এটা ভিক্ষুকের হাত নয়, যোদ্ধার হাত
২৫ মার্চ, ১৯৭১। মধ্যরাত। ডা. মঈনুল এসে খবর দিল ঢাকায় আর্মি নামছে। যুদ্ধ শুরু। অস্ত্র লাগবে। বিএম কলেজে ইউওটিসির অস্ত্র ছিল। কয়েকটা ডামি আর ২৫ টি ডিপি রাইফেল। ইউওটিসির আমি ছিলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। ২৬ মার্চ ভোরবেলা। কলেজের ট্রাঙ্ক ভেঙে অস্ত্র নিয়ে আমরা চলে যাই ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার কাছে। তাঁকে ডাকতাম হিরু ভাই বলে। ওই রাতেই পুলিশ লাইন থেকে আনা হয় আরও ৭৫টি রাইফেল। মঞ্জু ভাইয়ের নেতৃত্বে পুলিশ লাইনের আর্মস ও অ্যামুনিশন নিয়ে সকালে আমরা ক্যাম্প করি গার্লস স্কুলে। অতঃপর আর্মসগুলো ডিসেন্ট্রালাইজ করা হয় লাকোটিয়া জমিদার বাড়ি ও কাশিপুর ব্যারিস্টার বাড়িতে।
‘‘বরিশাল এক মাস ছিল মুক্ত। ওই সময়টাতে বিএম স্কুল, নাজির বাড়ি, বেলস পার্ক (বঙ্গবন্ধু উদ্যান), লেডিস পার্কে স্থানীয় যুবকদের ট্রেনিং করানো হয়। আমি ছাড়াও ট্রেনার ছিলেন আবু মিয়া, আলেপ মিয়া ও আবদুল মন্নান।’’
‘‘কাশিপুর ইসাকাঠি গার্ডেনে একটা বাহিনী করার উদ্যোগ নেওয়া হল। ইউওসিটির কয়েকজন ক্যাডেটসহ বাহিনীর ৬৫ জনই ছিল ইয়াং। ওদেরও ট্রেনিং করানোর দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। জায়গাটির চতুর্পাশে ছিল সারি সারি নারকেল গাছ। মধ্যে পুকুর। পুকুরের চারপাশে আমরা ট্রেঞ্চ গাড়ি। মাঝে মধ্যেই হলুদ রঙের প্লেন উড়ে যেত মাথার উপর দিয়ে। আমরা তখন ট্রেঞ্চে গিয়ে পজিশন নিই। আকাশের দিকে রাইফেল তাক করে বসে থাকি।’’
‘‘১৮ এপ্রিল, ১৯৭১। সকাল ১০টার মতো। আমি আর হুদা ভাই লেডিস ক্লাবের ভেতরে। হঠাৎ বেলস পার্কে দুইখান ফাইটার চইলা আসে। প্রচণ্ড শব্দে ওরা গুলি চালাতে থাকে। বেলস পার্কের মাঠে ছুটে যাই। ট্রেনিং চলছিল তখন। প্রায় ৫শর মতো লোক। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। দেখলাম গুলিতে একজনের এক হাত উড়ে গেছে। আমি একটি রেইনট্রি গাছের পেছনে আত্মগোপন করি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। গুলির তোড়ে গাছটা দুইভাগ হয়ে যায়। আমি তখন প্রাণ বাঁচাই এক জজ সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে।’’
‘‘এ ঘটনার পরই চুড়ান্তভাবে ঘর ছাড়ি। আমাকে ঠেকাতে মা নানা কথা বুঝাতেন। মাকে বলেছিলাম, ‘চলার পথে বাধা দিয়ে পথ পিচ্ছিল কর না, মা। তোমার কোল থেকে টেনে নিয়ে যদি গুলি করে তাহলে কি তুমি ঠেকাতে পারবে?’ মা ছেলের অন্তরের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। হাতে স্টেনগানটা তুলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শুধু বললেন, ‘আল্লাহ, তুমি আমার বাবার পড়ানডা পাতার আড়ালে রাইখা দিও।’’’
একাত্তরে পাকিস্তান সেনাদের বরিশাল শহর দখলের ইতিহাসের কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবির বুলুর মুখে। ঢাকার নিকেতনে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এলে তাঁর সঙ্গে চলে আমাদের আলাপচারিতা।
