অবশ্যই বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলছিলেন

‘‘তহন স্কুলে পড়ি। পড়াশুনায় হেব্বি কম্পিটিশন। হাবিব, মোশারফ, নুরুল হুদা আর মজিবুর পিছে লাইগা থাকত– কী পড়ি, কখন পড়ি এইসব জানতে। আমি পড়তাম সবাইর আড়ালে, রাত জাইগা। কেউ টেরও পাইত না। সন্ধ্যা রাইতেও আড্ডা দিতাম। আবার খুব ভোরে উইঠাই বল খেলতাম। ফিরার পথে বাড়ি বাড়ি গিয়া বন্ধুগো ঘুম ভাঙাইতাম। সবাই খুব অবাক হইত। কেউ কেউ প্রশ্ন করত, ‘ওই, তুই লেহাপড়া করস কহন?’ আমি মুখ টিপে হাসতাম। মনে মনে বলতাম, ‘রাতেই শেষ কইরা থুইয়া দিছি।’ সবসময় আমি সেকেন্ড হইতাম। ফাস্টবয় আমার থেইকা মাত্র চার-পাঁচ নাম্বার বেশি পাইত। এই নিয়া তহন খুব মন খারাপ হইত।’’
তাঁর শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খানের জবানিতে। কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা গ্রামের ওয়াসেক খান ও সুরেমন নেছার পঞ্চম সন্তান আফতাব। একাত্তরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধদিনের গল্প শুনতে এক সকালে আমরা পা রেখেছিলাম ঢাকার মিরপুরে তাঁর ছেলের ভাড়াবাড়িতে।
জানলাম, তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি জয়কা প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি এসএসসি পাশ করেন নানশ্রী হাই স্কুল থেকে। আফতাব আমাদের বলছিলেন স্কুলজীবনের আনন্দময় দিনগুলোর কথা:
‘‘মাছ মারা ছিল সবচেয়ে মজার। পলো জাল, টাক জাল ছিল ভরসা। বাড়ির সামনেই ছিল জোঁকরা বিল, জলার বিল, সাইল্লা বিল। জোঁকরা বিল জোঁকে ভর্তি থাকত। নামা যাইত না। কিন্তু মাছ থাকত বেশি। আমরা তাই নৌকা ভাসাইতাম। কিন্তু তবুও জোঁক থাইকা বাঁচার পথ ছিল না। দুয়েকটা কামড়ে থাকত পায়ে। মাছের লোভে জোঁকের ভয়ও তুচ্ছ করছি।
ক্লাসফ্রেন্ড রতন রায়, মুকুট রায় ও গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তীর কথা এহনও মনে পড়ে। শ্রী পঞ্চমীর দিন আর পৌষ মাসের উৎসবে আমরা কত মজা করছি। নানা রকম পিঠাপুলি খাইয়া রাতভর মাঠে আগুন জ্বালাইয়া আনন্দ করছি। ওরাও আমগো লগে আনন্দ করত ঈদের দিনে। প্রতিমা ভাঙার কোনো ঘটনা তহন দেহি নাই। মৌলভীরা ভালা ছিল। হেরা তহন রাজনীতি করত না। সাম্প্রদায়িকতাও তাই ছিল না। রাজনীতির ঠেলায় এহন তো সব কিছুই পাল্টাইয়া গেছে!’’
