সাজেকের পাইলিংপাড়ায়
‘রাস্তাটা চলে গেল পাহাড়ের বুক চিরে। কাঁচা পথে লালমাটির ধুলো। পা জড়িয়ে যাচ্ছিল তাতে। খানিক এগোতেই পথটা হয়ে যায় দুর্গম। একপাশে তখন খাড়া গিরি খাত। পা পিছলে পড়লে গন্তব্য কোথায়, খালি চোখে তা ঠাওর করার উপায় নেই। ভারসাম্য রাখতে একমাত্র ভরসা পাহাড়ি বাঁশের লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসি চূড়ায়। এখানেই দেখা মিলল গ্রামটির। নাম ‘কোয়াংলাকপাড়া’। সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়ার গ্রাম এটি। কাছের ‘কোয়াংলাক’ ছড়া থেকে পানযোগ্য পানি সংগ্রহ করে এ গাঁয়ের মানুষ। তাই ছড়ার নামেই হয়েছে গায়ের নাম ‘কোয়াংলাক’।
পাহাড়ের চূড়ায় কোয়াংলাকপাড়ায় পা পড়তেই নজরে আসে বড় বড় বেশকিছু কালো পাথর। খোদাই করা তারিখ লেখা তাতে। কারা লিখেছে এটি? আমাদের গাইড সুপর্ণ জানাল, সে ব্রিটিশ আমলেরও আগের কথা। লুসাই ও পাংখোদের রাজত্ব ছিল এখানটায়। সে আমলের কয়েকজন ধর্মযাজকের স্মৃতির উদ্দেশে রাখা হয়েছিল পাথরগুলো। ছিয়াত্তর বছর বয়সী পাহাড়িদের হেড ম্যান চো মিং খানও জানালেন তেমনটি।
হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি জুয়েল নেই। পাথরগুলোর ওপর সমতল একটি জায়গা খুঁজে নিয়েছে সে। সেখান থেকে চারপাশ দেখছে অবাক নয়নে। আমরাও পা বাড়াই। আহা! যেন আকাশের ওপর কোনো স্বপ্নপুরিতে চলে এসেছি। অতঃপর চোখ পড়ে পাহাড়ের পাদদেশের গ্রামটিতে।
এ পাহাড়ের পেছন দিকটা যেন অন্য দুনিয়া। সবুজ প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে। বড় বড় গাছ। কিন্তু তার গোড়ার দেখা মেলা ভার। দূর পাহাড়ের গাঁয়ে চলছে জুম চাষ। ধাপ ধাপ করে মাটি কেটে তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ি পথ। সে পথ দিয়ে নকাই (ঝুড়ি) নিয়ে উঠে আসছে আদিবাসী নারীরা। পাহাড়ের ঢালে বাঁশের মাচাঘর। প্রকৃতিবান্ধব এই মাচাঘরগুলো প্রকৃতিজন ত্রিপুরাদের।
বড় বড় পাহাড়ি কাশফুল ফুটেছে এদিক-ওদিক। বাতাসে শরীর দুলিয়ে ফুলগুলো যেন আমাদেরই স্বাগত জানাচ্ছে। কাশফুলের পেছনে অনেক নিচে ছবির মতো একটি আদিবাসী গ্রাম। কয়েকটি শিশু খেলছিল উঠোনে। হঠাৎ পাহাড় কাঁপিয়ে ডাকতে থাকে হরিণ। কাঁপন ধরায় আমাদের মনেও। ভিন্ন জাতির মানুষদের জীবন প্রবাহের ছোঁয়া পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে।
পাইলিংপাড়ার ত্রিপুরা গ্রামটিতে যখন পৌঁছি, তখন মধ্য বিকেল। আদিবাসীরা ফিরছে জুম থেকে। চিরমালা ত্রিপুরা ও কজরী ত্রিপুরা ব্যস্ত কাজে। জুম থেকে আনা কাঁচা হলুদগুলো তাঁরা শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন উঠোনে। দু-একজন নারী আপন মনেই তাঁত বুনছেন নিজেদের জন্য। রিয়াজের দৃষ্টি পাহাড়ি হ্যাচিং বা আদার দিকে। জাহাজের খবর না নিলেও আদার খবর তার চাই-ই চাই। পাহাড়িরা বলে তাদের সুখ-দুঃখের কথা। জানায় দূর ছড়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করার কষ্টের কথাও।
