পাকিস্তান-ফেরত অফিসারদের জায়গা দেওয়া ছিল মস্ত ভুল
পাশের দেশ ভারতের কথাই ধরেন, দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথ বের করে। অথচ আমাদের দেশে দলাদলির শেষ নেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দিনে দিনে বাড়ছে। কে কেমন মানুষ তার গুরুত্ব নেই। কে কোন দলের, সেটাই যেন গুরুত্বপূর্ণ। এমন দেশের জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি।
‘‘গ্রামে তখন ফুটবলটা কম চলত। হাডুডু ছিল জনপ্রিয় খেলা। ছোটবেলা থেকেই ছিলাম সুঠামদেহী ও লম্বা। তাই সবাই খেলায় নিতে চাইত। বন্ধুদের কাছেও মিলত বাড়তি কদর।’’
‘‘১৯৬৬ সালের মার্চ মাস। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বন্ধুদের নিয়ে প্রদর্শনী মেলা দেখতে গিয়েছিলাম দিনাজপুর শহরে। ডিসি অফিসের পাশেই ছিল বড় মাঠ। দেখলাম সেখানে দুশ আড়াইশ জন লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। সেনাবাহিনীতে লোক নিচ্ছিল। কী হয় সেটা সাইডে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম।’’
‘‘দূর থেকে এক পাঠান সুবেদার আমাকে খেয়াল করলেন। কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুম আর্মি মে ভর্তি হো গা?’ কিছু না ভেবেই শুধু বললাম, ‘যদি নেন।’ হাতের মাসল বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘চার বকসিন লাগাও।’ শক্ত করে দুইটা মারতেই উনি বললেন, ‘ঠের, হো গ্যায়া।’’’
‘‘আমার সিনা ও হাইটের মাপ নেওয়া হল। অতঃপর মুচকি হেসে বুকের মধ্যে ধাড়াম করে সিল মেরে দিলেন। টিকে গেলাম আর্মিতে। নম্বর ছিল- ৩৯৩৬২৯০। প্রথম ট্রেনিং চলল চিটাগাং ইবিআরসি ক্যাম্পে। পরে কসম প্যারেড করিয়ে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের লাহোরে। ফিরে এসে যোগ দিই সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টে। একাত্তরে আমি ছিলাম জয়দেবপুর ব্যারাকে।’’
স্মৃতি হাতড়ে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেকার নানা ঘটনার কথা জানাচ্ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। যুদ্ধদিনের গদ্য শুনব বলেই এক সকালে আমরা পা রেখেছিলাম দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধর্মদহ গ্রামে, তাঁর নিজ বাড়িতে।
শেহার উদ্দিন আহমদ ও আছিয়া খাতুনের মেজ ছেলে আবদুল জব্বার। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ধর্মদহ বেঙকুড়ি প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পরই তিনি ভর্তি হন বিরল পাইলট স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন সেনাবহিনীর একজন ল্যান্স নায়েক।
ব্যারাকের ভেতরকার বৈষম্যের কথা জানালেন এই যোদ্ধা। তাঁর ভাষায়, ‘‘আমাদের দেখতে পারত না পাঠান-পাঞ্জাবি সৈন্যরা। নানাভাবে কটূক্তি করত। ব্যারাকে রাতের খাবার ছিল রুটি। বাঙালি সৈন্যরা খেত ভাত। এ নিয়ে ওরা ব্যঙ্গ করে হাসাহসি করত। কখনও কখনও মুখের ওপর বলত, ‘শালা বাঙালি আদমি, চাইল খাতে আতা হ্যায়’। আমরা মুখ বুজে সব সহ্য করতাম। ওরা দলে ছিল ভারি। প্রতিবাদ করলে সামরিক আইনে আমাদেরই সাজা খাটতে হত।’’
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকের কথা। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটিতে গ্রামে আসেন জব্বার। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। পাকিস্তানি সৈনারা গণহত্যা চালায় ঢাকায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সারাদেশে জেলা শহরগুলো দখলে নেয় পাকিস্তানি সেনারা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ফলে জব্বারের আর ব্যারাকে ফেরা হয় না। অস্ত্র তুলে নেন দেশকে মুক্ত করার মানসে।
আপনারা তখন কী করলেন?
