মুক্তিযুদ্ধ

বিস্মৃত আরেক যুদ্ধের গল্প

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। নিরীহ নিরাপরাধ বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করছে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের ভয়ে জীবন নিয়ে দলে দলে মানুষ আশ্রয় নেয় সীমান্তের ওপারে, ভারতে। খোলা হয় শরণার্থী শিবির। প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্ধিরা গান্ধী সরকারের ওপর। ভারতের কিছু রাজ্যের মানুষ এতে নাখোশ হয়। শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করতে নানাভাবে তারা সরকারকে চাপ দিতে থাকে।

ঠিক ওই সময়েই পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’আয়োজনের। এতে অংশ নেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বাংলাদেশের ৩৮ জন শিক্ষিত যুবক। ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, মুজিবের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।

পদযাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে জনসভা করতেন। গণহত্যা সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আহ্বান জানাতেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর। তাদের সকলের হাতে হাতে শোভা পেত- ‘আমাদের এক কথা-বাংলাদেশের স্বাধীনতা’, ‘মুজিবের মুক্তি চাই’সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ও জাতীয় পতাকা। ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি চলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত । দেশি- বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে পদযাত্রার খবর। সে খবর ব্যাপক আলোড়নও তোলে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

একাত্তরের ইতিহাসের ওই বীরেরা আজ প্রায় বিস্মৃত। স্বাধীনতার জন্য ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’য় অংশ নেয়া যুবকদের দলটির লিডার ছিলেন একজন। দুইজন ডেপুটি লিডার। মূলত বক্তব্য দিতেন এই তিনজনই।

তাদের মধ্যে একজন ডেপুটি লিডারের জীবন কাটছে নিভৃতে। এমন খবরটি পাই এক বন্ধুর কাছ থেকে। মোবাইল ফোনের নম্বরটি জোগাড় হতেই তার সঙ্গে দিন কয়েক চলে আলাপচারিতা। অতঃপর এক বিকেলে আমরা পা রাখি কালের সাক্ষী কামরুল আমানের পল্লবীর বাড়িতে।

কামরুল আমানের বাবা চাকুরি করতেন ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। সে সুবাদে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন তোলারাম কলেজের ছাত্র। রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত না থাকলেও ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন। মাও সে তুংয়ের লাল বই তাকে উদ্দীপ্ত করত। বইয়ের পড়াকে বাস্তবে প্রয়োগের চেষ্টায় গরীব কৃষকের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে মিশতেন। তাদের কষ্টগুলোকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। এ সব দেখে অন্যরা হাসতো। বলত-‘পাগল ছেলে’।

বঙ্গবন্ধু আর ভাসানীর বক্তৃতা তাঁকে প্রবলভাবে টানত। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন আর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেখেছেন কামরুল। নিজ আগ্রহেই যুক্ত ছিলেন ওই সময়কার আন্দোলন সংগ্রামগুলোতে। পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা আর বর্বরতা কামরুল আমান দেখেছেন খুব কাছ থেকে। আলাপচারিতার শুরুটা তাই গণহত্যা দিয়েই।

কালের সাক্ষী কামরুল আমান এখন
কালের সাক্ষী কামরুল আমান এখন

তাঁর ভাষায়: ‘‘২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতের মধ্যেই ঢাকার গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কারফিউ চলছিল। তা শিথিল হতেই কাউকে কিছু না জানিয়েই রওনা হলাম ঢাকার দিকে। ডেমরার ডিএনডি মাটির বাঁধ। ওই পথেই শত শত লোক পালিয়ে আসছে ঢাকা থেকে। সবার মুখে লোক মরার খবর। মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে ৭-৮ জনের গলাকাটা লাশ। তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানে না। দেহ তখনও কই মাছের মতো নড়ছিল। এ যেন জিন্দা লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কব্জি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে। কার লাশ এটা? কেউ জানে না। খবর পেয়ে ছুটে যাই শাঁখারি পট্টিতে। আহারে! কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পোড়াইছে। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারি পট্টির প্রবশেমুখ। সেটি বন্ধ করে আগুন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছিল। একটি বাড়িতে পা রাখতেই গা শিউরে ওঠে। মানুষ পুড়ে তার চর্বি গলে মেঝেতে পড়ে আছে। তাতে পড়েছে আমার পা। এর চেয়ে ভয়াবহ আর মর্মান্তিক দৃশ্য আর কী হতে পারে!’

