শারদীয় সোমেশ্বরী
বিকেল হয়-হয়। আমরা তেরিবাজার ঘাটে। রোদের ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে। ঘণ্টাখানেকেই অস্থির হয় বন্ধু নিটু। নাক ফুলিয়ে ক্যামেরা হাতে পায়চারি করছে সে। তা দেখে দিপু মুখ টিপে হাসে। এ জগতে কী ঘটছে, সে খবর নেই মনিরের। ছবি তোলায় সে মহাব্যস্ত। আশপাশের সব কিছুই যেন তার ছবি তোলার সাবজেক্ট। ওদিকে জার্নি করে মোর্শেদ বেশ ক্লান্ত। ডাক্তারি বিদ্যায়ও কমাতে পারছে না নিজের মাথাব্যথা। বেজাড় মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবতা ভাঙে মোর্শেদই-‘ইশ, দেরি হলে সব কিছু মাটি হয়ে যাবে।
না, তার চিন্তা দুশ্চিন্তায় রূপ নিল না। তার আগেই ঘাটে এসে ভেড়ে বড় এক নৌকা। মাঝির ওপাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে মুচকি হেসে আমাদের স্বাগত জানাল স্থানীয় নাট্যকর্মী ও আমাদের গাইড গোপাল।
প্রায় লাফিয়ে নৌকায় উঠি সবাই। বালি টানার নৌকা। পাঁচজনের ভারে এতটুকু দুলুনি নেই। গোপালের নির্দেশ পেতেই লগির ধাক্কায় অথৈ জলে নৌকা ভাসায় মাঝি আমিরুল। ইঞ্জিনের শব্দে সোমেশ্বরী নদীর পানি কেটে ধীর লয়ে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলে দূর পাহাড়ের খোঁজে।
গেল বছরের কথা। বন্ধু দিপু দেশে এলো বেড়াতে। থাকে বিলেতে। সঙ্গে এনেছে নতুন ক্যামেরা। ওদিকে নিটু আর মোর্শেদ ফটোগ্রাফির কোর্স করে বসে আছে। সবাই পরিকল্পনা করছিলাম ঢাকার বাইরে যাওয়ার। দিপুকে পেয়ে উৎসাহের পালে লাগে হাওয়া। ভ্রমণে টেলিল্যান্স সঙ্গে না থাকলে কি চলে! তাই তড়িঘড়ি করে একটা টেলিল্যান্স কিনেই আনল নিটু। আমাদের তোরজোর দেখে পাড়ার ছোটভাই মোর্শেদও আগ্রহ দেখাল। ট্যুরে একজন ডাক্তার থাকলে মন্দ হয় না। তাই সবাই রাজি হয়ে গেল।
পরিকল্পনা হয় বিরিশিরি যাওয়ার। দুই দিনের ট্যুর প্ল্যানও তৈরি। কিন্তু একজন মাস্টার ফটোগ্রাফার না থাকলে কি চলে! পরিকল্পনার কথা শুনে রাজি আলোকচিত্রী মনিরুল আলম। আমাদের তখন পায় কে! এক বৃহস্পতিবার ভোরে সবাই জড়ো হই মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে। দিনের প্রথম বাসেই রওনা হই বিরিশিরির উদ্দেশে।
বাসের ভেতর টিভি। হাসির নাটক চলছে একের পর এক। ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে। ঠাঁই হলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমির রেস্ট হাউসের দুটি কামরায়।
রাস্তার পাশেই লাকি হোটেল। পেট বাবাজিও তখন অস্থির। দুপুরের খাবার সেরে নিলাম দেশি মুরগি আর বোয়াল মাছ সহযোগে। ভোজনরসিক নিটুর খাবার যেন শেষই হয় না। ওর ভুঁড়িভোজ নিয়ে চলে হাসি আর আড্ডা।
এই ফাঁকে মুঠোফোনে কথা হয় গোপালের সঙ্গে। এক বন্ধুর পরিচিত তিনি। বিরিশিরি ঘুরে বেড়াতে গোপালই আমাদের গাইড হন। সোমেশ্বরীতে ভেসে বেড়াব। পরিকল্পনার কথা শুনে তেরিবাজার ঘাটে চলে আসতে বললেন গোপাল। ক্যামেরাদিসহ ঝটপট রেডি হয়ে আমরা হাজির হই তেরিবাজার ঘাটে।
