সব মুসলিম লীগার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করেনি
আজাদ আলীদের পরিবারটি ছিল বেশ বড়। এগার ভাইবোন। তাদের মধ্যে আজাদ সপ্তম। সংসার বড় হলেও আদরের এতটুকু কমতি ছিল না তাঁর। খুব বেশি লেখাপড়া করেননি বাবা আরজান আলী প্রামাণিক। তবু সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে ছিলেন সচেষ্ট। তাঁর উৎসাহ ও সহযোগিতায় ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পান আজাদ আলী। আড়ানি প্রাইমারি স্কুলের কোনো শিক্ষার্থীর ওটাই প্রথম বৃত্তি পাওয়া। খবর শুনে গোটা গ্রামে হৈ হৈ রব ওঠে। আরজান আলীর মুখেও তখন আত্মতৃপ্তির হাসি।
বাল্যবন্ধুদের স্মৃতি আজও ঝাপসা হয়নি আজাদের মন থেকে। দলবেঁধে ফুটবল খেলা আর তপ্ত দুপুরে বড়াল নদীর বুকে শরীর ভাসানোর আনন্দটাই ছিল অন্য রকম।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা, গঙ্গাস্নান ও দুর্গাপূজা আর মুসলমানদের ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিত গ্রামের সবাই। জাত-পাতের বিভেদ তখনও তৈরি হয়নি। সামাজিক বন্ধনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ধর্ম।
তাঁর শৈশব ও কৈশোরের নানা স্মৃতির কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আজাদ আলীর মুখে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসিকতা ও বীরত্বের কারণে তিনি ‘বীর প্রতীক’ খেতাব লাভ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার (আগে ছিল চারঘাট) কুশাবাড়িয়া গ্রামে।
[ ভিডিও : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক মোহাম্মদ আজাদ আলীর বিবরণে যুদ্ধদিনের গদ্য শুনুন ]
আজাদ আলীর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আড়ানি প্রাথমিক স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাশের পরই তিনি ভর্তি হন আড়ানি মনমোহিনী হাই স্কুলে। ১৯৬৬ সালে ওখান থেকেই এসএসসি পাশ করেন। পরে এইচএসসি সম্পন্ন করেন রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে। ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। মুক্তিযুুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর জোহার স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলী বলেন–
‘‘১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। তাঁর মুক্তিসহ ৬ দফা ও ১১ দফার জন্য আন্দোলন চলছে। আমরা মিছিল করছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের সামনে। রেডিওর একটি অফিস ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অপজিটে। সেখানকার মাঠের খড় কেটে রাস্তায় রাখা হয়েছিল। হঠাৎ মিছিল থেকে খড়ের গাদায় আগুন দেওয়া হয়। মিলিটারিরাও তখন গুলি চালায়। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে শহরের দিকে এগুচ্ছিল। গুলির শব্দে রাস্তায় ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ শিক্ষক ও প্রক্টর ডক্টর জোহা। মিলিটারিদের তিনি বলেন, ‘তোমরা ছাত্রদের কিছু বল না। লেট মি কন্ট্রোল দেট।’
তারা তাঁর কথায় কান দেয় না। বরং প্রকাশ্যে চোখের সামনে তাঁকে বেয়নেট চার্জে রক্তাক্ত করে। আবদুর রহমান ছিলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। এ ঘটনার পরপরই ছাত্রদের আন্দোলন আরও দানা বাঁধতে থাকে।’’
সত্তরের নির্বাচনের সময়টাতে আজাদ আলী ফিরে যান নিজ গ্রামে। যুক্ত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রচারকাজে। তাঁর এলাকায় এমএনএ হিসেবে নির্বাচিত হন নাজমুল হক সরকার আর এনপিএ হন ডাক্তার আলাউদ্দিন। তাদের প্রতিপক্ষ ছিলেন মুসলিম লীগের আইনুদ্দিন।
মুসলিম লীগারদের সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলীর অভিমত–
‘‘‘রাজশাহীতে ওদের শক্ত অবস্থান ছিল। মূলত রাজশাহীর বেশিরভাগ লোক ছিল মুর্শিদাবাদ ও মালদহ থেকে আগত। তারা পাকিস্তান বলতেই অজ্ঞান থাকত। পাকিস্তান টিকে থাকলে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ওদের হাতে থাকবে। তাই তারা মনেপ্রাণে চাইত পাকিস্তানের অখণ্ডতা।’’
আজাদ আলী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন রেডিওতে। ওই ভাষণই তাঁর মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা টেনে আনে। তাঁর ভাষায়:
‘‘বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ তখন বুঝে যাই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ অনিবার্য।’’
আপনারা তখন কী করলেন?