তখন ১৯৬৭ সাল। ঢাকার শহীদবাগে থাকতেন আফতাবের খালাতো বোন। সবার কাছে তিনি ‘তাজের মা’ নামে পরিচিত। লেখাপড়ার জন্য আফতাব চলে যান তাঁর কাছে। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন টিঅ্যান্ডটি মহাবিদ্যালয়ে। একাত্তরে তিনি ছিলেন ওই কলেজেরই বিএ ক্লাসের ছাত্র।

কথার পিঠে কথা চলে। আমরাও এগিয়ে যাই ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চলছে। ততদিনে শেখ মুজিব ৬ দফার ডাক দিয়েছেন। কলেজে আমির হোসেন, নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, খুরশিদ আলম আর আফতাব ছাত্রলীগ করেন। আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম জিকো, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ছাত্রনেতা। নেতারা বৈষম্যের কথা সবার কাছে তুলে ধরতেন– ‘আমাদের জিনিস পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়া সিল মাইরা আবার এই দেশে আনলেই বেশি দামে কিনতে হইত। কাগজ, কাপড়, চাউলের দাম ছিল বেশি।’ চাকরিজীবী বাঙালিদের কেরানির উপরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সব ক্ষমতা ছিল পাঞ্জাবিদের দখলে। প্রায় প্রত্যেক দিন পল্টনে মিছিল হত। বঙ্গবন্ধু ছাড়া ভাসানি সাহেব আর কমরেড মনি সিংও মিটিং করতেন।
আফতাব উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন রেসকোর্স ময়দানে। তাঁর ভাষায়:
‘‘আমি চলে যাই সকাল ১১টার দিকে। মঞ্চের খুব কাছেই ছিলাম। কত যে মানুষ। সবার হাতেই লাডি। লাডিই ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব… এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’; সবাই তখন চিৎকার করে উঠে। আমরা মনেপ্রাণে তৈরি ছিলাম। বঙ্গবন্ধু তো বলছেনই, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি…’– এই কথাডাই আমার কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা।’’
কিছুদিন আগে এ কে খন্দকার তাঁর এক বইতে লিখেছেন ওই ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু সেদিন ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন। আপনি তো সেখানে ছিলেন। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত?
পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মুক্তিযোদ্ধা আফতাব বলেন:
‘‘তিনি কি সেখানে থাইকা ভাষণ শুনছিলেন? লাখ লাখ লোক ভাষণ শুনছে। অবশ্যই বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলছিলেন। তিনি কোন দুঃখে ‘জয় পাকিস্তান’ বলবেন? কেউ লিখলেই কি ইতিহাস পাল্টাইয়া যাইব!’’
মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন ২৫ মার্চ রাতে ছিলেন ঢাকার শহীদবাগে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সংঘটিত বর্বরোচিত গণহত্যা সম্পর্কে তিনি বলেন:

‘‘রাজারবাগ পুলিশ লাইন তখন ছিল টিনের চালার; চতুরদিকে কাঁটাতারের বেড়া। কয়েক দিন ধইরা ঢাকা থমথমে। মনে হইতেছিল একটা কিছু ঘটব। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেট। রাত তখন ১২টা। মালিবাগের দিকে গুলির শব্দ। মাঝে মাঝে ব্রাশ ফায়ার। দূর থেইকা দেখা যায় এক ধরনের সেল পড়ছে। হলুদ আলো ছড়ায়ে বিকট শব্দ হয়। তাতে কাঁইপা উঠে ব্লিডিংগুলা। অনেক পুলিশ সদস্যরে দেখছি আমাদের বাড়ির পাশের ওয়াল টপকাইয়া পালাইতেছে। হাজার হাজার ফায়ার হইছে সেই রাতে। সকালে কারফিউ তুলতেই রাজারবাগে যাই। দূর থাইকা দেখি পইড়া আছে শত শত লাশ।’’
বাইরে থেকে সবাই ভেবেছে ঢাকার সব মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা মেরে ফেলেছে। ডেমরার ওপারে শীতলক্ষ্যা নদী পার হতেই আফতাব দেখেন, বাস দাঁড়ানো। ভৈরব পর্যন্ত ফ্রি নিয়ে যাবে। ভৈরবে নামতেই মানুষজন এগিয়ে আসে কলা, মুড়ি আর পানি নিয়ে। সেখান থেকে ৩০ মাইল হেঁটে পহেলা এপ্রিলে পৌঁছেন কিশোরগঞ্জে। মা মনে করেছিলেন ছেলে মরে গেছে। তাঁকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না!