এরপর কী করলেন?

বাড়ি ফিরে যোগাযাগ হয় তাহের আর মোস্তফার সঙ্গে। তোলারাম কলেজের নাইট শিফটের ছাত্র ছিল ওরা। আর্মিরা নারায়ণগঞ্জ দখলে নিলে আমরা ট্রেনিংয়ের পরিকল্পনা করি। নদীর ওপারে রেললাইনের ঢালে আমাদের গ্রেনেড ট্রেনিং দেয় ইসমাইল। ও ছাত্রলীগ করতো। পরে আমাদের সঙ্গে মেহেরও যোগ দেয়। আমরা ৫জনই কুমিল্লার রামকৃষ্ণপুর হয়ে চলে আসি আগরতলার গোকুননগর রিক্রুটিং ক্যাম্পে। ওখানে তখন মাত্র ট্রেনিংয়ের প্রস্তুতি চলছিল। ট্রেনিং শুরুতে দেরি দেখে আমি চলে যাই কলকাতায়।

মনের ভেতর দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করার প্রবল ইচ্ছে কামরুলের। কলকাতায় সিপিএম অফিসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় দেবেন সিকদারের। তাঁর পরামর্শেই তিনি চলে যান যশোরের বেনাপোলে। কাজ করেন ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরে। সীমান্ত এলাকার শরণার্থীদের সেবা ও সাহায্য করাই ছিল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজ। তাদের মাধ্যমেই তিনি রিক্রুট হন ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলটিতে।

বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার দলটি যখন বিশ্ব ভারতী মিলনায়তনে
বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার দলটি যখন বিশ্ব ভারতী মিলনায়তনে

বাকি ইতিহাস শুনি কামরুল আমানের মুখে।

‘‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে পদযাত্রাটি এগিয়ে নেওয়ার সার্বিক পরিকল্পনায় যুক্ত হয় ‘অখিল ভারত শান্তি সেনা মন্ডল’নামের একটি সংগঠন। এটি গঠিত হয় মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ৮টি সংগঠনের সম্মিলনে। এদের সহযোগিতা করে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন। পদযাত্রার মূল উদ্যোক্তা ভারতের অহিংস সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ন এবং আহবায়ক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দীনেশ চন্দ্র মুখার্জী।’’

পদযাত্রী বাছাই করা হয় কোথায়?

প্রাথমিকভাবে আমাদের ৩৪ জন বাছাইয়ে কাজ করেন যশোরের শাহ্ হাদিউজ্জামান, মরহুম এম রওশন আলী, বিমল রায় চৌধুরী ও শেখ মোখলেসুর রহমান খোকন। বনগ্রাম থেকে ১৪ অক্টোবর, ১৯৭১ আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে পৌঁছি। সেখানে ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরের মাটি ছুঁয়ে আমরা স্বাধীনতার শপথ নিই। বাকি ৪ জন পরে এসে যোগ দেন মুর্শিদাবাদে।’’

মুক্তিযুদ্ধের চুয়াল্লিশ বছর পরেও পদযাত্রার স্মৃতিগুলো আজও জীবন্ত হয়ে আছে কামরুল আমানের মনের অতলে। পদযাত্রীদের নাম জানতে চাইলে তিনি হরহর করে বলতে থাকেন নামগুলো।
তাঁর ভাষায়:

‘‘লিডার ছিলেন আবদুল খালেক। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের ছাত্র। ডেপুটি লিডার-১ খুলনার একরামুল ইসলাম। আমি ছিলাম ডেপুটি লিডার-২। বাকিরা হলেন: রফিকুল ইসলাম, খলিলুর রহমান, মুরারী মোহন সরকার, বিনয় কুমার বিশ্বাস, আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ আবু বকর, পরিতোষ কুমার মণ্ডল, আব্দুল লতিফ (১), আব্দুল লতিফ (২), সৈয়দ রবিউল হক, দুলাল দত্ত মণ্ডল, ওহিদুজ্জামান চাকলাদার, তুষার কান্তি সুর, শেখ আনোয়ার কামাল, সুভাষ চন্দ্র বসু, অমিত দেব, ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, আনন্দ মোহন রায়, প্রদীপ কুমার শীল, আব্দুস সামাদ, আনোয়ারুল কাদির, পরিতোষ কান্তি কবিরাজ, দেলোয়ার হোসেন, অনিল কুমার বিশ্বাস, মইন উদ্দিন, সহিদুল ইসলাম, বিশ্বনাথ সাহা, সমীর কুমার বসু, ওমেদ আলী, আবু বকর সিদ্দিকী, শামসুল হক, মতিলাল দাস, অহিভূষণ চক্রবর্তী, সনৎ কুমার বিশ্বাস, আশরাফ হোসেন, দীলিপ কুমার নাগ।

