আদিবাসী

চৈত্র-বৈশাখে আদিবাসী গ্রামে

পাকা রাস্তার ঠিক ডানদিকটায় ঠমনিয়া শালবন। দূর থেকে তা দেখিয়ে দেয় একজন। চৈত্র মাস। গোটা শালবন সেজেছে নতুন সাজে। গাছে গাছে সবুজাভ কচি পাতা। ডালে ডালে সাদা শালফুল।

আমাদের গন্তব্য মহেশপুর গ্রাম। দিনাজপুরের এ আদিবাসী  গ্রামটিতে শদুয়েক সাঁওতাল পারিবারের বাস। দারিদ্র্য আর ধর্মান্তরিত হওয়ার হাতছানিকে পেছনে ফেলে এখানে এরা টিকিয়ে রেখেছেন পূর্বপুরুষের আদি বিশ্বাসগুলোকে।

শালবনের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি মেঠোপথ। সে পথে খানিক এগোতেই মহেশপুর। এ গ্রামেই আজ বাহাপরব উৎসব। প্রতি চৈত্রের শেষে এখানকার সাঁওতালরা আয়োজন করে এ অনুষ্ঠান। সাঁওতালদের ভাষায় বাহা মানে ফুল আর পরব মানে অনুষ্ঠান বা উৎসব। বসন্তে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, চম্পা ফুল ফোটে চারদিকে। বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। বাহাপরবের আগে সাঁওতাল নারীদের ফুল ব্যবহার বারণ থাকে। এ উৎসবে সাঁওতালরা শালফুলকে বরণ করে নেয় কিছু আনুষ্ঠানিকতা ও আচারের মাধ্যমে।

আমরা যখন পৌঁছি, তখন মধ্য দুপুর। গ্রামের শেষ প্রান্তে নির্জন জায়গায় চলছে বাহাপরবের আনুষ্ঠানিকতা। গোত্র প্রধান বা জগ মাঝি বাঠু সরেন। উপোস অবস্থায় তিনি পুজো দিচ্ছেন বোঙ্গার (দেবতা) সন্তষ্টি লাভের জন্য। উচ্চকণ্ঠে পড়ছেন মন্ত্র—জোহার এবে খানদো, মরেকু তুরেকু, আলেয়া আতু নুতুমতে…।

একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেড়ে দেওয়া হয়েছে। একটি কুলার মধ্যে রাখা হয়েছে চাল, সিঁদুর, ধান, দুর্বাঘাস আর বেশ কিছু শালফুল। পাশেই  বলি দেওয়া হয়েছে কয়েকটি লাল মুরগি। পুজোর নিয়ম এটিই। বলি দেওয়া মুরগি দিয়ে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করে কয়েকজন।

বাহাপরব উৎসবটি তিন দিনের। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানই প্রধান। এ উৎসবের মূল উদ্দেশ্য জাহেরএরা, গোসায়এরা, মরেকু, তুরইকু নামক দেবতা বা বোঙ্গার সন্তুষ্টি লাভ।

প্রথম দিন পুজোর মাধ্যমে মুরগি বলি দেওয়া হয়। অতঃপর সাঁওতাল নারীরা শালফুলকে গ্রহণ করে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। তারা খোঁপায় পরে শালসহ নানা রঙের ফুল। দলবেঁধে নেচে-গেয়ে বরণ করে নেয় নতুন ঋতুকে। একই সঙ্গে সেদিনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলি করা হয় শালফুল।

মহতের মাথায় থাকে শালফুলের ডালা। কলস ভরা পানি নিয়ে সঙ্গে থাকে এক যুবক। এক একটি বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গৃহস্থ নারীরা ওই মহতকে পা ধুইয়ে দেন। তখন প্রত্যেক নারীকে ডালা থেকে শালফুল দেওয়া হয়। তারা তা গ্রহণ করে পরম ভক্তির সঙ্গে। অতঃপর শুরু হয় আনন্দ নৃত্য।

দ্বিতীয় দিনের আনুষ্ঠানিকতা কীভাবে হয়? বাটু সরেন বলেন, এদিন সাঁওতালরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এদের বিশ্বাস, পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরোনো যত হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা আছে, তা দূর হয়ে যায়। ফলে পরস্পরের সঙ্গে তৈরি হয় বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন। বাহাপরবের তৃতীয় দিনটিতে চলে শুধুই নানা আনন্দ আয়োজন।

বিকেল হতেই আশপাশের সাঁওতালরা জড়ো হতে থাকে নানা সাজপোশাকে। মহতও বসেন শালফুল সাজিয়ে। সব বয়সী আদিবাসীরা প্রথমে তাকে ভক্তি দেয়। অতঃপর বিশেষ ভঙ্গিতে গ্রহণ করে শালফুল।

কিন্তু চৈত্র মাসে ভুনজার আদিবাসীরা সাঁওতালদের মতো বাহাপরব পালন করে না। একবার বৈশাখের প্রথম প্রহরে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের বহবলদীঘির ভুনজার পাড়ায়। বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবেই ওই দিন সবাই দলবেঁধে বেড়িয়েছে শিকারে। এটাই ভুনজারদের রীতি।

