ফুল মনি টুডুর বিয়েতে
দিনকয়েক ধরে প্রচণ্ড শীত। ঘন কুয়াশা ঢেকে রেখেছে দিনাজপুর শহরের চারপাশ। আমাদের গন্তব্য একবারপুর। হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের রাস্তাটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে ওইদিকটায়। প্রত্যন্ত এই গ্রামেই পাড়া করে বসবাস করছে সাতটি সাঁওতাল পরিবার। আশপাশের গ্রামের আদিবাসীরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও এরা এখনো আগলে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের সনাতন ধর্ম বিশ্বাসকে। এই সাঁওতাল পাড়ায় ফিলিপ টুডু ও রান্দন হাজদার মেয়ের বিয়ে আজ। খবরটি দেন আরেক সাঁওতাল যুবক রুবেল টুডু। সাঁওতালদের সনাতন বিয়ের খবর পেয়ে আমরাও পা রাখি ফিলিপ টুডুর বাড়িতে।
সাঁওতাল সমাজে সংসারধর্ম পালনে অপরাগ হলে কিংবা ব্যক্তিগত কারণে যদি স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় স্বামী, তবে তাকে কুড়ি টাকা জরিমানা দিতে হয়। পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে তালাক ঘোষণা করে সাঁওতালরা শালপাতা টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে একটি পানিভর্তি কলসি উপুড় করে ফেলে দেয়
কনের নাম ফুল মনি টুডু। বিয়ে হবে বীরগঞ্জ দক্ষিণ সুজালপুর গ্রামের সকাল সরেনের সঙ্গে। সাঁওতালরা তাদের বিয়ে বাড়ি দূর থেকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে বাড়ির ভেতর উঁচু বাঁশ গেড়ে বাঁশের মাথায় খেড়দিয়ে তৈরি বানরাকৃতি ঝুলিয়ে রাখে। বাড়ির সীমানার শুরুতেও বেঁধে দেওয়া হয় বিশেষ গাছের লতা। সবার মতো আমরাও তা দেখে খুঁজে নিই বিয়ে বাড়িটি। তবে সাঁওতালরা এটিকে—সৃষ্টিকর্তাকে বিয়ের খবর জানান দেওয়ার রীতি মনে করে।
ফুল মনি টুডুর বিয়ের নানা আচার চলে সকাল থেকে রাত অবধি। খুব কাছ থেকে দেখি সাঁওতাল বিয়ের আদি রেওয়াজগুলো। একইসঙ্গে বয়োঃবৃদ্ধ সাঁওতালদের মুখে শুনি বিয়ে নিয়ে নানা বিশ্বাসের মিথগুলো।
সাঁওতালরা বিয়েকে বলে ‘বাপলা’। এই আদিবাসী সমাজে মোট ১২টি গোত্র রয়েছে—হাঁসদা, মুরমু, সরেন, হেমব্রম, টুডু, বাস্কে, কিস্কু, বেদেয়া, মাণ্ডি, বেসড়া, চঁড়ে, পাঁউরিয়া। সাঁওতাল সমাজে একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। এছাড়া বেসড়ার সঙ্গে টুডু এবং মাণ্ডিদের সঙ্গে কিস্কুদের বিয়ে হয় না।
সাঁওতাল সমাজে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয় মেয়ের বাড়িতে। এই সময় শালপাতার বাটি ব্যবহার করা হয়। বাটিতে কয়েকটি ধাতব মুদ্রা ফেলে রাখা হয়। আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাটিটি জগমাঝির কাছেই থাকে। সাঁওতাল সমাজে কনে পণ দেওয়ার রীতি চালু আছে। তবে সেটি খুবই সামান্য। এছাড়াও বিয়েতে কনের মা, মাসী ও পিসিদের জন্য পাঁচ থেকে সাতটি শাড়ি প্রদান করতে হয়।
সাঁওতাল বিয়ে সাধারণত তিন প্রকারের—‘আসলি’ অথবা ‘দুয়ার ইতুত’, ‘সিদুঁর বাপলা’, ‘রাজাবাজি’ এবং ‘হুরকাটারা’ বা ‘ইতুত’। এসব ছাড়াও ‘নিরবোলক’, ‘টুংকি’, ‘দিলিপ’ এবং ‘সেতা বাপলা’ ইত্যাদি ধরনের বিয়ের প্রচলন দেখা যায়। তবে বর্তমানে তা খুব কমই দেখা যায়। ‘আসলি’ বিয়ে সাধারণত সম্ভ্রান্ত পরিবার ও শিক্ষিতসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ‘রাজারাজি’ বিয়েই সাধারণত সাঁওতাল সমাজে বেশি দেখা যায়। ‘রাক্ষস’ বিয়ে একেবারেই কম। সাঁওতাল সমাজে বাল্যবিয়ে নেই বললেই চলে।
