ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মুক্ত দেশ চাই
যদি প্রশ্ন করা হয়, দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি কে? সবাই নিশ্চয়ই চোখ বন্ধ করে বলবেন, প্রধানমন্ত্রী। যিনি নিজেই একজন নারী। বিরোধী দলের নেত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীও নারী, দেশের স্পিকার- সবাই নারী। যদি প্রশ্ন ওঠে, এদেশে সবচেয়ে নির্যাতিত কে? তাহলেও উত্তরটি হবে, নারী। দেশের প্রভাবশালী ও নির্যাতিত- দুটোতেই নারী। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে কি এমনটা দেখা যায়? নানা প্রশ্নই মনের ভেতর ঘুরে বেড়ায়।
রাজধানীতে আদিবাসী এক নারীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এ নিয়ে যতই সংবাদ পড়ছি, ততই মনের ভেতর এক ধরনের অসহায়ত্ব পেয়ে বসছে। মনে-মনে ভাবি, নিজের মেয়ের কথা। বুকের ভেতরটা তখন আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হই, বিচলিত বোধ করি। এই শহরে এ রকম ঘৃণ্য ঘটনা- মেনে নিতে পারি না।
গণধর্ষণ নিয়ে চোখ আটকালো কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার খবরে। নানান ঢঙে, নানা শিরোনামে তারা প্রকাশ করছে গণধর্ষণের ঘটনাটিকে। ধর্ষণ হওয়ার ঘটনাকে কাহিনি বানিয়ে তারা তুলে ধরছে। যেন আনন্দময় একটি সিনেমার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। লাইক আর হিট বাড়াতে সাংবাদিকতার আড়ালে এরাও যে নিজেদেরই ধর্ষকের কাতারে নিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার জ্ঞানটুকু কি তাদের আছে! এই সংবাদগুলো যদি আক্রান্ত মেয়েটি বা তার আপনজনদের চোখে পড়ে, তবে তাদের মানসিক অবস্থা কতটুকু খারাপ হতে পারে?
গণধর্ষণের শিকার নারীটি গারো আদিবাসী জাতির। বলা যায়, এ সমাজে দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। রাষ্ট্রই যাদের ক্ষুদ্র করে রেখেছে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ নামকরণ করে। পাহাড়ে ও সমতলে আদিবাসী নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে নানা সময়ে, নানাভাবে। তার একটিরও বিচার হতে আমরা দেখিনি। প্রতিবাদ বা আন্দোলনও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এই গারো মেয়েটিকে গণধর্ষণের ক্ষেত্রে আদিবাসী পরিচয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছিল?
গণধর্ষণের ঘটনাটি আজ আমাদের সমাজের বীভৎস চেহারাটাই তুলে ধরেছে। যখন লিখছি, তখনও গাজীপুরে এক নারীকে ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। যেন চারপাশে ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সারা দেশে ১৫৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যার শিকার হয়েছে ৬১জন নারী ও ৯৩ শিশু। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৬জন। তবে পুলিশের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে সারা দেশে ধর্ষণ মামলা রেকর্ড করা হয়েছে ৭৯৭টি। ধারণা করা হয়, প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের চারপাশে অসংখ্য নারী শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। চার দেয়াল ভেদ করে সে কান্না হয়তো গণমাধ্যমকে স্পর্শ করতে পারেনি। দেশে নারী উন্নয়নের নানা অর্জন থাকলেও নারীদের যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো সবকিছুকে ম্লান করে দিচ্ছে।পরিবার কিংবা সমাজে নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা আসলে কেমন? একটি ঘটনার কথা বলছি। পরিচিত, শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে গিয়েছি কয়েকদিন আগে। বড় কমিউনিটি সেন্টারের হলরুম ভাড়া করে ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। কারণ? তিনি এক পুত্র সন্তানের জনক হয়েছেন। তাই সন্তানের আগমন বার্তা সবাইকে জানাচ্ছেন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু তার মেয়েটি জন্মানোর পর সামর্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও তিনি এধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি। তার কাছে ছেলে হচ্ছে- সাতরাজার ধন, সাদা মানিক। সেটি হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু মেয়ে সন্তানটিকে অবজ্ঞা করে কেন? হয়তো এতটা ভেবে দেখেননি তারা। কিন্তু বিষয়টি যদি তার কন্যা শিশুটির মনে প্রশ্ন জাগায়। তবে কি উত্তর দেবেন বাবা-মা। প্রায়ই আমরা দেখি ছেলে সন্তানের আশায় পর-পর তিনটি কন্যা শিশুর পরও বাবা-মা নতুন সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কারণ, আমাদের সমাজে এখনও কন্যা শিশুরা বা নারীরা বংশপ্রদীপ হতে পারেনি। আমরা শিক্ষিত হয়েছি, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা এখনও মান্ধাতার আমলেরই রয়ে গেছে। ছেলে সন্তান নয়, বরং সন্তানই বাবা-মায়ের বংশপ্রদীপ- এই বোধটুকু এখনও আমাদের মাঝে তৈরি হয়নি।
আমরা উন্নত হচ্ছি। লেখাপড়া, চাকরি এমনকি বেঁচে থাকার সঙ্গে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। ছেলে-মেয়ে কাউকে আর আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মা-বাবাও ছুটছেন সন্তান কীভাবে লেখাপড়ায় ভালো করবে, কীভাবে ভালো চাকরি করবে, কিসে তার ক্যারিয়ার ভালো হবে, তার পেছনে। কিন্তু মেয়েটিকে নিয়ে বাবা-মায়ের ভাবনাটি কি ছেলেটির মতোই?