বরিশাল শহরের পুরান পাড়ার আবুল কাশেম মুন্সি ও সালেহা খাতুনের তৃতীয় সন্তান বুলু। ভাইদের মধ্যে তিনিই বড়। বাবা ছিলেন একজন ডিড রাইটার। জমিজমা যা ছিল তা দিয়ে খুব ভালোভাবেই চলত সংসার। লেখাপড়ায় বুলুর হাতেখড়ি পুরান পাড়া প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন টাউন স্কুলে। অতঃপর এসএসসি পাশের পর বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ওই কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ডিগ্রি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
ছাত্রজীবনের কথা উঠতেই তিনি বলেন:
‘‘বাবা-মার আদর-যত্নে বড় হয়েছি। ফারুক, শেখ কুতুবুদ্দিন, নেসার উদ্দিন আহমেদ খোকা, গোলাম নবীসহ সবাই দলবেঁধে চলতাম। কেউ বিপদে পড়লে, কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে মারলে সাহায্যে এগিয়ে যেতাম। মনে একটা শপথ ছিল, সেরা হতে হবে। অন্যায় আর মিথ্যার মধ্যে যেতাম না। বাবা শিখিয়েছিলেন অন্যের গাছের ফল পড়ে থাকলেও ধরবে না। তাই করতাম। বিএম কলেজে থাকতে স্পোর্টসের সব ইভেন্টেই ফার্স্ট হতাম। লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট ছিলাম না। তবে পাশ করতাম।’’
ওই সময় বিএম কলেজসহ দেশের ১৯টি কলেজে ছিল ইউওটিসি (ইউনির্ভাসিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর)। ইউওটিসি থেকেই বুলুদের দেওয়া হয় ভারি অস্ত্র প্রশিক্ষণ। এই ট্রেনিংই পরে কাজে লেগে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধে।
[ভিডিওতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবির বুলুর ভাষ্য:
https://www.youtube.com/watch?v=mgbSvtZ9fok]
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গেলেন?
‘‘কাশিপুর ইসাকাঠি গার্ডেনে। মাহফুজ আলম বেগ তখন আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি আমাদের থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ শেখান। আমাদের দলের মূল কমান্ডে ছিলেন তিনি। আমি ও খোকা চৌধুরী সাপোর্টে।’’
২৫ এপ্রিল, ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা তালতলী ঝুনার খাল দিয়ে বরিশালে ঢুকে। স্টিমার দিয়ে ওখানটায় ব্যারিকেড দেওয়া ছিল। কিন্তু গুলি বর্ষণ করে পাকসেনারা জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়। ওদের ঠেকাতে টুকটাক গোলাগুলি হলেও তোপের মুখে কেউ টিকতে পারে না। পাকিস্তানি সেনারা গানবোর্ড ও হেলিকপ্টারে ভেতরে ঢুকে পড়ে। বুলুরা তখন কৃষি অফিসের একটি পিকআপ ভ্যানে প্রথমে মাধবপাশা জমিদার বাড়ি ও পরে আটঘর কুড়িআনা স্কুলে ঘাঁটি গাড়েন। সঙ্গে ছিলেন ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা।
কোথায় কোথায় অপারেশন করেন, এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বুলু কয়েকটি অপারেশনের কথা বলেন:
‘‘প্রতি রাতেই মুভ করতাম। বানারিপাড়ায় চারজন আর্মি আসলে থানায় তাদের ডাব খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয়। মানতে পারলাম না। ওই রাতেই বানারিপাড়া থানা অপারেশন করি। সবাই বাঙালি ছিল। থানা থেকে ১৯টির মতো রাইফেল ও অ্যানুমেশন আর গুলি নিয়ে আসি ওই দিন।’’