বিয়ের তিনদিন আগে বর বা কনের বাড়ির উঠানের চারপাশে চারটি খুঁটি পুঁতে তার উপর শাল বা আম বা নিম ডাল দিয়ে তৈরি করা হয় ছামডা বা মাড়োয়া। এছাড়া বিয়ের তিনদিন বা পাঁচদিন আগে কোনো কোনো জায়গায় আগের দিন বা বিয়ের দিন জগমাঝির মাধ্যমে মারোয়া সাজানো হয় বিশেষ পূজার মাধ্যমে। এই পূজায় তিনটি মুরগি লাগে। মুরগিগুলো বলি দেওয়া হয় জাহের এরার থান ও অন্য ঠাকুরের থানে যথাক্রমে জাহের এরা ও মড়েকো তুরুইকোদ এবং মারাঙবুরুর নামে।জগমাঝি মারোয়ার মধ্যে একটি মহুয়া গাছের ডাল পোঁতার নির্দেশ দেন গ্রামের যুবকদের। যেখানে ডাল পোঁতা হয় তার ভেতরেই তিনটি কাঁচা হলুদ, পাঁচটি ফুটো কড়ি ও তিনটি দুর্বাঘাসের ডগ এবং বাটা হলুদের সঙ্গে তিনটি আতপ চাল মিশিয়ে এক জায়গায় বেঁধে দেওয়া হয়। মহুয়া ডাল পোঁতার পর সেই জায়গায়টি মাটি দিয়ে ভরাট করে গোবর দিয়ে নিকিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর সেখানে রঙবেরঙের আলপনা আঁকা হয়। মারোয়ার দুপাশে থাকে দুটো জলে ভরা কলসি। এই কলসি মঙ্গল বা কল্যাণকর। বিয়ের যেকোন অনুষ্ঠানই মারোয়ার সামনে অনুষ্ঠিত হয়। তাই অঞ্চলভেদে মারোয়া তৈরির ভিন্নতা থাকলেও এটি তৈরি করা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
সাঁওতালদের বিয়ের আগের দিন বর ও কনে উভয়ের বাড়িতে ‘তেলাইদান’ নামক একটি অনুষ্ঠান পালিত হয়। ‘তেলাইদানের’ আগে কমপক্ষে তিনজন সধবা মেয়ে পুকুর থেকে কলসভর্তি জল এনে বরকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়। বিয়ের দিনও একই নিয়মে বর ও কনেকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করানো হয়। স্নানের পর বর-কনের হাতে আম পাতায় বাঁধা একটি পোটলা বেঁধে দেওয়া হয়। পোটলায় থাকে কমপক্ষে তিনটি দূর্বাঘাস, নখ খুঁটে সাতটি আতপ চাউল এবং তিন টুকরো কাঁচা হলুদ। তারপর বরপক্ষ কনের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে। যেদিক দিয়ে তারা কনের গ্রামে প্রবেশ করবে সেই দিকে কনেবাড়ির একজন মুরুব্বি আগে থেকেই জলভর্তি একটি কলস নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। বরপক্ষ নিয়ম মেনে ওই কলসে একটি ছোট্ট লাঠি দিয়ে আঘাত করে গ্রামে প্রবেশের ইঙ্গিত দেয়। ইঙ্গিত পেয়ে তাদের কনের বাড়ি থেকে একটু দূরে কোনো গাছের নিচে বসানো হয়। এই সময় কনের বাড়িতে প্রবেশ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। গাছের নিচে বরপক্ষকে কোনো কোনো সময় একদিনের বেশি সময়ও থাকতে হয়। গাছের নিচে থাকাকালীন তাদের খাওয়া খরচও নিজেদেরই বহন করতে হয়।
গ্রামে বর পৌঁছানোর খবর পেয়েই কনের বাড়িতে প্রথমেই কনেকে স্নান করানোর ধুম পড়ে যায়। এই সময় একদল কুমারী মেয়ে আঁচলে মুড়ি বেঁধে বাজনা ও নৃত্যের তালে তালে পুকুর ঘাটে যায় এবং কলসভর্তি জল এনে কনেকে মই পেতে গোয়াল ঘরে বসিয়ে স্নান করায়। কোনো কোনো অঞ্চলে কেবল মইয়ের ওপর বসিয়েই স্নান করানো হয়ে থাকে।
সন্ধ্যার দিকে বাড়ির সেই মুরুব্বি একঘটি জল নিয়ে বর ও বরপক্ষকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানাতে রওনা হয়। এ সময় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি দল বাজনা নিয়ে বরকে বরণের অপেক্ষায় থাকে বাড়ির বাইরে। এই দলে দুটি কলসভর্তি পানি নিয়ে দু’জন মহিলা এবং কনের মার হাতে থাকে গুড় ও মিষ্টির একটি থালা। বর এসে প্রথম কনের মা, বাবা ও মুরুব্বিদের প্রণাম করে। কনের মা তখন জল নিয়ে নতুন জামাতার পা ধুইয়ে দেয় এবং কোলে বসিয়ে মুখে গুড় তুলে খাওয়ায়।