কিশোরগঞ্জের তখনকার অবস্থা নিয়ে বললেন আফতাব। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জ ঢোকে। শহরের আশেপাশে তারা হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে থাকে। শুরু হয় লুটতরাজ আর ডাকাতি। অনেক হিন্দু পরিবার আফতাবদের গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। রাত জেগে ওঁরা তাদের পাহারা দিতেন।
এসব দেখেশুনে আফতাব আগেই বুঝেছিলেন, সংগ্রাম ছাড়া কিছুই হবে না। তাঁর একমাত্র বোনের বাড়ি ছিল নেত্রকোনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এপ্রিলের শেষ দিকে আফতাব তাঁর বাড়িতে গিয়ে উঠেন। সেখান থেকে খুব কাছে মহিষখোলা বর্ডার। সেখানকার রিক্রুটিং ক্যাম্পে নাম লেখান আফতাব। ১৫-১৬ দিন পর বাছাই করে ট্রেনিংয়ের জন্য লোক নিল মাত্র ১৭ জন। ওঁদের দেড় মাস ট্রেনিং দেয় ভারতের শিক রেজিমেন্ট। আর্মস ট্রেনিং, টুইস মর্ডার, এসএলআর, রাইফেল, শটগান, গ্রেনেড ট্রেনিং দেন ওমর সিং ও গোরমেশ সিং। পরে ওঁদের ১২ জনকে ডেমুনেশনের ওপর স্পেশাল ট্রেনিং দেন এক্সপোজার ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন কুচওহা। ভারতীয় তালিকার দ্বিতীয় খণ্ডে আফতাবের নাম রয়েছে ১২৪০১ ক্রমিকে।

কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন তিনি সে কথা জানতে চাই।
‘‘ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠায়ে দেওয়া হয় ১১ নং সেক্টরের অধীন রংরা ক্যাম্পে। বিশ-ত্রিশ জনের দল নিয়া সেখান থেইকা আমরা বর্ডার ক্রস কইরা আক্রমণ কইরা আবার ফিরা আসতাম। ভোরে পাকিস্তানি সেনারা যখন ফলিং করত ঠিক তখনই আক্রমণ চালাইতাম। অর্ডার ছিল হিট অ্যান্ড রান। আমাদের কোম্পানির নাম ছিল ছয় নম্বর বিদ্যুত কোম্পানি। কমান্ডার ছিলেন মাহাবুব আলম। আমি ছিলাম প্লাটুন কমান্ডার। আমরা অপারেশন করি বিরিশিরি মিশন, নাজিরপুর, কলমাকান্দা, লেংগুরা, মহাদেবপুর প্রভৃতি বর্ডার এলাকায়।’’
এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি আফতাবের ডান পায়ের গোড়ালির উপরে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে ওই স্থানের হাড় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। পরে হাসপাতালে ওই পায়ে কৃত্রিম প্লেট লাগিয়ে দেওয়া হয়। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে, জানতে চাই আমরা। মুক্তিযোদ্ধা আফতাব তখন আনমনা হয়ে যান। খানিক নিরবতা। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকেন সব।
জুনের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। আফতাবরা দুর্গাপুর মুক্ত করে ভোরে এসে পজিশন নেন নাজিরপুর বাজারে। সে সময় খবর পান পাকিস্তানি সেনারা বাজারের ওপাশে একটা বাড়িতে অবস্থান করছে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ওঁরা তখন সামনে এগোন। কমান্ডে ছিলেন আফতাব নিজেই। গোলাগুলি না করলে তখন ভালো লাগত না। গুলির উত্তর ছিল গুলি।
আফতাব একটি ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে ক্রলিং করে সামনে এগোন। আইলে মাথা রেখেই চলছে গোলাগুলি। তাঁর কোমরে গুলি বাঁধা। ওপর দিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার গুলি। বেলা তখন ১১টা। কোমরের গুলি আইলের মাটিতে আটকে গেল। দাঁড়ালেই ব্রাশের গুলিতে জীবন যাবে। ব্যাক করারও উপায় নেই। পাশেই ছিলেন সহযোদ্ধা মফিজ। হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে গেলে গুলি লাগে তাঁর বুকে। তিনি ছিটকে পড়েন। কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে তাঁর শরীর নিথর হয়ে যায়। দূরে গুলি খেয়ে চিৎকার করে ওঠেন নাজমুল। সব কিছু ঘটছে চোখের সামনে।
