কেন বন্ধ হচ্ছে না শিশু হত্যা ও নির্যাতন?
শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যা যে ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে তা আমাদের সকলেরই জানা। অতি সম্প্রতি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা তাদের প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় নানা শিরোনামে শিশু নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশের জন্য আলাদা বিভাগ খুলেছে। এছাড়াও শিশু নির্যাতনের অনেক খবরই আমরা পাই ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালগুলো থেকে। ঘটে যাওয়া কয়েকটি শিশু নির্যাতন আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে। এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড়ও উঠেছে সারাদেশে। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এ দুটি ঘটনা ও আইনগত বর্তমান অবস্থাটি একটু জেনে নেওয়া জরুরি।
৮ জুলাই চুরির অপবাদ দিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের শেখপাড়ায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় জালালাবাদ থানার বাদেয়ালি গ্রামের সবজি বিক্রেতা শিশু সামিউল রাজনকে। হত্যার দৃশ্যও তারা অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। পরে তার লাশ গুম করার চেষ্টার সময় ধরা পড়েন একজন। একে একে জনতা ধরিয়ে দেয় হত্যা মামলার অন্য আসামিদের। মামলাটির বিচারে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। পলাতক মূল আসামি কামরুল ইসলামকেও অতিদ্রুত সৌদি থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
আবার খুলনার আলোচিত শিশু শ্রমিক রাকিব হত্যা মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। রাকিবের মলদ্বার দিয়ে কমপ্রেসার মেশিন দিয়ে বায়ু প্রবেশ করে হত্যা করা হয়। তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এত নির্মমভাবে বিশ্বের আর কোথাও কাউকে মেরে ফেলা হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই! এই ঘটনায় তিনজনকে অভিযুক্ত ও ৪০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এ দুটি নৃশংস হত্যার ঘটনায় রাজন ও রাকিবকে তাদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারবে না রাষ্ট্র। তবে রাষ্ট্রের কাছে সবার প্রশ্ন থেকে যায়- অপরাধিরা কি দৃষ্টান্তমূলক সাজা পাবে? কবে শেষ হবে এই বিচারকাজ?
রাজন ও রাকিব হত্যার পরও থেমে নেই শিশু হত্যা ও নির্যাতন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ একসঙ্গে করে সম্প্রতি বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম জানিয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন— এই তিন মাসে সারা দেশে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা, গ্রেফতার, আত্মহত্যা, স্কুলে শারীরিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে ১ হাজার ২৯৯ জন শিশু। যা যেকোনও রাষ্ট্রের জন্যই অশনি-সংকেত। সারা বিশ্বে আমরা শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে প্রশংসা পেয়েছি বটে কিন্তু শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ প্রায় শূন্যের কোটায়।
কিন্তু কেন এ দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যার পরিমাণ বেড়েই চলেছে?
বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন আইনের শাসনের অভাব, শিশুদের বিষয়গুলোকে আলাদাভাবে গুরুত্ব না দেওয়া এবং বিচারকার্য ও নিষ্পত্তিতে অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রতার কারণেই অপরাধীরা অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছে।
কেন বিচারকার্য দীর্ঘ হচ্ছে? অনেকগুলো কারণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে মামলার চাইতে বিচারকের সংখ্যা কম থাকা। যা প্রায় সব মামলার ক্ষেত্রেই বিবেচিত। কয়েকদিন আগে আইন কমিশনের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশে অনুমোদিত বিচারকের পদ আছে ১ হাজার ৬৫৫টি। তার মধ্যে শূন্য রয়েছে ৪৫৭টি পদ। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ হাজার নাগরিকের বিপরীতে ১ জন করে বিচারক, ভারতে ৬৭ হাজার নাগরিকের বিপরীতে একজন আর বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ নাগরিকের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র একজন বিচারক। এ তথ্যটি শুধু শিশু হত্যাই নয়, যেকোনও মামলার বিচার প্রার্থীর জন্যই চিন্তার কারণ। পুলিশ আসামি ধরল, মামলা করল। কিন্তু বিচার চলবে কতদিন? এ প্রশ্ন থেকেই যায় সবার মনে!
তাই শুধু দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার নিলেই চলবে না। সারাদেশে বিচারকদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে এবং শিশু নির্যাতনের মামলাগুলোকে আলাদাভাবে স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করে পরিচালনা করতে হবে। দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সরকারকে এই দিকটিতে খেয়াল রাখতে হবে বিশেষভাবে।
পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশেই শিশুরা রাষ্ট্রের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে শিশু অধিকারগুলো পালনে রাষ্ট্র এতটুকুও গাফিলতি করে না। বাবা-মার দ্বারাও যেন শিশুরা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার না হয় সেদিকটিও খেয়াল রাখা হয় কঠোরভাবে। অথচ আমাদের দেশে পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিবারে বাবা-মার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বলি এখনও শিশুরা। বিদ্যালয়গুলোতে মানুষ গড়ার পরিবর্তে চলছে ‘এ-প্লাস’ এর প্রতিযোগিতা। ফলে দিনে দিনে ওজন বাড়ছে শিশুদের স্কুল ব্যাগের। এভাবে আমরা প্রতিনিয়তই শিশুদের মানসিক নির্যাতন করছি অবচেতন মনেই। ফলে শিশুরা এখন আর নেই শিশুতে।
দেশে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। সারা দেশের প্রতিটি উপজেলায় তাদের কার্যক্রম রয়েছে। যার অধিকাংশ নারী বিষয়ক। তাদের মাধ্যমে শিশুদের নিয়ে কাজের তেমন কোনও সংবাদ আমরা খুব একটা পাই না। সারা দেশে কি পরিমাণ শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে – তার কোনও পরিসংখ্যান কি আছে তাদের কাছে। শিশু অধিকার, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতার জন্য সরকারিভাবে তেমন কোনও কার্যক্রম কি আছে এই দফতরটির? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।
সরকার ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের শিশুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ। যদি তাই হয় তবে শিশু নীতি বাস্তবায়ন, শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিশু নির্যাতন প্রতিহত করা প্রভৃতি কাজে সরকারের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি- সেটিও স্পষ্ট নয়। কথায় আছে- আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাহলে এই ৪৫ শতাংশ শিশুকেই ভবিষ্যতের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কেনইবা আলাদাভাবে শিশু উন্নয়ন অধিদফতর গঠন করা হচ্ছে না? যদি রাষ্ট্রই শিশুদের অধিকারগুলোকে অবজ্ঞা করে তবে তার প্রতিফলন সমাজে ঘটবেই। একইভাবে রাষ্ট্র যদি শিশুদের বিষয়ে আন্তরিক থাকে তবে সমাজ থেকে শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধ লোপ পাবে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন-এ, প্রকাশকাল: দুপুর ১২:০৭ আগস্ট ২৯, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.