ভালো লেখার ভালো বই থাকুক বইমেলায়
বইমেলা এবার জমবে না, প্রায় সকলেরই ছিল এমন ধারণা। কারণ, গত বছর বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথেই প্রকাশ্যে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতন্ক বিরাজ করছে।তাই অনেক পাঠক হয়তো মেলায় আসবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক কারণ তো রয়েছেই। প্রতিবছর বইমেলার সময়টাতেই চলে হরতাল আর অবরোধের মতো ঘটনা।সবমিলিয়ে এবার বইমেলা বেশ পানসে হবে।পরিচিত কয়েকজন প্রকাশক ও লেখক বন্ধুর এমন ধারণা, কিন্তু মেলার শেষান্তে এসে কী দাঁড়াল, ধারণা মনে হয়, সঠিক না।
মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ লেখক অভিজিৎ এবং প্রকাশক দীপনের বিষয়ে টু শব্দটি না করলেও সবকিছুকে পায়ে ঠেলে বইমেলায় এসেছে লাখো মানুষ। শিল্প-সংস্কৃতি আর মুক্তচিন্তার উপর আঘাতের বিরুদ্ধে এটিও এক ধরণের নিরব প্রতিবাদ বললেও, ভুল হবে না। কেননা মৌলবাদী আর জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী কখনও চাইবে না বইমেলার মতো আয়োজন টিকে থাকুক।
এবার বইমেলার সময়টাতে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। মেলার আয়োজন, স্টল বিন্যাস আর পরিবেশও ছিল বেশ অন্যরকম। ফলে, লোকসমাগম ছিল অনেক। কিন্তু মেলায় যে শিশু, নারী, পুরুষ আসে তাদের জন্য যে পানির ব্যবস্থা, চা-কফির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সেটিও যে মেলায় আগতদের জন্য সহায়ক, কর্তৃপক্ষকে সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, স্টলে ঘুরতে ঘুরতে অনেকেই ক্লান্ত এবং ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে ওঠেন। বাংলা একাডেমি এবারও একটি প্রকাশনী সংস্থা বন্ধ করে দিয়েছে উগ্রবাদী বই প্রকাশের অভিযোগে।কিন্তু ওই শুধু বইটিই কি বাতিল করা যথেষ্ট ছিল না! প্রকাশনা সংস্থাটির স্টল কেন বন্ধ করা হলো? ওই প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত অন্য বইগুলোর তাহলে কি হবে।এটি কি ভেবে দেখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের ছিল না?বইমেলায় বেচাকেনা কেমন? ভেতরের দিককার প্রকাশকদের উত্তর- খুব খারাপ। সামনের কিংবা নামীদামী প্রকাশকরা বিক্রির কথায় কিঞ্চিত মুচকি হাসেন।কোনো কোনো প্রকাশক স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বরাবরের মতোই বলেন- ‘ভাই মেলায় বিক্রি নাই।আগের চেয়ে খারাপ।প্রকাশনা শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।’ কিন্তু আসলেই কি তাই! আমরা তো এখনও এমন খবর পাইনি যে, শুরু হওয়া কোন প্রকাশনা সংস্থা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এবারের বইমেলায়ও প্রকাশনী সংস্থার সংখ্যা বেড়েছে। সরকার বিবিধ প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার বই কিনছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক তৈরির কর্মসূচি বেড়েছে। একইভাবে বেড়েছে বই কেনার সংখ্যাও।
রকমারি ডটকম প্রতিবছর শুধুমাত্র অনলাইনেই বিক্রি করছে কয়েক কোটি টাকার বই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও পাবলিক লাইব্রেরী বই কেনে প্রতিবছরই। বড় বড় এনজিও ও বেসরকারি সংস্থাও প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি টাকার বই কিনছে।সরকারিভাবে প্রতি জেলায় এবং অনেক উপজেলাতেও বইমেলা হচ্ছে এবং সেগুলোতে অংশ নিচ্ছেন নামদামী প্রকাশকরা। তবে কেন এমন হতাশা!
এখনও আমরা দেখি অধিকাংশ প্রকাশকই বই করছেন মেলাকে ঘিরে। এই দায় লেখকেরও। মেলা ছাড়া বাকী সময়টাতে অধিকাংশ প্রকাশকই খুব কম বই প্রকাশ করেন। ফলে মেলাকে ঘিরে নতুন বই প্রকাশের তোড়জোড়ে সম্পাদনার কাজটি একেবারেই হয় না। ফলে রঙচোঙা প্রচ্ছদ নিয়ে যে বইটি মেলায় প্রকাশিত হয় সেটি পাঠককে তেমন আন্দোলিত করে না। ফলে, বই কিনে পাঠক প্রায় ঠকে যায়। এভাবে পাঠক মানসম্মত বই কেনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।যে কোনো লেখক তার পাণ্ডুলিপিকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। ওই পাণ্ডুলিপির বিষয় বিবেচনা ও সম্পাদনা করে সেটিকে পাঠ উপযোগি করে উপস্থাপনের দায়িত্বটি প্রকাশককেই নিতে হবে। এটি না হলে পাঠক প্রতারিত হবেন এবং এক সময় বইমেলা তার লক্ষ্ থেকে বিচ্যুত হবে।
দেশে সত্যিকারভাবে কি পাঠ বেড়েছে। কিংবা আমরা কি পারছি পাঠক তৈরি করতে। এই দায় যেমন রাষ্ট্রের তেমনি প্রকাশকের এবং লেখকেরও। বইমেলায় বই বেরিয়েছে এমন নব্বই ভাগ লেখকই নিয়মিত লিখেন না। ফলে তারা তাদের লেখার মাধ্যমে পাঠক তৈরির যেই চেষ্টা তা থেকে পিছিয়ে আছেন। এমন লেখকের বই শুধুমাত্র তার পরিচিতজনদের হাতেই সেলফি তোলার প্রয়োজনে শোভা পায়।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বইমেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যে কতটি বই মানসম্পন্ন- এটিও বের করে প্রকাশ করাও উচিত বলে মনে করি। একইভাবে বইয়ের বিষয় নির্বাচন ও সম্পাদনা না করা হলে যত বড় বইমেলার আয়োজন করাই হোক না কেন শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোনো উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। বরং পাঠক ঠকার ভয়ে বইমেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর এর দায় বহন করতে হবে লেখক, প্রকাশক ও রাষ্ট্রকেই। ভালো লেখার ভালো বই থাকুক বইমেলায়-এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ছবি: ডেইলি স্টার
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, প্রকাশকাল : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
এই সাইডে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।© 2016 – 2018, https:.