এই গ্রামের দুই পাশে গিরি খাত। সামনে এগোতেই অনেক নিচে আরেকটি পাহাড়ের চূড়া। সেখানেও আরেকটি গ্রাম। পাহাড়ের পেছনের পাহাড়গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড়ি হরিণের চিত্কার, অজানা পাখির ডাক, বাতাসের মৃদুমন্দ শব্দ আর আদিবাসীদের খ্রাঁর (ঢোল) বাদ্যিতে একাকার হয়ে যাই।
জুয়েল ব্যস্ত ছবি তোলায়। রিয়াজ চুটিয়ে গল্প করছেন গ্রামের কারবারি (প্রধান) নলো কুমার ত্রিপুরার সঙ্গে। একটি মাচাঘরের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে খবর নিচ্ছে ‘হুঁকো’ বা জুমচাষের। জুমক্ষেতে একই সঙ্গে কিভাবে ‘মছ থাইনছু’ (মরিচ), সিপুই (তিল), মাই কন (ভুট্টা), ধান, হলুদ লাগানো হয়—সে কাহিনী শুনছে সে।
রাতের খাবার হবে এই গ্রামেই। মেন্যু—আদিবাসী ব্যাম্বো চিকেন। জুমের সময়কার খাবার এটি। এর মধ্যেই সুপর্ণ দা লোক পাঠিয়েছেন বিশেষ ধরনের বাঁশ কেটে আনতে। একটি বন মোরগ রাখা ছিল আগে থেকেই।
জুমক্ষেতের ঘরকে ত্রিপুরারা বলে ‘গাইলিং’। জুম ফসল যখন পেকে যায় তখন বন্য প্রাণীর মাধ্যমে ফসল নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। ফলে সে সময় থেকেফসল তোলা পর্যন্ত আদিবাসীদের জুমের পাহাড়েই কাটাতে হয়। তখন তাদের রান্নার পাত্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে বাঁশ।
আমাদের সামনেই বিশেষ কায়দায় বাঁশ কেটে তার মধ্যে ঢোকানো হয় মাংস আর মসলা। অতঃপর কলাগাছের পাতা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মুখগুলো। কয়লার আগুনের তাপে বেশ কিছুক্ষণ রেখে দেওয়া হয় বাঁশগুলো। খাবার সময় হুকনি মাই বা জুম ভাতের সঙ্গে গরম গরম পরিবেশন করা হয় বাঁশের ভেতরকার রান্না করা মাংসগুলো। ইস্, ভাবলে এখনো জিবে জল আসে। রাত বাড়ার আগেই পা বাড়াই আমাদের অস্থায়ী আবাসস্থল ‘জলবুক কটেজ’-এর পথে। চূড়া থেকে শেষবারের মতো দেখি আদিবাসী গ্রামটিকে।
কিভাবে যাবেন
কলাবাগান থেকে খাগড়াছড়ির একাধিক বাস ছাড়ে। ভাড়া ৫৫০-৯৫০ টাকা। খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়িতে যাওয়া যায় সাজেকে। জলবুক কটেজে থাকতে অবশ্যই আগে রুম বুকিং করতে হবে। মুঠোফোন : ০১৮২০ ১৮০৭৫০। রুম ভাড়া ২৫০০-৩০০০ টাকা। পাহাড়ি গ্রামে ঘুরতে অবশ্যই স্থানীয় গাইড নিতে হবে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকণ্ঠে, প্রকাশকাল : ১৪ মার্চ ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.