কলাম

চামড়া তুলে নেওয়া কি মন্ত্রীর কাজ!

যার কথা বলছি তিনি নানাভাবে আলোচিত, সমালোচিত। বিজিবির অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ধূমপান, জনসমাবেশের অনুষ্ঠানে ঘুমিয়ে পড়া, সিলেটের সাংবাদিকদের গালাগাল, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে মাদ্রাসাবিরোধী বক্তব্যসহ নানা কর্মকাণ্ডে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। তিনিই আমাদের সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী।
আবারও সমালোচনার ঝড় তুলেছেন তিনি । এবার তার ব্যবহার ও আপত্তিকর ভাষায় প্রকাশ্যে আক্রান্ত হয়েছেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা। তার এই আপত্তিকর আচরণে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে তার নিজের জেলা মৌলভীবাজার প্রশাসনে ।
কী করেছেন তিনি? গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, গত বুধবার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় মন্ত্রীকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে সম্বোধন না করায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জহিরুল ইসলামের ওপর তিনি চড়াও হন এবং তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে জেলা পুলিশ সুপার, তিন থানার ওসি, র্যাব ও আনসার-ভিডিপির কর্মকর্তাদেরও পিঠের চামড়া তুলে নেওয়ার হুমকি দেন তিনি। ওই সভায় কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা থানার ওসিদের দাঁড় করিয়ে মন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের কাছে মন্ত্রী বড়, না হুইপ বড়?’ তখন ওসিরা বলেন, ‘স্যার, মন্ত্রী বড়।’  এসময় মন্ত্রী বলেন, ‘যদি মন্ত্রী বড়ই হয়,  তাহলে তোরা হুইপের কথা শুনিস কেন?’ এরপর তিনি প্রকাশ্যে গালি দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, ‘আমার কথা না শুনলে পিটিয়ে তোদের চামড়া তুলে ফেলব।’ তাঁর রোষ থেকে বাদ পড়েননি বড়লেখা উপজেলা চেয়ারম্যান সুন্দর আলীও। মন্ত্রী তাঁর বক্তব্য থামিয়ে বলে ওঠেন, ‘আমার কারণে আজ তোরা চেয়ারম্যান হতে পেরেছিস।’
তাঁর এহেন আচরণে সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েন। এসব আচরণের কথা স্বীকার করে সমাজকল্যাণমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তিনি শাসন করেছেন মাত্র। এডিসির ব্যাপারে তিনি বলেন,  ‘এডিসি আমাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেনি। এ কারণে তাকে আদর করে থাপ্পড় মেরেছি। যারা ভালো কাজ করবে তাদের আদর করব। আর যারা খারাপ করবে তাদের শাসন করবই।’
প্রশ্ন হলো  জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মন্ত্রী এভাবে শাসন করার অধিকার আইনতভাবে রাখেন কিনা? রাষ্ট্রে প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্য ভাগ করে দেওয়া আছে। মন্ত্রী, সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসন কেউই আইনের নির্দেশনার বাইরে যেতে পারে না। মন্ত্রী আর সাংসদেরা তো জনগণের কাছেই দায়বদ্ধ থাকেন। তাহলে সমাজকল্যাণমন্ত্রী এ কোন ব্যবস্থা চালু করতে চাচ্ছেন? কেউ দুর্নীতিবাজ হলেই তাকে গালাগাল দিতে হবে, পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নেওয়ার হুমকি দিতে হবে! মন্ত্রীর এই আচরণ কি আইনসিদ্ধ? পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া কি মন্ত্রীর কাজ!
তাছাড়া মন্ত্রী জেলা প্রশাসন ও সিলেট রেঞ্জের ডিআইজিসহ পুলিশ প্রশাসনে কর্মকর্তাদের দুর্নীতিবাজ বলেছেন। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে তিনি কি তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লিখিত কোনও অভিযোগ করেছেন? যেটি করাই ছিল আইনত কাজ। কিন্তু তেমন কোনও অভিযোগ করার খবর আমরা পাইনি। বরং মন্ত্রী সেই আইন বা নিয়মটিকে পাশ কাটিয়ে গালাগাল বা শারীরিকভাবে শাসন করার যে প্রক্রিয়া চালু করছেন তা রাষ্ট্রের জন্য কতটা সুখকর! মন্ত্রীর আচরণই যদি এমন হয় তবে সাধারণ মানুষ তো যেকোনও বিষয়েই আইন নিজের হাতে তুলে নেবে।
সমাজকল্যাণমন্ত্রীর আচরণে নিজ দলের হুইপের সঙ্গে তার দ্বন্দটাই স্পষ্ট হয়। যেটি কোনওভাবেই কাম্য ছিল না। ওই অঞ্চলের উন্নয়ন এবং জনপ্রশাসনের কাজকে যা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। নিজেদের মতপার্থক্য দূর না করে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হয়ে যে নিজ দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাই নগ্নভাবে প্রকাশ পায়- তা কি ভেবে দেখেছেন মন্ত্রী?দেশ এগিয়ে চলছে নানা অর্জন আর সাফল্যের মাঝে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতিতে মানুষের মানসিকতায়ও পরিবর্তন এসেছে। এ সরকারের আমলে বিদ্যালয়ে শিশুদের গায়ে হাত তোলার বিষয়ে আইন করে নিষিদ্ধ হয়েছে। সাধারণ মানুষ সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। মানুষের চিন্তা ও চেতনায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। অথচ সমাজকল্যাণমন্ত্রী তাঁর আচরণে পরিবর্তন আনেননি। বরং বারবারই তিনি চড়াও হয়েছেন সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের ওপর, আবার পরে দুঃখপ্রকাশও করেছেন। তার এমন আচরণে বারবারই বিব্রত হয়েছে সরকার।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যাদের আত্মত্যাগের কথা জাতি কোনওদিনও ভুলবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতি চিরকালই কৃতজ্ঞ থাকবে। তাই আমরা আশা করি প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন। একইভাবে আশা করি- জাতির সূর্যসন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন এই দেশে অন্যের সঙ্গে এমন আচরণ করবেন যা সবার জন্যই সম্মানজনক হয়।

(কার্টুনটি   দৈনিক কালেরকন্ঠ থেকে নেওয়া)

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন-এ, প্রকাশকাল: দুপুর ০২:৩৫ জুন ১৩, ২০১৫

© 2015 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button