আফতাব ক্রলিং করে সামনে এগোতে যাবেন, অমনি পেছন দিকে ডান পা-টা ওপরে উঠে যায়। গোড়ালির ওপর গুলি লেগে সেটি বেরিয়ে গেছে। আফতাবের মনে হল বিদুতের শক লেগেছে শরীরে।
পরের ঘটনা শুনি তাঁর ভাষায়:
‘‘গুলির ধর্ম হইল শরীরের রক্ত বাইর কইরা দেয়। আমার বেলায়ও সেইটা ঘটল। পিনপিন কইরা রক্ত বাইর হইতেছিল। নড়তে পারতে ছিলাম না। আইলের জায়গা রক্তে ভাইসা গেছে। গোটা শরীরের রক্ত মাটিতে। আমার শরীর নিস্তেজ হইয়া আসল। ভাবলাম বুঝি মইরা যামু। পিছন থেইকা আগাইয়া আসে সহযোদ্ধা হাকিম। তার বাড়ি ছিল ঢাকায়। সে রাইফেল রাইখা তার গেঞ্জি ছিড়া পাটা বাইন্ধা দেয়। বেলা তখন ২টা। পাকিস্তানিরা অনেকটা ব্যাকে চইলা গেছে। তখনই আমারে কান্ধে নিয়া দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদী পার কইরা ভারতে এক মিশন হাসপাতালে নিয়া যায় হাকিম।’’
ওখানে চিকিৎসা শেষে আফতাবকে নিয়ে যাওয়া হয় আসামের গৌহাটির ওয়ান ফিফটি ওয়ান বেইস সামরিক হাসপাতালে। ১ মাস ২৫ দিন চিকিৎসা চলে তাঁর। ডান পায়ের গোড়ালির ওপরের হাড় গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। পরে ভেতরে প্লেট ও রড দিয়ে অ্যাডজাস্ট করে দেওয়া হয়।
‘‘হাকিম না থাকলে বাঁচতে পারতাম না’’– তাঁকে বাঁচাতে সহযোদ্ধা হাকিমের অবদান স্মরণ করে বললেন আফতাব– ‘‘কিন্তু স্বাধীনের পর হাকিমরেই আর খুঁইজা পাইলাম না। সে বাঁইচা আছে কিনা তাও জানি না। আইজও আপন মনে খুঁজি ওরে’’– দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আপনি কোথায়?

মুক্তিযোদ্ধা আফতাব বলেন:
‘‘যুদ্ধ করা তখন নেশা। হাসাপাতাল থেইকা রিলিজ নিয়া চইলা আসি রংরা ক্যাম্পে। অংশ নেই সম্মুখযুদ্ধে। ১৬ ডিসেম্বরে আমরা ছিলাম কিশোরগঞ্জে। স্বাধীনতার আনন্দে আকাশের দিকে শত শত গুলি ছুঁড়ছিলাম।’’
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের কথা স্মরণ করেন এভাবে:
‘‘ভারতের হাসপাতালে শান্তিমতি নামে আর্মি কোরের এক নার্স আমারে ভাইয়ের মতো সেবা করছে। ভারত আমাদের কোটি কোটি মানুষরে খাবার দিছে, চিকিৎসা দিছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং আর অস্ত্র দিছে। কত ভারতীয় সৈন্য একাত্তরে শহীদ হইছে। তাঁদের ঋণ শোধ করা যাইব না।’’
[ ভিডিও : মুক্তিযোদ্ধা আফতাবের আহত হওয়া ও দেশভাবনার কথা বলছেন ]
রাজাকারদের কার্যক্রমের বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ ভেজান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে তিনি বলেন:
‘‘একবার এক মুক্তিযোদ্ধা নেত্রকোনায় রেইকি করতে আইসা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। তারা তারে আর্মিদের ক্যাম্পে নিয়া যায়। এরপর জিপে ওর পা দুইটা বাইন্ধা টাইনা নিয়া যায় ময়মনসিংহ পর্যন্ত। তার সারা শরীরের মাংস উইঠা গেছিল। তার ক্ষতবিক্ষত লাশ আমরা পাইছিলাম। অনেক ক্যাম্পে হিন্দু মেয়েদের রাজাকাররা টর্চার কইরা মাইরাই ফালাইত। করিমগঞ্জের রাজাকার ছিল মান্নান। তার বিচার তো এখনও হয় নাই!’’