‘‘তখন জুন মাস। বাউকাঠিতে আর্মি ঢুকে এলাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে। নম সম্প্রদায়ের কিছু লোক খবর দেয় আমাদের। আমরা চারদিকে ঘেরাও করি। সঙ্গে দুই নারী যোদ্ধাও ছিল। বিথি ও শিশির কনা মণ্ডল। তারা বিএ পড়ত। ওদের হাতে থাকত ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড। প্রথম ফায়ার আমরা করি। সঙ্গে সঙ্গে ওদের কয়েকজন পড়ে যায়। পরে পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চে উঠেই এলএমজির ব্রাশ করে। আমরা আর মাথা তুলতে পারি না। এক দেড় ঘণ্টা গোলাগুলির পর ওরা লঞ্চে পালিয়ে যায়। আমরা তখন ফিরে আসি আটঘর কুড়ি আনায়।’’
জুন মাস তখনও শেষ হয়নি। আদি বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে বুলুু যখন আগৈলঝরায় পৌঁছান, তখন আবদুল হক সেরনিয়াবতের বাড়ি পাকিস্তানি সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাঁকে দেখে আত্মীয়-স্বজনরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি তখন কমিশনার চরে এক ভাইয়ের বাড়িতে ওঠেন। একটা গ্রুপ তৈরি করেন সেখানে। অস্ত্র হলে বরিশাল শহরের ভেতর ঢোকা যাবে। তাই নৌকা নিয়ে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র আনতে রওনা হন তৎকালীন গৌরনদীর রতনপুর ইউনিয়নের বারো হাজার গ্রামের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছিলেন মেহের মাঝি ও আনোয়ার নামে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সিপাই। অতঃপর কী ঘটেছিল, তা শুনি এই বীরের জবানিতে:
‘‘নৌকায় বাটাজোড় থেকে দেশের বাড়ি গেলাম। শেষ রাতে অস্ত্র তুলি। একটা ছেঁড়া কাঁথায় পেঁচিয়ে রাখি সেটা। আনোয়ারকে শুইয়ে দিলাম তার উপর। ‘তুই চলনদার, আমি মাঝির লগে, মাঝি বৈঠা ধরবে, আমি ধার টানমু।’ পরিকল্পনামতো সব হল। যখন ফিরছি তখন সব আমাদের বিপরীতে। বৃষ্টির সঙ্গে নদীতে প্রচণ্ড স্রোত।’’
‘‘দিনটি ছিল ১৬ জুলাই, ১৯৭১। বাটাজোড় বাজারের কাছে পৌঁছানোর কথা ভোর সাড়ে ৪টায়। কিন্তু বেজে গেল পৌনে আটটা। ফর্সা হয়ে গেছে। আমি দাঁড় টানছি। চিপা খাল। হঠাৎ একটা বন্দুক তাক হয়ে যায় আমার মাথা বরাবর। ‘নৌকা ভিড়াও, সার্চ করমু।’ আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মৃত্যু নির্ঘাত। নৌকার মধ্যে অস্ত্র। তখন তো ওরা নিরীহ মানুষই মাইরা ফালায়। প্রথমে মাঝি আর আনোয়াররে ওরা উঠায়া নেয়। আমি ভাবলাম গ্রেনেডটা নিতে পারলেই হয়। নৌকার তক্কা উঠাতেই ওরা ফায়ার করে। তখন বাঁচার আর কোনো পথ থাকে না।’’
পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অস্ত্রসহ ধরা পড়লে মুক্তিযোদ্ধা এ এমজি কবীর বুলুর ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। টর্চার সেলে তাঁকে থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। তাদের টর্চারে তাঁর বাম কান চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। দাঁত ভেঙে যায়। হাতে-পায়ে বেয়নেটের আঘাতের চিহৃ মনে করিয়ে দেয় সীমাহীন সেই যন্ত্রণার কথা। চুয়াল্লিশ বছর পর এখনও কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে যায় এই যোদ্ধার। টর্চারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবারই তিনি গুমরে কেঁদে উঠছিলেন। তাঁর সেই কান্না আমাদেরও আনমনা করে দেয়।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখে শুনি পাকিস্তানি সেনাদের টর্চারের ভয়াবহ সেই বর্ণনা:
‘‘থানায় নিয়ে প্রথম আমার হাত দুটি ওরা পেছন থেকে বেঁধে দিল। আমি চার কালিমা পড়ে নিই। অতঃপর কিছুক্ষণ পিটাল। গ্রেনেড ও স্টেনগান উদ্ধার হয়েছে, এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা তুলে নিয়ে যায় গৌরনদী কলেজে। নিচতলাতে জেরা চলে, ‘ঘাবড়াও মাত, তোমকো ছোড় দুঙ্গা, সব সাফ সাফ বাতাও।’ মনে মনে বললাম, ‘আল্লাহ, তুমি আমার জবান নিয়া যাও। জবান থেকে যেন কোনো কথা না বেরোয়।’ ’’
‘‘দোতলায় নিয়ে এক ক্যাপ্টেন মুখে ও পেটে ঘুষি দিতে থাকে। কলেজের পশ্চিম পাশের রুমে আমাদের পা দুটি বেঁধে পায়ের পাতায় পিটাল। পাতা ফুলে গেলে তাতে ওরা বেয়নেট দিয়ে কেঁচে দিল। পিনপিন করে পা দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। এরপর ৩০ জন মিলে ৩ জনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পিটাতে থাকে। অতঃপর আবার জেরা শুরু, ‘শালা বানচোদ, সাফ সাফ বাতাও। এ মেজর জলিল কাহা, মঞ্জু কাহা, মুক্তি কাহা, সাফ সাফ বাতাও।’ ’’
‘‘আমি বলি, ‘কুছ নেহি জানতা।’ এক দফা মারে। আবার জিগায়। বেয়নেট দিয়া হাতে পায়ে পোজ দেয় আর বলে, ‘বাতাও’। ওরা বাম কানে একটা বাড়ি দিতেই কানের পর্দা ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। সারা জীবনের জন্য বাম কান বন্ধ হয়ে যায়। আনোয়ারকে দেখে বলে, ‘তুম আর্মি হ্যায়, কমান্ডার হো।’ ওকে বাঁচাতে আমি চেঁচিয়ে বলি, ‘নেহি, ও আনসার হ্যায়। মাই কমান্ডার হ্যায়। ইয়ে স্টেন, ম্যাগাজিন, গ্রেনেড সব হামারা হ্যায়।’ ’’
‘‘ ‘তুম কমান্ডার?’ শুরু হয় আরও টর্চার। ঘাড়ে একটা বাড়ি দিতে চোখে কিছুই দেখি না। যন্ত্রণায় ছটফট করছি। চিৎকার করে কাঁদছি। ওই যন্ত্রণার কথা কীভাবে বুঝাব! ওদের বলি, আমাকে একটা গুলি দাও। দুপুরের দিকে আমার নিথর দেহ দেওয়ালে ঠেকিয়ে পিস্তল গলার কাছে ধরল এক মেজর। আমি তার চোখের দিকে চোখ রাখি। কিন্তু না, মারল না। বেয়নেট দিয়ে গলায় একটা পোজ দিল মাত্র। টর্চারের যন্ত্রণা সইতে পারতাম না। কিন্তু তবুও মুখ খুলিনি। কতবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছি। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তাও পারিনি।’’
‘‘তিন জনকে এক রশিতে বেঁধে ওরা আমাদের একটা আর্মি ভ্যানে তুলে নেয়। বডিতে তখন ছোপ ছোপ রক্ত। পিনপিনে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে পড়তেই জ্বালা করছিল। ওরা বলল, তোদের মেরে কুকুরকে খাওয়াব। আমাদের আনল বরিশাল ওয়াপদা ক্যান্টনমেন্টে। এক কর্নেল বলে, ‘ঠিক হায়, উস কো ভেজ দাও।’ ’’
‘‘১৫ জন আসামিকে ওরা একটা রুমে রাখল। তখনও কান দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। স্টেটমেন্ট নিতে এক মেজর আসে কাঁচা লাঠি হাতে। পেটাল ঘণ্টা খানিক। শরীর তখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ১৮ জুলাই ভোরে টর্চারে আনোয়ার মারা গেল। বুকের ভেতরটা তখন হু হু করে উঠে। আহা রে, ওর মুখটা কীভাবে ভুলব! ওরা তো মানুষ ছিল না। আনোয়ারের দুই হাত পা ধইরা ওরা ওয়াপদার খালে নিয়া ফালায়া দেয়। বরিশাল ক্যান্টনমেন্টে ১৯ দিন টর্চারের পর আমাকে প্রথম যশোর ক্যান্টনমেন্ট এবং পরে পাঠিয়ে দেয় সেন্ট্রাল জেলে।’’