‘‘গ্রামের আবদুস সাত্তার মাস্টার, সোলেমান ভাইসহ অনেককে নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে মিছিল ও মশালের দায়িত্বটা ছিল আমার ওপর। কয়েক দিন পরই আমরা ২০-২৫ জন ট্রেনিং নিই। ট্রেনিং দেন শমসের আলী, মহসীনসহ কয়েক জন আনসার। লাঠি ছিল একমাত্র ভরসা। পরবর্তীতে ট্রেনিংটা কাজে না লাগলেও যুদ্ধের মনোবল তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওটা থেকেই।’’
২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। সারাদেশে পাকিস্তানি সেনারা হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। গোপালপুর সুগার মিলে ক্যাম্প বসায় আর্মিরা। আজাদরা তখন প্রতিরোধ গড়ার পরিকল্পনা নেন। তাদের হাতে অস্ত্র বলতে ছিল কোচ, বল্লম, দা, কাঁচি ও লাঠি।
মে মাসের ৬ ও ৭ তারিখের ঘটনা। সুগার মিল থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে রাজশাহীর দিকে যাচ্ছিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি ব্যাটেলিয়ন। কয়েক সেনা দলছুট হয়ে পানি খেতে গ্রামে ঢুকতেই আজাদরা তাদের আক্রমণ করেন। এভাবে আড়ানি ও গোচর গ্রামে সাত-আট পাকিস্তানি সেনাকে তাঁরা হত্যা করেন। কিন্তু লাঠি আর কোচ দিয়ে তো আর্মিদের সঙ্গে যুদ্ধ চলবে না। আজাদরা তাই সিদ্ধান্ত নেন ট্রেনিংয়ে যাওয়ার।
তাঁর ভাষায়:
‘‘মে মাস তখনও শেষ হয়নি। কুষ্টিয়া হয়ে আমরা চলে যাই ভারতের জলঙ্গিতে। সেখানে কয়েকদিন চলে লেফট-রাইট। অতঃপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহার চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে। ট্রেনিং চলে জুলাইয়ের ২ থেকে আগস্টের ২ তারিখ পর্যন্ত। আমার এফএফ নং ছিল- ৪০৬৩।’’
ট্রেনিংয়ে কী শেখানো হল?
‘‘গেরিলা, স্মল আর্মসের ব্যবহার, এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ডেমুনেশন করা, হিট অ্যান্ড রান পলিসি প্রভৃতি। ভারতীয় ট্রেইনারদের অধিকাংশই পঁয়ষট্টিতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে গুলি খেয়েছেন। ক্যাপ্টেন মিশ্র ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার।’’
কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?
‘‘ট্রেনিং শেষে আমাদের প্রথমে পাঠানো হয় মুর্শিদাবাদে। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে সেখানে ৭ নং সেক্টরের ৪ নং লালগোলা সাব-সেক্টর ছিল। সেখানে ১১ জনকে আমার সঙ্গে দিয়ে তিনি আমাদের ক্যাপ্টেন রশিদের কাছে যেতে বললেন। রশিদ ছিলেন রাজশাহীর পূর্বাঞ্চল আর পাবনার দায়িত্বে। তাঁর নির্দেশেই খাজুরার থাক নামক একটি পরিত্যক্ত বিওপিতে অবস্থান নিই। সেখানে নাজিরের নেতৃত্বে ছিল আরেকটি দল। বিওপি থেকে নৌকাযোগে ভেতরে ঢুকে আমরা আবার ফিরে আসতাম। বন্যা হওয়ায় পরে আমার চলে আসি চৌদ্দবাইসা নামক মুক্তাঞ্চলে। আমি অপারেশন করি বাউসার হাট, বাঘা মসজিদ, ডাকরার হাট, আড়ানি রেলওয়ে ব্রিজ ও নাবির পাড়ায়।’’
এক অপারেশনে মাইনের আঘাতে উড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলীর বাঁ হাতের কব্জির নিচের অংশ। দেশের জন্য রক্তঝরানো সেই দিনটির কথা শুনি তাঁর জবানিতে:
‘‘২১ নভেম্বর, ১৯৭১। বিঘা থেকে আমরা আসি নাবির পাড়ায়। ওই পথেই রাজশাহী টু আবদুলপুর আর্মির একটি ট্রেন টহল দিত। আমরা টার্গেট করি ওই ট্রেন ডেমুনেশনের। আমাদের কাছে ছিল ৬টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন।
রেল লাইনে মাইন সেটের কিছু নিয়ম ছিল। আর্মি ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে দুটি বালির বগি থাকবে, সেটি বাদ। পেছনের দুটি বালির বগিও বাদ। একটা ইঞ্জিনের নিচে যেন একটা মাইন বিস্ফোরিত হয়, এভাবে ক্যালকুলেশন করে আমরা কটেক্স দিয়ে মাইন সেট করে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন ট্রেনটি আসেনি।
আমরা তখন রাত কাটাই লক্ষণবাড়িয়ায়। পরদিন, অর্থাৎ ২২ নভেম্বর সন্ধাবেলা। নাবির পাড়ায় আখ খেতের পাশের রেল লাইনের মাটি খুঁড়ে স্লিপারের নিচে মাইন সেট করি। কডেক্স বসানো, ডেটোনেটর সেট করা, ৩০০ গজ তারও লেআউট করা হয়েছে। সব ঠিকঠাক। শেষে দেখলাম হলুদ রঙের ওই কডেক্সগুলো ক্যামোফ্লেজ করা হয়নি। লাইট পড়লেই সেগুলো জ্বলজ্বল করে।
রাত তখন ১০টা বেজে ৩০ মিনিট। হঠাৎ নাটোর থেকে একটি ট্রেন চলে আসে। আমরা ওই ট্রেনের সার্চ লাইটের মধ্যে পড়ে যাই। দ্রুত হাইড আউট হয়ে সিদ্ধান্ত নিই এভাবেই বিস্ফোরণ ঘটানোর। সুইচটা ডেটোনেটরের সঙ্গে লাগিয়ে সব ঠিক করে নিলাম। কিন্তু তখনই খবর আসে, আমাদের টার্গেট ট্রেনটি আসেনি। এই সুযোগে আমরা তারগুলো ক্যামোফ্লেজ করে ফেলার কাজ শুরু করি। ৬ জনকে রেখে বাকি ২৪ জনকে পাঠিয়ে দিই নাবির পাড়া স্কুলে।
রাজশাহী থেকে আবদুলপুর গামী কাঙ্ক্ষিত ট্রেনটি আসার উপক্রম হবার আগেই আমি কানেকশন দিতে অগ্রসর হই। আমার সঙ্গে ছিল মাহবুবুল গনি বাবলু। সে বলল, ‘ভাই, রিলিজ সুইজের ওয়েট থেকে একটা ইট কমিয়ে দিই।’ আমি যখন কানেকশনটা দিই, ঠিক তখনই সে একটা ইট কমিয়ে দিল। কিছু বোঝার আগেই অমনি ৬টা মাইন এক্সপ্লোশন হয়ে যায়।
প্রচণ্ড শব্দে আমার কান বন্ধ হবার জোগাড়। দেখলাম রেল লাইনটা পুকুর হয়ে গেছে। মাথার ওপর দিয়ে স্লিপার ও রেল লাইনের পাতগুলো শো শো করে উড়ে যাচ্ছিল। সুইচটা ছিল রেল লাইন থেকে ৪ ফিট নিচে। সেখানে বসে ছিলাম বলেই আজ বেঁচে আছি। আমার হাত তখন উড়ে গেছে। বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে নাবিরপাড়া স্কুল থেকে সহযোদ্ধারা দৌড়ে চলে আসে। তখনও বুঝতে পারিনি যে, আমার হাত নেই। হাতে একটা খড়ি ছিল। সেটি দিয়ে সবাইকে ইনস্ট্রাকশন দিতাম। সেটি খুঁজতে গিয়ে খেয়াল করলাম বাঁ হাত কব্জির নিচ থেকে নেই!
সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। তখনও রক্ত বের হয়নি। সহযোদ্ধারা আমার হাত শক্ত করে বেঁধে দেয়। অনেক পরে পিন পিন করে রক্ত বেরুতে থাকে। একটা কাঠের তক্তায় আমাকে শুইয়ে বাঁশের দড়ি বেঁধে ওরা আমাকে নিয়ে যায় বাঘাতে। সেখানে লাল মোহাম্মদ নামের একজন চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। পরে জলঙ্গি হয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বহরমপুর হাসপাতালে। সেখানে ডক্টর বোস আমার হাতের অপারেশন করলেন।’’
অপারেশনটি কি বিফলে গিয়েছিল?