স্বাধীন দেশে রাজাকারদের গাড়িতে রক্তখচিত পতাকা উড়বে এমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন। বুকে পুষে রাখা কষ্টের কথা বললেন তিনি। তাঁর ভাষায়:
‘‘এই দৃশ্য দেখলেই চোখে পানি আসত। রাজাকারগো জিয়া মন্ত্রী করল। প্রতিবাদে আমরা তখন প্রেসিডেন্ট হাউজে যাই নাই। জিয়া তো ছিল পাকিস্তানপন্থী। আমরা সেটা বুঝতে পারি স্বাধীনের পরে। স্বাধীন দেশে রাজাকারদের পুনর্বাসিত করছে জিয়াউর রহমান। আজ রাজাকাররা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। রাজাকাররা বাঁইচা থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নও রাখব না। গত তেতাল্লিশ বছরে আমরা তাই দেখছি।’’
আফতাব মনে করেন, স্বাধীনতার পরপরই উচিত ছিল তিনটি তালিকা করা– প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, সাহায্যকারী মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারদের তালিকা। তখন থানায় থানায় এর লিস্ট ছিল। তাহলে তালিকা নিয়ে এত বিতর্ক তৈরির সুযোগ থাকত না।

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানের কথা তিনি এভাবে বলেন:
‘‘মুক্তিযুদ্ধে তো বড় অফিসার, বড় লোকের ছেলেরা খুব কম গেছে। সাধারণ ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সাধারণ শ্রেণির লোকেরা মুক্তিযুদ্ধ করছে। গ্রাম গ্রামান্তরের সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়া পাকবাহিনী থেইকা আমাদের আড়াল কইরা রাখেছে। খাবার দিছে, খবর দিয়া সাহায্য করছে। তা না হইলে এত সহজে দেশ স্বাধীন হইত না।’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। আফতাব জানালেন, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছেন এটা ভেবেই গর্বিত হন। শেখ হাসিনা সরকার রাজাকারদের বিচার করছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রাজাকারদের বিচার স্বাধীন দেশে হচ্ছে এটা ভাবলেই শান্তি পান, ভালো লাগে তাঁর।
কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে এ নিয়ে তাঁর সুস্পষ্ট ভাবনা রয়েছে। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ যদি সত্যনিষ্ঠ হয়, চাকুরিজীবীদের যদি ঘুষ-দুর্নীতি থেকে দূরে রাখা যায়, এমপিরা যদি নিজ এলাকার উন্নয়ন করে তবে দেশের চেহারা বদলে যাবে বলে তাঁর ধারণা। কারণ প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে তো সব করা সম্ভব নয়।
পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে নিবে, এমনটাই বিশ্বাস করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন খান। নিজের চার বছরের নাতি সাহাদাত হোসেনের প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘ও আমার ছোট্ট বন্ধু। ডেইলি সে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। বঙ্গবন্ধুর কথা জানতে চায়। মাঝে মাঝেই কাগজের পতাকা দিয়া সারা বাড়ি সাজায়। এই সব দেইখা মনটা আমার জুড়ায়া যায়।’’
ছোট্ট কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানও তোলে সাহাদাত। তখন তার মুক্তিযোদ্ধা দাদার বুকটা ভরে যায় আনন্দে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ, প্রকাশকাল: মে ২৭, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.