‘‘জেলে কিছু সিপাহী খাওয়ার সময় বেত মারত আর বলত, ‘শালা, তোমকো খানা ইন্ডিয়া দিয়েগি।’ তখন চোখে দেখি না। কানে পুঁজ হয়ে গেছে। একেক রাতে তিন থেকে চারবার উঠিয়ে নিয়ে যেত। প্রতি বারই মনে হত আজই মেরে ফেলবে। ২১ অক্টোবর, ১৯৭১। পহেলা রমজান। কয়েদি এসে বলল, ‘রিলিজ’। বিশ্বাস হয়নি প্রথম। হয়তো মায়ের দোয়াই আল্লাহ শুনেছেন। দুঃসহ সেই স্মৃতিগুলো নিয়ে আজও বেঁচে আছি।’’
স্বাধীনতার পরের জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে এই যোদ্ধা বলেন:
‘‘স্বাধীনতার পর অনেস্টলি কামাই করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু ডিজঅনেস্ট হওয়া সম্ভব নয়। রেশন শপ করেছি। কিন্তু ব্ল্যাক করতে না পারায় টিকতে পারিনি। মানুষের কাছে হাত পাতা সম্ভব নয়। এটা ভিক্ষুকের হাত নয়, যোদ্ধার হাত। ৫ বছর চাকরি করেছি এনজিওতে। বর্তমানে সরকার আনসার ভিডিপি ব্যাংকের একজন ডিরেক্টর বানিয়ে সম্মানিত করেছে।’’
সরকারের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে এ এম জি কবির বুলু অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত:
‘‘৩৮ বছর বরিশাল জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ছিলাম। আমরা তো পাওয়ার জন্য কিছু করি নাই। এখন যুদ্ধাহত ভাতা ও রেশন পাই। দিন চলে যায়। শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যা করলেন তা ইতিহাস হয়ে থাকবে।’’
কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে?
‘‘‘সত্যিকারের কিছু ত্যাগী মানুষ আর ভালো উদ্যোগের দরকার। একবার শিয়ালদহ স্টেশনে হাঁটছি। একজন বলল, মন্ত্রী আসতাছে। পেছন ফিরে দেখি কোনো ব্যস্ততা নাই। মন্ত্রী কই? দেখলাম ৮-১০ লোক নিয়ে সাধারণভাবে মন্ত্রী হেঁটে চলে যাচ্ছেন। আর আমাদের দেশে মন্ত্রী হইলেই রাস্তাঘাট আটকাইয়া জনসাধারণকে কষ্ট দিয়া চলতে হয়। এটা মানার মতো নয়।’’
দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। জাতি হচ্ছে কলঙ্কমুক্ত। কিন্তু সাকা চৌধুরীর ফাঁসির সময় তার ছেলের প্রকাশ্য আস্ফালন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ব্যথিত করেছে এ এম জি কবির বুলুকে। তিনি শুধু বললেন, ‘‘এটা প্রমাণিত সাপের পেটে সাপই জন্মায়। আর মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয়ে যায়নি।’’
পরবর্তী প্রজন্ম এই দেশকে সত্যিকারের সোনার দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে এমনটাই বিশ্বাস এই সূর্য-সন্তানের। তাদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবির বুলু বলেন:
‘‘তোমরা দেশের ইতিহাস জেনে নিও। জেনে নিও দেশবিরোধীদের। মনে রেখ, ১৯৭১এ জিন্দাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, ‘জয় বাংলা’।’’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫
© 2016 – 2018, https:.