাদের রেস্টে পাঠানো হত। আবার ফিরে আসতাম যুদ্ধে। আমার ডিউটি ছিল রাস্তার পাশের বাঙ্কারে। একসঙ্গে থাকতাম ৪ জন। কমান্ডে ছিলেন মান্নান।’’

সাব সেক্টরের রিলিজ সনদ
সাব সেক্টরের রিলিজ সনদ

এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ভেঙে যায় ধীরেন্দ্রর বুকের বামপাশের কলার বোন। গুলিটিও আটকে যায় তাঁর শ্বাসনালীতে। যুদ্ধের পরে তা বের করে আনা হয়। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত সে দিনটিতে জানতে চাই আমরা। খানিক নিরব থেকে ধীরেন্দ্র স্মৃতি থেকে তুলে আনেন চুয়াল্লিশ বছর আগের ওই দিনের কথাগুলো।
‘‘১২ অক্টোবর, ১৯৭১। আমরা মঙ্গলকাটা বাজারের আরও সামনে। রেইকি করে ফিরেছি ফজরের আগে। আমাদের বাঙ্কারটি ছিল টিনের ঘরের ভেতর। সেখানে রেস্টে যাই আমরা। ঘন্টাখানিক পর ঘরের মধ্যে বিকট শব্দ। হুড়মুড় করে উঠে পড়ি। ঘরের চালটি তখন উড়ে গেছে। পাকিস্তানিদের মেশিনগানের গুলি আসছে বৃষ্টির মতো।
আমরা তখন পজিশনে চলে যাই। ডানের দিকে ছিল বি কোম্পানির যোদ্ধারা। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে টিকতে পারে না তারা। ফলে তাদের তুলে নেওয়া হয়। আমরা তখনও যুদ্ধ করছি। হঠাৎ ওয়ারলেসে খবর আসে দ্রুত ব্যাক করার। আমরা তাই করি।
ফজরের ঠিক পরেই বৈশেরপাড় হয়ে আমরা মঙ্গলঘাটা বাজারের দিকে এগোই। আমাদের লক্ষ্য করে সেল মারছিল পাকিস্তানি সেনারা। সেলগুলো পানিতে পড়ায় বার্স্ট হল না। তাই আমরা হাওড়ের গলাপানিতে নেমেই এগোতে থাকি। দূর থেকে তা দেখে পাকিস্তানি সেনারা চেঁচিয়ে বলে, ‘ওই মুজিব কা বাচ্চা, ঠের।’ প্রত্যুত্তরে আমরাও বলি, ‘পাঞ্জাব কা বাচ্চা, সামনে আ যা।’
মঙ্গলঘাটা বাজারে আসতেই দেখা পাই ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের। তিনি ছিলেন বালাট সাব-সেক্টরের কমান্ডার। নির্দেশ করলেন শত্রুর দিকে অ্যাডভান্স হতে। দলে তখন অনেক যোদ্ধা। আমরা উৎসাহ নিয়ে সামনে এগোই। মাত্র পঞ্চাশ গজ সামনে যেতেই ব্রাশফায়ারের মুখে পড়ি। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে আমার দিকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করছিল। পাশে ছিলেন এলএমজিম্যান আবু লাইস। সে চিৎকার করে বলল, ‘তুই টার্গেটে পড়ে গেছিস।’ আশ্রয় নিই একটি কলাগাছের আড়ালে। গুলি ছুঁড়ছিলাম পূর্বদিকে মুখ করে। হঠাৎ একটি গুলি কলাগাছ ভেদ করে আমার এসএলআরের ডাঁট ভেঙে বুকের বাম দিকে বিদ্ধ হয়। চিত হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। ফলে গুলিটি বেরিয়ে না গিয়ে ভেতরে শ্বাসনালীতে আটকে যায়। আমার বুক থেকে তিরতির করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল কলাগাছে। রক্তে লাল হয়ে যায় পুরো গাছ। বড় বড় নিঃশ্বাস নিই। মনে হচ্ছিল দম চলে যাচ্ছে। আবু লাইস দৌড়ে এসে গামছা দিয়ে বুকে চেপে ধরে। অমনি দম ফিরে পাই। বিড়বিড় করে বলি, ‘ভাই, একটু পানি দে’। আবু লাইস নিরব থাকে। ওস্তাদদের নির্দেশ ছিল গুলি খেলে পানি দেওয়া যাবে না। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভাইয়ের মতো বুকে জড়িয়ে বলে, ‘ধীরেন্দ্র, ভাবিস না। আমি তোকে ঠিকই ক্যাম্পে নিয়ে যাব।’ আমাকে কাঁধে নিয়ে বহু কষ্টে সে পেছনে সরে আসে। অতঃপর একটি ছোট্ট নৌকায় নদীপথে চলে আসে বালাটে। আমার তখন জ্ঞান নেই। জ্ঞান ফিরেছিল ত্রিশ ঘণ্টা পর। বালাট থেকে আসি শিলং হাসপাতালে। তখনও গুলিটি বের করা সম্ভব হয়নি। ১৫ দিন পর চিকিৎসকদের না জানিয়েই আবারও যুদ্ধে ফিরি, চলে আসি বনগাঁ ক্যাম্পে।’’
গুলিটা কি বের করা গিয়েছিল?
‘‘শ্বাসনালীর ভেতরে গুলি থাকায় আমি এক সাইড হয়ে ঘুমাতে পারতাম না। হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছিল প্রবলভাবে। স্বাধীনতার পর সরকারিভাবে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হাঙ্গেরিতে। সেখানকার হাসপাতালে চলে অপারেশন। পিঠের বেশ খানিকটা জায়গা কেটে বের করে আনা হয় ওই গুলিটি। সে পর্যন্ত গুলিটি ভেতরেই ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের গুলি শরীরে, ভাবলেই ঠিক থাকতে পারতাম না!’’
এবার চলে আসি দেশ নিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাবনার জগতে। ধর্মনিরেপক্ষতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিভেদ বলতে কিছু ছিল না। মুসলিম বন্ধু আবু লাইসই আমার জীবন বাঁচিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা একজন আরেকজনকে জীবন দিয়ে বাঁচাত। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে আদিবাসী, সেটা বড় কথা ছিল না। যুদ্ধ করলে কিছু পাব এমন চিন্তা তো মাথায় আসেনি। চিন্তা ছিল একটাই, দেশটা স্বাধীন করব।’’
ধীরেন্দ্র দুঃখ নিয়ে বলেন, ‘‘এখন তো ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। ভোটের চিন্তায় সরকারও কঠোর হচ্ছে না। ধর্ম অন্তরের জিনিস। এর মধ্যে হত্যা নেই। সমাজে শিক্ষার আলো বাড়লে ধর্ম নিয়ে ব্যবসাও কমে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, যারা এগুলো করছে তারা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের মানুষ। তারা আজও চায় বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে।’’
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে কথা উঠতেই ধীরেন্দ্র বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পরপরই তালিকা করা উচিত ছিল। তখন সেক্টরে সেক্টরে ছিল লিস্ট। দেশের ভেতরে যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের যাচাই বাছাই করে নিলেই হত। অনেক মুক্তিযোদ্ধা কোনো তালিকাতেই নেই। তালিকা নিয়ে রাজনীতিও হয়েছে। সব সরকারই চেয়েছে তার লোক মুক্তিযোদ্ধা হোক। ফলে তালিকা হয়েছে বিতর্কিত। তবে বর্তমান সরকারের নিয়মে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অবশ্যই বের হয়ে আসবে।’’