জব্বারের উত্তর: ‘‘আমি তো ট্রেন্ড সোলজার। দেশের ওই অবস্থায় বসে থাকতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুবকদের প্রথম একত্রিত করতে থাকি। রামপুরের এক আনসার কমান্ডারও সঙ্গে যুক্ত হন। মেহরুল ইসলাম, মালেক, আনোয়ার, গফুর, আজিজ, জব্বার, আকবরসহ শতাধিক যুবক নিয়ে আমরা বিরল থানা ঘেরাও করি। থানায় ছিল একজন নন-বেঙ্গলি অফিসার। মালখানার চাবি নিয়ে আমরা অস্ত্রগুলো নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিই।’’
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকণ্ঠ কুঠিবাড়ীতে। ২৮ মার্চ, ১৯৭১। বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে ওখানে অস্ত্র ধরে পাঠান-পাঞ্জাবিরা। শুরু হয় গোলাগুলি। সেখান থেকে কজন বাঙালি ইপিআর জোয়ান হাতিয়ারসহ চলে আসেন জব্বারদের দলে।
[নিজের সব কথা বলছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বার:
https://www.youtube.com/watch?v=Dc7wtiGfxLQ&feature=youtu.be]
এপ্রিলের মাঝামাঝির ঘটনা। বিরল তখনও মুক্ত এলাকা। পাইলট স্কুলের মাঠে জব্বাররা স্থানীয় যুবকদের রাইফেল চালানোর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দেন। তাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ারও চেষ্টা চালান। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের ভারি অস্ত্রের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এপ্রিলের শেষে পাকিস্তান আর্মি বিরল পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেয়। তাদের হেডকোয়ার্টার বসে বিরল স্টেশনে আর আর্টিলারি হেডকোয়ার্টার মারপুকুরে।
আপনারা তখন কোথায় গেলেন?
‘‘মাকে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে আমি চলে আসি ভারতের কুসুমাণ্ডি থানার পালসার গ্রামে। ওখানে মাকে রেখেই দলবলসহ চলে যাই প্রাণসাগর ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আশরাফ সিদ্দিকী। প্রাণসাগর থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় হিলি কামালপাড়ায়। এক বিকেলে সেখানে আসেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস। তিনি ছিলেন খুব দুর্ধর্ষ। কেউ তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাইত না। তিনি খুঁজছিলেন ট্রেন্ড সৈন্য। ক্যাম্পে আমরা ১২ জন ট্রেন্ড সেনা ছিলাম। রাজি হতেই তিনি আমাদের জিপে তুলে নেন। অতঃপর চলে আসেন ৭ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর হামজাপুরে।’’
একটি অপারেশনের কথা শুনি মুক্তিযোদ্ধা জব্বারের জবানিতে–
‘‘একবার ভারতের তরঙ্গপুর হয়ে আমরা ঢুকে পড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। জাবরহাট নামক গ্রামের এক স্কুলে আশ্রয় নিই। ওখানকার গ্রামের অধিকাংশ লোকই ছিল ‘দিগরিয়া’ (চাপাই, মুর্শিদাবাদ থেকে আগত)। আমাদের দেখে তারা বাড়তি প্রশংসা করে। আদর-আপ্যায়নেরও কমতি নেই। বিকেলের দিকে খাসি জবাই হয়। সন্ধ্যা নামতেই খেতে বসেছি সবাই। ভাতের নলা মুখে দিয়েছি, অমনি চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি। আমরা তো হতভম্ব। যে যার মতো ছুটে পালাই।’’
‘‘পূর্বদিকে ছিল একটি বিল। কয়েকজন কোনো রকমে আশ্রয় নিই সেখানে। শরীরে আটকে আছে রক্তচোষা জোঁক। তবুও সে খেয়াল নেই। কেটে যায় সারা রাত। ওই গ্রামের দিগরিয়ারা ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে। আমাদের খাওয়ানোর কৌশল এঁটে তারা গোপনে খবর দিয়ে আসে পাকিস্তানি আর্মিদের। তখন পুরো একটি কোম্পানি এসে আক্রমণ চালায়।’’
‘‘সেদিন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আমাদের এক সহযোদ্ধা। এরপর থেকে আমরা কোথাও আশ্রয় নেওয়ার আগেই খবর নিতে হত আশ্রয়দাতারা রাজাকার, আলবদর বা শান্তি কমিটির অনুসারী কিনা।’’
বগুড়ার ক্ষেতলাল থানায় ট্রেনিংয়ের প্রথম অপারেশনের কথা জানালেন জব্বার–
‘‘আমরা ১৮ জনের মতো। কমান্ডে সুবেদার তাহের। খানরা ১৩ জনের একটি দল টহল দিতে গিয়ে জ্বালিয়ে দেয় একটি গ্রাম। তাদের ফেরার পথে আমরা অ্যামবুশ করি। ১০০ গজের মধ্যে আসতেই প্রথম আমি গুলি ছুঁড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সহযোদ্ধাদের স্টেনগানও গর্জে ওঠে। খানরা সবাই লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু একজন কোন ফাঁকে যেন ওয়্যারলেসে ম্যাসেজ দিয়ে দেয়, আমরা তা টের পাইনি। দ্রুত তাদের অস্ত্রগুলো নিয়ে সরে পড়ছি। মিনিক পাঁচেকের মধ্যেই শত শত সেল এসে পড়ে ওই জায়গায়। আর কয়েক মিনিট দেরি হলে আমরা হয়তো সেখান থেকে ফিরতে পারতাম না।’’
এভাবেই ‘ভয়কে জয় করে’ আবুল জব্বাররা অপারেশন করেন কানশাট, দিনাজপুরের পুকুরিয়া হাইস্কুল, দলদলি, হিলি, জাবরহাট, বিরল, খানপুর, লামাটিয়া প্রভৃতি এলাকায়।
এক সন্মুখ-যুদ্ধে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন জব্বার। গুলিটি তাঁর পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনে?