বরপক্ষ বাড়ির ভেতর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বরের বাবা কিছু চাল, মুড়ি ও পয়সা প্রদান করে। এরপর কনের বড়বোন বরকে নতুন কাপড় পরাবার জন্য এগিয়ে আসে। এসময় বরকে স্নান করানো এবং নতুন কাপড় পরানো হয়। একইভাবে কনের ভাই অপেক্ষায় থাকে বরপক্ষের কাছ থেকে কনের নতুন কাপড় নিতে। অনেক সময় বর নিজ হাতেই এই কাপড় প্রদান করে। বর নতুন কাপড় কনের ভাইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সময় উভয়ে কিছু আতপ চাউল বদল করে পরস্পরের মুখে তুলে দেয়। কনের নতুন কাপড়ের সঙ্গে কনের মায়ের জন্য একজোড়া শাড়িও থাকে। সাঁওতালরা একে ‘মারাংবুড়ো’ শাড়ি বলে থাকে।বিয়ের কাপড় চূড়ান্ত হলে মেয়ের মা নতুন কাপড় নিজে পরে এবং মেয়েকে পরিয়ে দেয়। এরপর মা পা ধুইয়ে দেয় মেয়ের। পা ধুইয়ে দিলেই আগে থেকে রাখা বাঁশের ঝুড়িটিকে মেয়ে এসে ভক্তি জানায়। এবং ভক্তি জানানোর পরপর ওই ঝুড়িতেই মেয়েকে বসিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে বরের সঙ্গে আসা পাঁচ বড় ভাই ঝুড়ি সমেত মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কনে পক্ষ সহজেই নিতে দেয় না। শুরু হয় ধাঁধার বাধা। এই বাধার সময় ঝুড়ি মাটিতেও পড়তে পারবে না আবার দরজার সঙ্গে স্পর্শও করানো যাবে না।
পাঁচজন বড় ভাই অথবা কনের ভাসুর যখন ঝুড়ি উঁচু করে মারোয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন বরের ভগ্নিপতিরা বরকে কাঁধে নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠাঙ্গুলি একত্র করে কৌটা থেকে তিনবার সিঁদুর তুলে মাটিতে ফেলে দেয় এবং কনের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সিঁদুর-দানের এই অনুষ্ঠান হয়ে গেলেই ধরে নিতে হয় তারা স্বামী-স্ত্রী। উপস্থিত সকলেই তখন উলুধ্বনি দিয়ে তাদের আশীর্বাদ জানায়।
কনে নিয়ে বর গ্রামে এলে প্রতিটি বাড়িতে চলে বর ও বধূকে মিষ্টি খাওয়ানোর পালা। এসময় ধান, দূর্বা, চাউল, সিঁদুর দিয়ে নব-দম্পতিকে বরণ করা হয়। দু’জনকে একত্রে বসিয়ে—যে ঝুড়িতে কনেকে আনা হয়েছে—সেই ঝুড়ি দু’জনের ওপরে সাতবার ঘোরানো হয় এবং আগুনের তাপ দিয়ে সেঁকে দেওয়া হয় দু’জনের গাল ও মুখ।
সাঁওতাল সমাজে সংসারধর্ম পালনে অপরাগ হলে কিংবা ব্যক্তিগত কারণে যদি স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় স্বামী, তবে তাকে কুড়ি টাকা জরিমানা দিতে হয়। পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে তালাক ঘোষণা করে সাঁওতালরা শালপাতা টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে একটি পানিভর্তি কলসি উপুড় করে ফেলে দেয়। এভাবে বোঝানো হয় তাদের সম্পর্কচ্যুতি ঘটেছে। যদি স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতে চায় তবে গোত্রপ্রধান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে তাকে পণের সমস্ত টাকা পরিশোধ করে দিতে হয়। স্বামী যদি জরিমানার টাকা কিংবা স্ত্রী পণের টাকা—পরিশোধ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে কারোই তালাক সম্পন্ন হয় না।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : ২ মার্চ ২০১৬ ১৮:৫৭:০০ পিএম বুধবার
© 2016 – 2018, https:.