‘‘না, ট্রেন উড়াতে না পারলেও রেল লাইন উড়ে যাওয়ায় ওই ট্রেনটি প্রচণ্ড গতিতে এসে গর্তে পড়ে। ফলে ওদের ১৬ জন সেনা সেদিন মারা যায়। ১১ জন মারাত্মক আহত হয়।’’
স্বাধীনতার পরের জীবনযুদ্ধের কথা বলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা–
‘‘১৯৭২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘তুই যা হারিয়েছিস তা তো আর ফিরিয়ে দিতে পারব না। তুই কী চাস?’ আমি তখন কৃত্রিম হাত লাগানোর ইচ্ছার কথা বলি। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে আমাকে পাঠানো হয় হাঙ্গেরিতে। সেখান থেকে এসে মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষকতা করি একটি কলেজে। বেতন ছিল কম। তাও পেতাম না ঠিকভাবে। পরে চলে আসি ঢাকায়। নিজের যোগ্যতায় চাকরি নিই আর্মি হেডকোয়ার্টারের ইএমই ডাইরেকটরেটে। সর্বশেষ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ফাইন্যান্স অফিসার হিসেবে অবসর নিয়েছি।’’
কথা ওঠে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলী যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন তাঁর মতামত:
‘‘মুসলিম লীগাররা শান্তি কমিটিতে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে সবাই কাজ করেনি। অনেকে পক্ষেও কাজ করেছে। অপারেশনের সময় আমরা অনেক বার শান্তি কমিটির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। তারা তো কোনো সমস্যা করেনি। স্বাধীনতার পর যদি তাদেরও শাস্তি দেওয়া হত তাহলে সেটি হত আরেক অন্যায়। ১১শ যুদ্ধাপরাধী বাদ দিয়ে বাকিদের ক্ষমা করাটা ছিল বঙ্গবন্ধুর যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।
আসল ক্ষতি করেছেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওই ১১শ যুদ্ধাপরাধীকে তিনি মুক্ত করে দেন। মন্ত্রী বানান রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান ও আবদুল আলীমকে। ডিফেন্সে তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেয়ে পাকিস্তান-ফেরত সেনাদের সংখ্যা ছিল বেশি। ১৯৭৭ সালে জিয়া এয়ার ফোর্সের একটি ব্যাটেলিয়নকে ম্যাসাকার করে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেককেই তখন সন্ধ্যার পর ধরে নিয়ে যাওয়া হত। মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন জিয়ার চিন্তার কারণ।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ এখনও রয়ে গেছে। কারণ জলে আর তেলে কখনও মিশে না।’’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে বীর প্রতীক আজাদ আলী বলেন:
‘‘সর্বপ্রথম রাজাকারদের তালিকা করলেই সবচেয়ে ভালো হত। আর ’৭২-’৭৪ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার উপযুক্ত সময়। তখন ফ্রেস ইন্ডিয়ান তালিকাগুলো ছিল ইবিআরসিতে। এছাড়া সব সেক্টর কমান্ডারও তখন জীবিত ছিলেন। তাই সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের উদ্যোগেই সহজে তালিকা করা যেত। ওসমানী সাহেবের সনদ আর হোম মিনিস্ট্রির সনদ এক সময় সের দরে বিক্রি হয়েছে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আরও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।’’
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন একাত্তরে, সে দেশ পেয়েছেন কি?
‘‘চেয়েছিলাম স্বাধীন দেশ হবে, স্বাধীন মানচিত্র হবে এবং আমার দেশের মানুষ দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। এখন সেটা পেয়েছি। এদেশে না খেয়ে এখন কেউ মারা যায় না। এর চেয়ে সুখের আর কী আছে?’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই সূর্যসন্তান বলেন:
‘‘আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। বিশ্বে আমরা আজ মাথা তুলে দাঁড়ানো একটা জাতি। এটা ভাবতেই ভালো লাগে।’’
খারাপ লাগে কখন?
‘‘‘যখন দেখি অনিয়ম হচ্ছে– যখন দেখি রাজনীতির নামে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মারা হচ্ছে– তখন খুব খারাপ লাগে। মানুষ হত্যা করার জন্য তো দেশ স্বাধীন করি নাই।’’
কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের উত্তর মিলে তাঁর মুচকি হাসিতে।
‘‘ক্ষমতায় এখন আওয়ামী লীগ। সেইদিন পত্রিকায় দেখলাম জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে। এই লক্ষণটা কিন্তু ভালো নয়। ওরা তো গোখরা সাপ। ওরা যোগ দিচ্ছে নিজেদের বাঁচাতে আর আওয়ামী লীগকে পচাতে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এদেশ থেকে নিষিদ্ধ করা উচিত। জনগণ কী চায় তা সরকারকে বুঝতে হবে। নীতির প্রয়োগ না হলেই দুর্নীতি বাড়বে। এগুলো সরকারকে খেয়াল করতে হবে।’’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আজাদ আলী মনে করেন, পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরেই এই দেশ একদিন উন্নত হবে। তাই তাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে তিনি শুধু বললেন–
‘‘তোমরা কখনও দেশটাকে খাটো করে দেখো না। মায়ের পরেই ভালোবাসবে মাতৃভূমিকে। দেখবে এই দেশপ্রেমই তোমার জীবন পূর্ণ করে দিবে।’’
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়ের্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : আগস্ট ৩১, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.