মুক্তিযুদ্ধও কী মিডিয়ার ইভেন্ট?
মুক্তিযুদ্ধের মাস কি চলে এসেছে? পত্রিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে বাবার কাছে পৃথার প্রশ্ন। কিভাবে বুঝলি? এটা তো খুব সহজ। এই যে দেখ, পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কাহিনি লেখা শুরু হয়ে গেছে। অন্য মাস গুলোতে তো সেটি হয় না। মেয়ের কথায় আমি নিশ্চুপ থাকি। যুক্তি খণ্ডনের কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। বিষয়টি পাশ কাটাতে শুধু বললাম তোর তো বেশ বুদ্ধি খুলেছে। কথা শুনে তের বছরের পৃথা মুচকি হাসে।
বাবা, তুমিই বোকা। এটা বুঝতে কি অনেক বুদ্ধির দরকার? চ্যানেলগুলোতে দেশের গান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনি, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, নাটক দেখলেই বুঝবে মাসটা ডিসেম্বর, নয়তো মার্চ। একইভাবে পত্রিকার যখন প্রথম পাতায় মুক্তিযুদ্ধের বিষয় ধারাবাহিকভাবে স্থান পাবে, তখনই বুঝে নিবে মাসটি মুক্তিযুদ্ধের। মিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে পৃথার মতো এ প্রজন্মের ধারণা কিন্তু এমনটাই। বাস্তবে আমাদেরও সেটি মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের এ ধরনের ধারণা হওয়াটাও কিন্তু সুখকর বিষয় নয়। ১৯৭২ এ সারা দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৩০টি, সব ধরণের পত্রিকা ও সাময়িকীর সংখ্যা ৩০০টির মতো। ২০১১ সালের হিসেবে দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১৮টি আর সব ধরণের সাময়িকীর সংখ্যা ৯৪৩টি। এছাড়া ত্রিশটির উর্ধ্বে টিভি চ্যানেল ও অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল তো রয়েছেই। আর এখন তো চলছে ২০১৫ সাল, তাও আবার বিদায়ের একেবার অন্তিমক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গণমাধ্যম গণমানুষের ভাবনার জগতে নাড়া দেয়। গণমাধ্যমে যা প্রকাশ পায় মানুষ সেই বিষয়ে চিন্তা করে। সহজভাবে বলতে গেলে, গণমাধ্যম মানুষের চিন্তার জগতকে প্রভাবিত করে। গণমাধ্যম যা ভাবায় মানুষ তাই ভাবে এক অর্থে। সে হিসেবে প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনন্য। কিন্তু সেই গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে প্রকাশ পাচ্ছে?
মিডিয়াতে বা গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ থাকে মাত্র দুই মাস। কিছু মিডিয়ার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম থাকলেও তার সংখ্যা খুবই নগন্য। বাস্তবে মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে আমরা পাই আর সকল দিবসের মতোই একটি ইভেন্ট হিসেবে।
বছর দুয়েক আগের কথা। মাসটি ছিল মে। প্রথম সারির একটি দৈনিকের উপ-সম্পাদকের সঙ্গে বসেছিলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের বিষয়ে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্য থেকে তাদের রক্ত ঝরানো দিনগুলোর আত্মত্যাগের কাহিনি লেখার মাধ্যমে এ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার পরিকল্পনার কথাই জানিয়েছিলাম। সবশুনে ওই সম্পাদক এ উদ্যোগের প্রশংসা করলেন। একইসঙ্গে কাজটি যেন থেমে না যায় সে বিষয়ে যারপরনাই উৎসাহ দিলেন। কিন্তু আসল কাজটি তিনি করলেন না। লেখা প্রকাশে অনিহা পোষণ করলেন। কারণ? তার ভাষায় ‘ডিসেম্বর ও মার্চ ছাড়া মানুষ এটা খাবে না’। সম্মানের সঙ্গে তাকে বলেছিলাম ‘মানুষকে ভালো জিনিস খাওয়ার রুচিটা তৈরির দায়িত্বও তো গণমাধ্যমকেই নিতে হবে।’ মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে শুধু নামকাওয়াস্তে ইভেন্টের মতো প্রকাশ না করে গণমাধ্যমগুলোর উচিত সারা বছরই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ধারাবাহিকভাবে নানা প্রতিবেদন বা অনুষ্ঠান প্রকাশ করা।কিন্তু নিয়মিতভাবে সারাবছর মুক্তিযুদ্ধের বিষয় স্থান পাওয়া গণমাধ্যমের সংখ্যা কতটি? সংখ্যাটি খুবই নগন্য। এ ক্ষেত্রে সময়, চ্যানেল আই, মাছরাঙা, একাত্তর টিভির কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ প্রায় সারাবছরই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে জানান দেয়। সব চ্যানেলগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠান সারাবছরই হতে পারে। কিন্তু সেটি আমরা পাই না। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে অপরাধ বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় নিয়মিতভাবে, সারাবছর। সচেতনতা বা সর্তকতার পাশাপাশি এই ধরণের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে অপরাধের নতুন নতুন কৌশলও দোলা দেয়। সেটি যদি নিয়মিত হতে পারে, তবে কেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠান নিয়মিত হয় না! এক অর্থে এটি হয়তো কোনো যুক্তি নয়, তারপরও ব্যাখ্যার জন্য বলা।
প্রিন্টেড পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র বা বিশেষ সংখ্যা বের করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি। ডিসেম্বর ও মার্চে সারাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপন ও বাণী ছাপানোর হিড়িকও পড়ে যায়। বিশেষ দিবসে বিশেষ সংখ্যা হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সারাবছর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র দুইমাস দায়সারা ভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কে সামনে রেখে কেবল স্পন্সর খোঁজার মাঝে কোন ধরণের চেতনা নিহিত রয়েছে আমার জানা নেই। তবে এক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সব পত্রিকাকেই একথা বলা যায় না।