পদযাত্রাটি শুরুর আনুষ্ঠানিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

‘‘পদযাত্রা শুরুর আগের দিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর, ১৯৭১ মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে র্যা লিসহ একটি জনসভায় প্রথমে আমাদের অভিনন্দন জানানো হয়। রাজ্যের প্রাক্তণ মূখ্য মন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্রের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গান্ধীপন্থী লেখক মৌলভি রেজাইল। তিনি বলেন-‘বাংলাদেশের ঘৃণ্যতম গণহত্যাকে উপেক্ষা করে আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েছে।’ অতঃপর আমরা ইয়াহিয়া খানের বর্বর আক্রমণের বর্ণনা তুলে ধরি। বক্তব্য দেন, মোহাম্মদ একরামুল, শ্রী দেশাই, আবদুল খালেক প্রমুখ। পরদিনই বাংলাদেশের পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ আমরা বহরামপুর হতে গোকরনার দিকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি।’’

‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র আগাম কর্মসূচি ইংরেজি ও হিন্দিতে গণমাধ্যমগুলোতে জানিয়ে দিতেন উদ্যোক্তারা। প্রায় দেড় মাস দলটিকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হত। বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হত জনসভার। উঠোন বৈঠকও হয় অগণিত। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে চলে মতবিনিময়। ওই সময় গাইড ও দোভাষী হিসেবে অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডলের একজন প্রতিনিধি সার্বক্ষণিক থাকত পদযাত্রার দলটির সঙ্গে। এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তি নিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রাণিগঞ্জ, আসানশোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, চিত্তরঞ্জন ও বিহার, পাটনা, লাখনৌ, আগ্রাসহ প্রভৃতি জায়গায় পদযাত্রা করে। ৩০ জানুয়ারি ছিল গান্ধী প্রয়াণ দিবস। ওই দিন দিল্লির রাজঘাট গান্ধী সমাধিতে পদযাত্রাটি শেষ হবে-এমনটিই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু তার আগেই স্বাধীনতা লাভ করায় ১৭ ডিসেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশে এসে পদযাত্রাটি শেষ হয়।

পদযাত্রা নিয়ে ওই সময় ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানালেন কামরুল আমান।

‘‘পদযাত্রায় স্থানীয় জনগনই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করত। পাটনাতে যখন গেলাম ওখানকার চিফ আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পল্টনের মতো বিশাল একটি মাঠে মিটিং হয়। বক্তৃতায় বললাম নিজের অভিজ্ঞতার কথা, গলা কাটা লাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশের মাটিচাপা, পুরনো ঢাকার মানুষ পোড়ানো, মানুষের চর্বি গলানো মেঝেতে নিজের পায়ের ছাপ। এগুলো তো গল্প ছিল না। লিডার খালেক শুধু কাঁদতেন। তিনি বললেন, রাজশাহীতে গণহত্যার বর্বরতার কথা। আমাদের বর্ণনাগুলো যখন হিন্দিতে ট্রানস্লেট করে বলা হচ্ছিল তখনই দেখলাম ওখানকার মানুষ হু হু করে কাঁদছে। লাখনৌ ইউনির্ভাসিটিতে আমাদের বক্তব্য শুনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কণ্ঠ মিলায় ছাত্রছাত্রীরা। মুজিবের মুক্তিতে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে তারা। সেইদিনই বুঝেছিলাম আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদটা আসলে মানুষের মনের ভেতরই গাঁথা থাকে। কে কোন দেশের, সেটা বড় কথা নয়। মানুষের মুক্তির, মানুষের স্বাধীনতার জন্য মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়।’’

ভিন্ন অভিজ্ঞতাও ছিল কামরুলদের। তিনি বলেন:

‘‘মুর্শিদাবাদে এক উঠোন বৈঠকে ভারতীয় একদল মুসলমান আমাদের ওপর বেশ রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান ছিল একটা মুসলমানের জায়গা। তোমরা সেটা ভেঙে দিতেছ। এক কোটি লোক আইসা আমগো উপর খাইতাছ। আমগো ভারতও ধ্বংস করবা তোমরা। যুদ্ধ তোমাদের। কিন্তু সৈন্য মরে আমগো। এই যুদ্ধ আমাদের দরকার নাই। বিদায় হও তোমরা।’ আমরা ধৈর্য হারাই না। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। মুসলমান ব্যাপার না, আসল বিষয় শোষণ আর নির্যাতনের। শুধু কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই ছাড়া ভারতের মুসলমান গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওই সময় বেশ কনফিউজড ছিল। ফলে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলটি একটি বড় অ্যাম্বাসেডরের কাজ করেছিল।’’

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দেশ তখন স্বাধীন। ১৮ ডিসেম্বর লাখনৌতে বিশাল আয়োজনে উদযাপিত হয় বিজয় দিবস। ভারতীয় বিমান, সেনা ও নৌবাহিনী, ক্যাডেট, স্কাউট, গার্লসগাইড ও জনসাধারণের সাথে বাংলাদেশের ডেলিগেট হিসেবে জাতীয় পতাকাসহ অংশ নেয় পদযাত্রার দলটি। উক্ত অনুষ্ঠানের সংবাদ ওইসময় ভারত ও বিদেশি রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়।

১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দেশে ফিরে আসে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ দলটির যুবকেরা। পদযাত্রার সময় বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয়রা ভালবাসা স্বরূপ দলটির হাতে তুলে দিত নানা উপহার। যার মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিসহ একটি সোনার নৌকা, একটি রেডিও, দুটি তলোয়ার, খাপসহ দুটি ছোরা, বেশ কিছু ঐতিহাসিক বই ও পদযাত্রার আলোকচিত্র। ফেরার আগে সেগুলো রেখে আসা হয় থিয়েটার রোডে তৎকালীন কলকাতাস্থ ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর নিকট। কিন্তু পরে সেগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। স্বাধীনতা লাভের পরে কোন সরকারই খোঁজ নেয়নি ইতিহাসের ওই পদযাত্রীদের। ফলে স্বাধীনতার পক্ষে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র ইতিহাসটি আজ প্রায় বিস্মৃত হয়ে আছে।

কামরুল আমান আক্ষেপ নিয়ে বলেন:

‘‘মুক্তিযুদ্ধটা কেন ন্যায় যুদ্ধ, সেটি ভারতীয়সহ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিল আমাদের কাজ। আমার কাছে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। আজ যদি দেশ স্বাধীন না হতো তাহলে এই ৩৮জনকে কিন্তু গুলি করে মারা হতো। কই, দেশ তো আমাদের মনে রাখেনি। ২০১০ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ডেকে নিয়ে সম্মান জানিয়েছিল। ওইটুকুই। আমাদের কোনো আফসোস নেই, কিন্তু কষ্ট আছে। যেসকল ভারতীয় নেতারা ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছিলেন বর্তমান সরকার তাদের এনে সম্মাননা দিয়েছেন। সেটিও ভালো উদ্যোগ। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য যারা প্রত্যক্ষভাবে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন রাষ্ট্র তো তাদের ইতিহাসটুকুই সংরক্ষণ করল না। এ প্রজন্ম জানেই না ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার’ ইতিহাসটি। এমন কষ্ট বুকে নিয়ে কয়েকদিন আগেই মারা গিয়েছেন একরামুলসহ পদযাত্রা দলের কয়েকজন।’’

১৯৭১এ ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’য় অংশগ্রহণকারী যুবকেরা ছিলেন অন্য রকম বীর। মুক্তিযুদ্ধের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করতে যারা যুদ্ধ করেছিলেন পায়ে হেঁটে। স্বাধীন এই দেশে এই বীরদের সম্মানিত করা হোক। সংরক্ষণ ও ছড়িয়ে দেওয়া হোক তাদের ইতিহাসটি। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল অনেকেরই অনেক প্রচেষ্টাতেই।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : ২৬ মার্চ ২০১৬

এই সাইডে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button