যৌন নিপীড়ন নিয়ে দুষ্টুমি করবেন না
গতকাল আইজিপির বক্তব্যের পর পহেলা বৈশাখে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের মানসিক অবস্থাটা এখন কতটা খারাপ হতে পারে, আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি!
কী ঘটেছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিতে? ওইদিন বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও রাজু ভাস্কর্যের চারপাশে একদল বখাটে ঘুরে ঘুরে একের পর এক নারীকে যৌন নিপীড়ন করে। তাদের একটি বড় দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের কাছে এক নারীকে রিকশা থেকে নামিয়ে প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলে। নারীর সঙ্গে থাকা শিশু ও ব্যক্তিকেও মারধর করে সরিয়ে দেয় তারা। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে ১২জনের চেহারা আঁচ করা গেছে। গণমাধ্যমে তা প্রকাশিতও হয়েছে। কিন্তু কাউকেও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি অদ্যাবধি! বিষয়টিকে পুলিশ গুরুত্বসহকারে নিয়েছে বলেও মনে হয়নি।
নববর্ষের দিনে কারা ঘটিয়েছে এমন যৌন সন্ত্রাস? এখনও উত্তরটি নিশ্চিত করেনি কেউ। ঘটনার সময় আশপাশে পুলিশ থাকলেও তারা এগিয়ে আসেনি। বরং গণমাধ্যমে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কথা শুনলে রীতিমতে অবাক হতে হয়।
প্রথমে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘পহেলা বৈশাখের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে বিবস্ত্রের কোনও ঘটনা ঘটেনি। এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নিশ্চিত করেনি। থানা বা পুলিশের কাছে কেউ এখনও অভিযোগও দায়ের করেনি। এতে ঘটনাটিতে যথেষ্ট কনফিউশন রয়েছে।’
যৌন নিপীড়নের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমজাদ আলী ও ভিসি আরেফিন সিদ্দিকীও বক্তব্য দিচ্ছেন দায়সারা গোছের। ওইদিন ছাত্ররা একজনকে ধরে পুলিশে দিলেও অজ্ঞাত কারণে তাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। কেন? সে উত্তরটিও জানা যায়নি!
এসব কিছুকে পেছনে ফেলে গতকাল পুলিশ সদর দফতরে সাংবাদিকদের কাছে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক যা মন্তব্য করেছেন তা রীতিমতো ভীতিকর ও আঁতকে ওঠার মতো। পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে নারীদের ওপর সংঘবদ্ধ যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে তিনি ৪-৫ জন যুবকের দুষ্টামির ছলে ঘটা ঘটনা বলে মন্তব্য করলেন।
প্রশ্ন হলো, মন্তব্য করার আগে আইজিপি কি একটিবারও ভেবেছেন তার এই মন্তব্যের পর যৌন নিপীড়নে আক্রান্ত নারীদের মানসিক অবস্থা কতটুকু কষ্টদায়ক হতে পারে। তাদের অভিভাবক, ভাই, বাবা-মা কিংবা স্বামীর মানসিক অবস্থাটা? আজ যদি তার পরিবার কিংবা আপনজনের সঙ্গে এমনটা ঘটত, তবে কি তিনি এমন মন্তব্য করতে পারতেন? যৌন নিপীড়নের পুলিশি ভাষা যদি হয় ‘দুষ্টামি’ তবে তো নিপীড়নকারীরাই উৎসাহিত হবে। এ মন্তব্যের মাধ্যমে নিপীড়নকারীদের গ্রেফতারে পুলিশ কতটা তৎপর ও আন্তরিক তা বেশ টের পাওয়া যায়। পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থেকে এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য করা শুধু পুলিশ নয়, সরকারের জন্যও বিব্রতকর।