ম্লান মুখে জব্বার বিবরণ দিলেন পুরো ঘটনার–
‘‘১১ নভেম্বর। হামজাপুর ক্যাম্পে বিকেলের দিকে পরিকল্পনা হয় খানপুর আক্রমণের। ভারতের এক কর্নেল আর এক মেজর ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আক্রমণের সম্মুখে থাকব আমরা। পেছনে ভারতীয় সেনা আর আর্টিলারি সাপোর্ট। ১২ নভেম্বর ভোর ৪ টা। আমরা প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা খানপুরের দিকে রওনা হই।’’
‘‘জামালপুরের কাছাকাছি আসতেই শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। আমরা গুলি চালাই আর ক্রলিং করে করে সামনে এগুই। আমার ডান পাশে লেফটেন্যান্ট আমিনুল। অন্য পাশে বন্ধু মালেক। গোলাগুলি চলছেই। সকালের দিকে আমরা পরিশ্রান্ত। মনের মধ্যে অন্য রকম চাপ। বেঁচে থাকব নাকি মরে যাব? নানা চিন্তা ভর করে।’’
‘‘গুলি থামিয়ে পাশ থেকে মালেক সিগারেট ধরায়। তাতে কয়েক টান দিয়ে এগিয়ে দেয় আমার দিকে। আমি সিগারেটটায় একটা টান দিতেই ব্রাশফায়ারের গুলি এসে লাগে মালেকের পায়ে। রক্তে ভিজে যায় তার গোটা পা। আমি তাকে পেছনে যেতে দেবার জন্য সাপোর্টিং ফায়ার করি। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমার পা দুটোও যেন এগুচ্ছে না। ঝিমঝিম করছে গোটা শরীর। ভাবলাম, সাপে কাটল না তো!’’
‘‘নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করতেই দেখি, পেট থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। পিঠের দিকটায় স্পর্শ করতেই অনুভব করি বেশ খানিকটা মাংস উড়ে গেছে। কখন যে ব্রাশফায়ারের একটি গুলি পেটের এপাশ থেকে ওপাশে বেরিয়ে গেছে টেরও পাইনি। তখন ক্রলিং করে পেছনে হটি। রক্ত বন্ধ করতে এক হাতে চেপে ধরি পেট।’’
‘‘খানরা আমাকে তাক করে তখনও গুলি ছুঁড়ছিল। আমি ওদের টার্গেটে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে রক্ষায় সাপোর্টিং ফায়ার করতে এগিয়ে আসে লেফটেন্যান্ট আমিনুলসহ কয়েক জন। আমাকে প্রথমে ক্যাম্পে ও পরে নেওয়া হয় ভারতের রায়গঞ্জ হাসপাতালে। সুস্থ হওয়ার দিন দুয়েক পরেই খবর পাই, দেশ স্বাধীন হয়েছে। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন!’’
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে জব্বারের বড় ভাই আবদুল সাত্তারকে। সে ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি আবেগতাড়িত হন। কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলেন:
‘‘আমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে ভাইকে হত্যা করে তারা। বিরলে মুসলিম লীগার ছিল নুরু মৌলভি, ইউনুস খলিফা, ইসপ খলিফা, মাহাবুব, বসর ডাক্তার। পিস কমিটি সভাপতি ছিল নুরু মৌলভি আর সেক্রেটারি মাহাবুব মাস্টার। আমার ভাই সাত্তার মাঝে মধ্যে চলে আসতেন হামজাপুর ক্যাম্পে। জুনের ১১ তারিখের কথা। রাজাকার মফিজুর রহমানের সহযোগিতায় খানরা তাঁকে ধরে ফেলে। সঙ্গে বেঁধে আনে বাবাকেও।’’
‘‘প্রথমে বিরল থানায় টর্চার চলে তাদের ওপর। থানার পাশের রেললাইনের কাছে আছে একটা বটগাছ। লোকজনকে দেখাতে প্রকাশ্যে চোখ বেঁধে গাছের সঙ্গে বাবাকে একদিন বেঁধে রাখে ওরা। মুক্তিযোদ্ধার বাপ, এটাই তাঁর অপরাধ। পরে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে। সাত্তার ভাইকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে আবার টর্চার করে। পরে ভক্তাহার নামের একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।’’
‘‘ভাইয়ের লাশটা আমরা পাইনি। স্বাধীনতার পর সেখানে আরও কয়েকটি লাশ মাটিচাপা অবস্থায় ছিল। রক্তে ভরা ছিল ডোবাগুলো। মানুষের রক্তের কোনো দামই ছিল না তখন। সংরক্ষিত না থাকায় সে জায়গাটিও আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলার মাটির সঙ্গে মিশে আছে সাত্তার ভাইয়ের মতো অগণিত শহীদের রক্ত।’’
দেরিতে হলেও রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার স্বাধীন এ দেশে হচ্ছে। জব্বারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতরের কষ্টগুলোও এখন কমে আসছে। তিনি বলেন,
‘‘আমার ভাই ও বাবাকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল এক রাজাকার। এটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলতে পারব না। এ সরকার তাদের বিচার করছে, তাই আমি মন থেকে দোয়া করি শেখ মুজিবের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।’’
আরও আগে কেন এদের বিচার হল না, এর জন্য কাকে দায়ী করবেন?