দৈনিক পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি কর্ণার, চ্যানেলগুলোতে একটি করে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান, অনলাইনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা তথ্যের উপস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে খুব সহজেই। শুধু দরকার মিডিয়া মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের আন্তরিকতা আর দেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমের গভীরতা। আর এটা করা গেলে মানুষের ভাবনার মাঝে যুক্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংগ্রামের কাহিনী ও আমাদের বীরত্বের কাহিনিগুলো। যা জেনে পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম গড়া বাস্তবে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের কাজ সত্যিকারভাবে কতটুকু হয়েছে কিংবা অধিক জনসাধারণকে টানতে পারে এমন অনুষ্ঠান চ্যানেলগুলোতে কতটুকু আমরা দেখতে পাই? প্রায় একই ঢংয়ে এক চ্যানেলের অনুষ্ঠান অনুকরণে তৈরি হচ্ছে আরেক চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো। গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যত কাজ হয়েছে তার অধিকাংশই রাষ্ট্রপ্রধান বা বড় বড় নেতাকেন্দ্রিক। কিন্তু সেটিও খুব বেশি নয়। গণহত্যার দলিল এখনও পুর্ণাঙ্গভাবে তৈরি বা প্রকাশ হয়নি। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের বয়স ষাটের উর্ধ্বে। আগামী বিশ বছরে আমরা এদের একটি বড় অংশকে হারিয়ে ফেলব। কিন্তু এক একটি মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক একটি অংশ। সেই ইতিহাসকে আমরা কতটুকু ধারণ করতে পারছি? কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কতটুকু তুলে ধরতে পেরেছি? এই কাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের মিডিয়াগুলো।
গণমাধ্যম চাইলে খুব সহজেই মুক্তিযুদ্ধের মতো আত্মত্যাগের, বীরত্বের ইতিহাস সারাবছরই প্রচার করে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম গড়তে সহায়ক হতে পারে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধকে আর দশটা দিবসের মতোই ইভেন্ট হিসেবে চিন্তা করলে চলবে না। দেশের স্বাধীনতা ও ত্যাগের ইতিহাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করতে না পারলে আমরা দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী জাতি কিভাবে তৈরি করব?
চ্যানেলগুলোতে এখন বিভিন্ন নামে চলে টক শো। টক শোর বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের কোনো একটি বিষয়কে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় আমরা দেখি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত কোনো বিষয় নিয়ে টকশোজীবীরা আলোচনা করতে গিয়ে এমন সব অবাস্তব তথ্য ও বিষয়ের কথা তুলে ধরেন, যার কোনোই ভিত্তি নেই। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রকৃত সত্য নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মানুষ যা মোটেই আশা করে না।
অতি সম্প্রতি সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসি যেভাবে সরাসরি প্রচার করা হয়েছে, সেটিও গণমাধ্যমকে খানিকটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজাকারদের ফাঁসির সংবাদটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটি কিভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে সে বিষয়ে গণমাধ্যমের অপরিপক্কতাই আমরা শুধু দেখেছি। কোনটি নিউজ আর কোনটি নয়, তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের অদক্ষতা রয়েছে। সাংবাদিকতায় নতুন কিছু করার সুযোগ আছে। কিন্তু তাই বলে রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে বলে খবর পাওয়া মাত্র জেলগেটে গিয়ে সমস্ত ঘটনাটি উত্তেজিত কণ্ঠে দর্শক-শ্রোতাকে জানানো বা ধারাভাষ্য দেওয়াটা বোধকরি নতুন আবিষ্কার। এমনটা করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকই অতিউৎসাহে বিভ্রান্তিকর তথ্যও পরিবেশন করেছেন। অনেক চ্যানেলই কেন, কী কর্মফলের জন্য তাদের ফাঁসি হচ্ছে সেটি অন্তরালেই রেখে দিয়েছে। ফলে রাজাকারদের প্রতি কারও কারও মনে তাৎক্ষনিক অনুকম্পার জন্ম দিয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ইতিহাস প্রকাশে মিডিয়ার আরও সর্তক থাকতে হবে। মিডিয়া বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরে কিছু উলঙ্গ ও অর্ধউলঙ্গ ছবি প্রকাশের মাধ্যমে। প্রশ্ন হচ্ছে, একাত্তরের বীরাঙ্গনা যাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে, তাদের পরিচিত করতে ওই ছবিগুলোকেই কী তুলে ধরা খুব জরুরি?
মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা এই তিনটি বিষয়কে সমাজের মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রজন্ম গড়তে মিডিয়াকেই সামনে এগিয়ে আসতে হবে। তাই আমরা চাই, মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ থাকুক সারাবছর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মিডিয়াগুলো জাগ্রত থাকুক।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, প্রকাশকাল: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫
© 2016 – 2018, https:.