পুলিশের কাছে যৌন নিপীড়নকারীরা দুষ্ট। আর তাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা মারাত্মক অপরাধী। তাই তাদের ওপর বেপোরোয় লাঠিচার্জ এবং জল কামান ও টিয়ারসেল ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। গণমাধ্যমে দেখলাম, রাষ্ট্রের মহিলা পুলিশ থাকা স্বত্ত্বেও ছাত্র ইউনিয়নের এক নারী কর্মীকে কিভাবে প্রকাশ্যে পুরুষ পুলিশ সদস্য শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করলেন। তার অপরাধ- প্রতিবাদ করা এবং পুলিশের সাজোয়াঁ গাড়িতে ছোট্ট একটি ফুলের টব নিক্ষেপ করা। কিন্তু এ অপরাধে তার ওপর প্রকাশ্যে যে নির্যাতন করা হয়েছে তা রাষ্ট্রের একটি বাহিনীর নারীর প্রতি চরম অবমাননা ও অশ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। এমনটা ঘটতে থাকলে সরকারের সব ভালো অর্জনগুলোই জনসাধারণের কাছে ম্লান হতে থাকবে।
আমরা দেখলাম এ ঘটনার পর পর গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ও অনলাইনে তীব্র প্রতিবাদের ফলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। প্রশ্ন হলো ওই পুলিশ সদস্য কি স্বপ্রণোদিত হয়ে নারী কর্মিকে লাঞ্ছনা করেছিলেন, নাকি নির্দেশিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেখানে নিশ্চয়ই একজন কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাহলে তাকে কেন বরখাস্ত করা হলো না? আর হাস্যকর ব্যাপার ঘটল তদন্ত কমিটি নিয়ে। নারী লাঞ্ছনার ঘটনা তদন্তে কোনও কমিটি না করে ডিএমপি সংবাদ মাধ্যমে ‘বিরূপ খবর’ ও ‘পুলিশের ওপর হামলার’ ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, ‘বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে হাজার হাজার মানুষ ছিল। তাদের মাধ্যে মাত্র ৪-৫ জন যুবক ওরকম ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় জনগণ কী করেছে? একজনও কেন তাদের ধরতে পারল না। জনগণেরও তো ক্ষমতা রয়েছে। দুষ্টামির ছলে ৪-৫ জন যুবক কী করেছে তা জনগণই প্রতিহত করতে পারত।’ তিনি অবশ্য যথার্থই বলেছেন। ছাত্র ইউনিয়নের লিটন নন্দী কিন্তু এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আজ তার দেওয়া তথ্য পুলিশের কাছে ধূম্রজাল মনে হচ্ছে। তাছাড়া অন্য মানুষদের দায়িত্বহীনতার কথা বললেই কি পুলিশ তার দায়িত্ব অবহেলার বৈধতা পেয়ে যাবে? তাহলে কি ওই ‘দুষ্ট’ অপরাধীদের আর গ্রেফতারের প্রয়োজন পড়বে না?
যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ চলছে। প্রকৃতপক্ষে এটি কোনও পুরুষের বিরুদ্ধে নারীদের আন্দোলন নয়। এটি বিকৃত মানসিকতার, রুচিহীন ও অসুস্থ ব্যক্তির চরিত্রের বেহায়াপনার বিরুদ্ধে সুস্থ মানসিকতার প্রতিবাদ। যা আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যাশা করি। এইসব নরপশুদের বিকৃত মানসিকতা থেকে কোনও নারীই নিরাপদ নয়।
পুলিশের অনেক অর্জন আছে। আছে সীমাবদ্ধতাও। তবুও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আইজিপির মুখে সাধারণ মানুষ শক্ত কিছু কথা শুনতে চায়। যে কথা বা মন্তব্য মানুষের মনে সাহস জোগাবে। পুলিশের সে আচরণ করা প্রয়োজন যে আচরণ জনগণের মনে তার প্রতি বন্ধুত্বের মানসিকতা জাগাবে। মনে রাখা দরকার, সাধারণ মানুষ তার বিবেকের কাছেই শুধু দায়বদ্ধ থাকে। কিন্তু পুলিশ, নিজের বিবেক ছাড়াও রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ । তাই প্লিজ, যৌন নিপীড়ন নিয়ে দুষ্টামি করবেন না। বরং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখুন।
ছবি : বিডিনিউজ২৪.কম এর ব্লক
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন-এ, প্রকাশকাল: বিকাল ০৪:৩৫ মে ১৪, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.
খুবই যথার্থ এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখা। এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা খুজে পাচ্ছি না। আমরা কী এখনও মানুষ আছি?