তিনি অকপটে প্রকাশ করেন নিজের মতামত:
‘‘বিচারটা করবে কে? শেখ সাহেব শুরু করেছিলেন, তাঁকেই তো নির্মমভাবে হত্যা করল। এরপর জিয়া এসে গদির লোভে ওদের মন্ত্রী বানাল। মুক্তিযোদ্ধাদের করল অপমান। ইতিহাস হল কলঙ্কিত। সব দলের মদদেই স্বাধীন দেশে রাজাকাররা ক্ষমতাবান হয়েছে।’’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে এ মুক্তিযোদ্ধা পৃথিবীর সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা মনে করেন। তাঁর ভাষায়–
‘‘দেখুন, পাকিস্তান সরকার কী করেছে। ১৯৭১ সালে যে ৯৩ হাজার সেনা আত্মসর্মপণ করেছে তাদের সবাইকে দ্রুত অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমরা করেছি এর উল্টোটা। আমাদের নেতার মন ছিল বড়। সবাইকে তিনি ভালোবাসতেন, নিজের লোক মনে করতেন। তাই পাকিস্তান-ফেরত সেনা অফিসারদের সেনাবাহিনীতে জায়গা দিয়েছিলেন। এটা ছিল মস্ত বড় ভুল সিদ্ধান্ত। মেজর ডালিম, ফারুক এরা ছিল পাকিস্তান-ফেরত। ট্যাংক রেজিমেন্ট ও আর্টিলারি রেজিমেন্ট মিলেই তো এই ঘৃণ্য কাজটা করেছে। আমি মনে করি, তার সঙ্গে অবশ্যই আওয়ামী লীগের কিছু বড় নেতা যুক্ত ছিলেন। তা না হলে হত্যার পর নেতারা কেন টু শব্দটি পর্যন্ত করলেন না?’’
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:
‘‘দেশ স্বাধীনের পরপর এটি হলে সমস্যা থাকত না। তখন রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনার তালিকা কল্যাণ ট্রাস্টে জমা ছিল। সুবিধা লাভের আশাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা শুধু বাড়ছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তারাও এখন হাসতে হাসতে সরকারি ভাতা ওঠায়। এগুলো দেখলে দুঃখ লাগে। সুবিধা পাব মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এমন চিন্তা তো করিনি। লক্ষ্য ছিল একটাই, দেশকে মুক্ত করতে হবে, খানদের হটাতে হবে।’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার কথা জানতে চাই আমরা। মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা জব্বার বলেন:
‘‘‘গুলি খেয়েছি সেটি বড় কথা না– দেশ যে উপহার পেয়েছি, জাতি হিসেবে পৃথিবীতে জায়গা করেছি, এটিই আমার গৌরব।’’
দেশ নিয়ে আক্ষেপের কথাও জানান মুক্তিযোদ্ধা জব্বার। তাঁর ভাষায়:
‘‘পাশের দেশ ভারতের কথাই ধরেন, দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথ বের করে। অথচ আমাদের দেশে দলাদলির শেষ নেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দিনে দিনে বাড়ছে। কে কেমন মানুষ তার গুরুত্ব নেই। কে কোন দলের, সেটাই যেন গুরুত্বপূর্ণ। এমন দেশের জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি।’’
নতুন প্রজন্ম এ দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, এমনটাই আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বারের। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন:
‘‘তোমরা লেখাপড়া করে যোগ্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তোল। শুধু নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই দেশ ত্যাগ কর না। মনে রেখ, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এ দেশ পেয়েছি। সে দেশকে তোমাদেরকেই সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে।’’
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.