সময়টা শরতের। নীলের বুকে তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। ওপাশে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়। কোনো কোনোটি তো মেঘে ঢাকা। হঠাৎ দূর থেকেই একটি চরের দেখা মেলে। সোনালি বালিতে গড়া। ফিতার মতো ওটাকে যেন বেঁধে রেখেছে সোমেশ্বরীর জল। গোটা চরে কাশবন। একেবারে ধবধবে সাদা। সোনালির বুকে যেন সাদা রঙের আঁচড় কাটা। বাতাসের ঝাপটায় মাঝেমধ্যেই চরের বুকে সাদা ঢেউয়ের নাচন ওঠে। তা দেখে আনমনা হই। সবার হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা। এক-একটা লেন্স একেক দিকে তাক করা। থেমে থেমেই শোনা যেতে থাকে ক্লিক ক্লিক শব্দ।
সোমেশ্বরীতে সাদা মেঘগুলোর জলছবি। ওপাশে মেঘেঢাকা পাহাড়গুলোও উঁকি দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এক অন্য রকম পরিবেশ।
আমিরুল মাঝি নৌকা ভেড়ায় চরের বুকে। নেমেই কাশবনের দিকে আমরা দে ছুট। ব্যস্ত হয়ে পড়ি ছবি তোলায়। মোর্শেদ ব্যস্ত অন্য কাজে। কেন জানি মনটা খারাপ তার। দু-একটি কাশফুল ছিঁড়ে পাপড়িগুলো সে আনমনে উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশ পানে। হয়তো প্রিয়তমার কথা মনে পড়েছে! দৃশ্যের অন্তরাল থেকে নিটু তখন গান ধরে-‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’
বেসুরা গানের সুরে আহত মোর্শেদ তাড়া করে নিটুকে। দিপু তখন ব্যস্ত সে দৃশ্য ধারণে। বালির চরে বন্ধুত্বের মাখামাখিতে জমে ওঠে গল্প-আড্ডা। হঠাৎ মনিরের তাড়া। দ্রুত নৌকা ছাড়তে হবে। নইলে যে সূর্যাস্ত মিস হয়ে যাবে। ঝটপট নৌকায় চড়ে বসি। চরগুলো পেছনে ফেলে বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের জিরো পয়েন্টের দিকে মোড় নেয় আমাদের জলযান।
সূর্যটা তখন ডুবতে ব্যস্ত। আকাশে রঙের ছড়াছড়ি। লালের আধিপত্যই বেশি। নদী তখন একেবারে শান্ত। টলটলে জলে আকাশটাকে দেখা যায়। আলোর খেলা চলছিল পশ্চিম আকাশে। ক্ষণে ক্ষণে তার রং বদলায়। সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আশপাশের দৃশ্যগুলোও। নদীর এক জায়গায় বড় বড় বাঁশ গেড়ে দেওয়া। বাঁশগুলোর ছায়া পড়েছে নদীর জলে। লাল-নীলের খেলায় সে ছায়াগুলো হয়ে ওঠে আরো বর্ণিল, যেন পটে আঁকা কোনো ছবি। অন্য জায়গার জলে আরেক কাণ্ড। আকাশের নীল রঙের মাঝে আছড়ে পড়েছে হালকা লাল আলোকচ্ছটা। একই আকাশে অসংখ্য রং। সোমেশ্বরীর বুকে সে রং যেন আছড়ে পড়ছে ছবি হয়ে। নদীর জলে সে রূপ অপরূপ হয়ে ওঠে। যেন ঐশ্বরিক এক খেলা চলছে। আমরাও যেন হারিয়ে যাই স্বপ্নময় কোনো জগতে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, প্রকাশকাল : ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.