অনেকেই ভাবেন না চলার পথে তার মেয়ে কোনও ভোগান্তিতে পড়ছে কি না। মেয়েরা রাস্তায় বের হলেই নানা রকম হয়রানির শিকার হয়। পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে না পেরে আত্মহত্যা, প্রেমে রাজি না হওয়ায় এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ শেষে খুনের খবরও। এসব ঘটনার শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাই হয়। শহরের বাবা-মা এসব ব্যাপারে সচেতন হলেও গ্রামের অভিভাবকরা এতটা সচেতন নন। মেয়েকে রাস্তায় বিরক্ত করেছে তো তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাই তাদের কাছে সমাধান। বিয়ের পর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া অনেক মেয়ের পক্ষেই সম্ভব হয় না। ফলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় মেয়েদের স্বপ্নগুলো ।
আবার কোনও কোনও বাবা-মা শুধু লেখাপড়া ও ভালো রেজাল্টের ওপর চাপ দেন। কিন্তু মেয়ের চাওয়া না চাওয়া, নিরাপত্তা নিয়ে ততটা বিচলিত হন না। সে রকম অভিভাবকের দেখা আমরা পেয়েছি মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে এক শিক্ষার্থীর ‘যৌন হয়রানি’ অভিযোগের সময়টাতে। যারা মেয়ের ভবিষ্যৎ ও স্কুলের সুনাম রক্ষার নামে ‘চুপ থাকা’র পক্ষে ছিলেন। এছাড়া একজন নারী হয়েও স্কুলের উপাধ্যক্ষ ঘটনাটিকে যে ঘৃণ্য ভাষায় উপমা দিয়েছিলেন, তা শুনলে যেকোনও বিবেকবান মানুষকেই নাড়া দেবে।
নারী ধর্ষণ ও নিপীড়নের প্রসঙ্গ এলেই এশ্রেণির লোক ইনিয়েবিনিয়ে বলতে থাকেন, মেয়েটি কোথায় ও কেন গিয়েছে, কী পোশাক পরেছিল, সঙ্গে কেউ ছিল কি না, কেন এত রাতে বাইরে থাকা প্রভৃতি। প্রশ্ন হলো, ছেলেরা যদি বাইরে বেরোতে পারে, মেয়েরা কেন পারবে না? সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে একটি মেয়ে কেন নিরাপত্তা পাবে না? একটি মেয়ে কেন ঘর থেকে নিরাপদে বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে কিংবা কাজের জায়গায় যেতে এবং ফিরে আসতে পারবে না?
শুধু আন্দোলন আর প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটাও আমাদের বদলাতে হবে। সেটি করতে হবে পরিবার থেকেই। মুখবুঝে সহ্য করা নয়। মেয়ে বা নারীকে শেখাতে হবে ধর্ষণ, পীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার, সোচ্ছার থাকার। দেশের প্রভাবশালী নারীরা যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, তাদের সকল অর্জন বির্বণ হয়ে পড়বে, যদি আজ নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের দৃষ্ঠান্তমূলক বিচার করা না যায়। তাই তাদেরও উচিত এ বিষয়ে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করা।
আমরা চাই না আরেকটি ধর্ষণের, যৌন নিপীড়নের খবরে চাপা পড়ুক নারীদের অর্জনের ও সফলতার খবরগুলো। চাই প্রতিটি ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিচার হোক। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মুক্ত দেশ চাই আমরা।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন-এ, প্রকাশকাল: বিকাল ০৪:৫৮ মে ২৯, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.