স্বাধীন দেশে বিএনপির হাত ধরে রাজাকাররা মন্ত্রী হয়েছে। সেটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না এই যোদ্ধা। বুকের মধ্যে কষ্টের মেঘ জমিয়ে তিনি বললেন, ‘‘কল্পনাই করি নাই স্বাধীনতার শত্রুরা এই দেশের মন্ত্রী হবে। দেশ যদি স্বাধীন না হইত মুক্তিযোদ্ধারা কি এই দেশে থাকতে পারত? সবাইকে মেরে ফেলা হত। অথচ স্বাধীন দেশে আমরা রাজাকারগো মাথায় মুকুট পরিয়ে দিয়েছি। খুব দুঃখ হইত। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আবার এই জিয়াই রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেছে। এটা কেমনে মাইনা নেই বলেন? জিয়ারা তো আমাদের মতো আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। তাই স্বার্থের কারণে খোলস পাল্টাতেও বেশি সময় লাগে নাই!’’
কথা ওঠে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের বিচার নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র তখন আবেগে আপ্লুত হন। চোখের কোণে জমে আনন্দের জল। অতঃপর বললেন, ‘‘এখন মরেও শান্তি পামু। স্বাধীন দেশে রাজাকারগো বিচার হচ্ছে। এদের শক্তি দেখে তো ভাবিনি এদের ছোঁয়া যাবে। তবে রাজাকারগো লাশ এদেশে মাটি দেওয়া উচিত নয়। এরা তো ভালোবাসে পাকিস্তানরে। রাজাকারগো বিচারের জন্য শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের আস্থা আর দোয়া আছে। শেখের মাইয়া প্রমাণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী সৎ আর কঠোর হলে দেশটা পাল্টে যাবে।’’

ধীরেন্দ্রর অনুকূলে হাঙ্গেরির হাসপাতালের সনদ
ধীরেন্দ্রর অনুকূলে হাঙ্গেরির হাসপাতালের সনদ

হরতাল ও অবরোধ প্রসঙ্গে নিজের মতামত অকপটে তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র। তিনি বলেন, ‘‘তারা যদি দেশরে সত্যিকারভাবে ভালোবাসত তবে তো জ্বালাও, পোড়াও, অবরোধ, হরতাল করে মানুষ পুড়িয়ে মারতে পারত না। এটা বর্বরতার লক্ষণ। উচিত জনগণের জন্য রাজনীতি করা। জনগণকে পুড়িয়ে মারার জন্য নয়! উনিশ’শ একাত্তরে পাকিস্তান আমাদের শত্রু ছিল। ভারত ছিল মিত্র। তাই বলে স্বাধীন দেশে ভারতের দাদাগিরিও আমাদের মেনে নিলে চলবে না। দেশের স্বার্থটাই বড় করে দেখতে হবে।’’
মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্রর মেয়ে সুবর্ণা রানি দে। মাস্টার্স শেষ করেছেন সিলেটের মদন মোহন কলেজ থেকে। বাবার ভাতার টাকায় তখন পারিবার চলত না। ফলে লেখাপড়া চালিয়েছেন টিউশনি করে। কষ্ট করতে হয়েছে নানাভাবে। তবু মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান হয়ে তিনি গর্বিত। শুধু বললেন, ‘‘আমি যে এ পর্যন্ত এসেছি সেটি বাবারই অনুপ্রেরণায়। বাবা কাজের প্রতি সৎ থাকার ও দেশকে ভালোবাসার কথা বলতেন। আমি মনে করি, এ প্রজন্মের উচিত আমার বাবার মতো আত্মত্যাগী মানুষদের কথাগুলো জানা।’’
কেমন বাংলাদেশ চান?
এমন প্রশ্নে ঠোটের কোণে একচিলতে হাসি টেনে সুবর্ণা বলেন, ‘‘উন্নত বাংলাদেশ, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।’’
বিভিন্ন জাতির মানুষদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দেখলে মন ভরে যায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্রর। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন আগামী প্রজন্ম এক হয়ে দেশকে এগিয়ে নিবে। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে। সেই স্বপ্নের সাধ তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: মে ৩, ২০১৫

WARNING :
www.salekkhokon.me-এ-এ প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

© 2015 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button