এরা চৈত্র মাসের শেষ দিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে পূজা আর বিশেষ আচারের মাধ্যমে পালন করে আসছে। ভুনজারদের ভাষায় এটি চৈতবিসিমা উৎসব। এ উৎসবের অংশ হিসেবে চৈত্র মাসের শেষ দিন এরা বাসন্তীপূজা করে থাকে।

কেন এই পূজা? প্রশ্নের উত্তর মিলে গোত্র প্রধান বাতাসু ভুনজারের মুখে। তাঁর ভাষায়, বাপদাদারা পূজিছে, তাই পূজি।

এক সময় যখন চিকিৎসার জন্য কোনো ডাক্তার ছিল না। তখন ডায়রিয়া আর বসন্তে মারা যেত শত শত আদিবাসী। এ দুটি রোগ থেকে মুক্তি পেতেই ভুনজাররা চৈত্রের শেষ সন্ধ্যায় ঠাকুরের কাছে পূজা দেয়। বসন্ত রোগ থেকে মুক্তির জন্য এই পূজা করা হয় বলেই এর নামকরণ হয়েছে বাসন্তী পূজা।

এ পূজায় একটি মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারকেল, ধূপ  আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ ওই দিনেই বলি দেয় মানতের হাঁস, মুরগি কিংবা পাঁঠা। এর আগে চৈত্রের শেষ শুক্রবার এরা উপোস থাকে। উদ্দেশ্য ঠাকুরের সন্তুষ্টি ও  রুজি বৃদ্ধি। বিনা লবণে আতপ ভাত খেয়ে উপোস শুরু। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই ফলমূল আর দুধ।

বাসন্তী পূজা শেষে ভুনজাররা সবাই কালাইসহ নানা ধরনের ছাতু-গুড় খেয়ে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে ওঠে। বাতাসু জানাল,  সে কারণেই গত রাতে চলেছে খ্যামটা নাচ আর হাড়িয়া খাওয়া।বাঙালিদের মতো বৈশাখে আদিবাসীরা তাদের প্রিয়জনকে নতুন কিছু উপহার না দিলেও বৈশাখের সকালে সবাই মিলে পোনতা (পান্তাভাত) খায়। পূর্বপুরুষের আমল থেকেই চৈত-বিসিমার অংশ হিসেবে এরা সকালে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে সেরে নেয় পান্তা খাওয়া। এদের বিশ্বাস, বৈশাখের প্রথমে পান্তা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও তারা কষ্ট পাবে না। পান্তার পানি তাদের শরীরকে ঠান্ডা রাখবে।

বৈশাখের প্রথম দিন ভুনজাররা তীর-ধনুক আর কোদাল নিয়ে দলভেদে শিকারে বের হয়। সন্ধ্যা অবধি চলে শিকার। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি করে শিকারগুলো দিয়ে রান্না হয় খিচরি (খিচুড়ি)। রাতভর চলে আনন্দফুর্তি  আর হাড়িয়া খাওয়া।

আমরা শিকার অবধি অপেক্ষায় থাকি না। বিকেলের দিকে পা বাড়াই কালিয়াগঞ্জের দিকে। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। তা পেরোতেই ঠেকে বিশাল শালবন। লাল মাটির ধুলো মেখে চলে আসি শালবনের একেবারে ভেতরে। চারপাশে গা ছমছমে পরিবেশ। খুব কাছেই সীমান্ত। এখানেই খুঁজে পাই পাহানদের একটি আদিবাসী পাড়া।

বৈশাখের রীতি অনুসারে পাহানরা ভাতের সঙ্গে খেয়ে নিয়েছে ১২ ভাজা, অর্থাৎ ১২ পদের তরকারি। ভুনজারদের মতোই এরাও বৈশাখের সকালে খায় পান্তা। আর সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে চলে নাচ-গানের আসর। জানালেন ওই পাড়ার সবুজ পাহান।

কেন পান্তা খান? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি গান ধরেন;

হামে লাগে প্রথমে আদি বাসীই

পন্তা ভাত ভালোবাসি…

তার গানে আমরা বেশ মজে যাই। বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিনেও পাহানরা আয়োজন করে নানা আচারের। ওই দিন এরা বাড়িঘর পরিষ্কার করে একে অপরের গায়ে কাদা আর রং ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাদা বা রং দেওয়া হয় তাকেই খেতে দিতে হয় প্রিয় পানীয় হাড়িয়া। এদের বিশ্বাস এতে বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষ দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনে পাহানদের এ উৎসবকে বলে সিরুয়া বিসুয়া।

এ ছাড়া এরা চৈত্র মাসেই আয়োজন করে চৈতালিপূজার। রোগ থেকে মুক্তি পেতে ঠাকুরের কৃপা লাভই এ পূজার উদ্দেশ্য। এ পূজায় আগের রাতে উপোস থেকে পরের দিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙাই নিয়ম। মঈনকাটা বা বেল গাছের নিচে মাটির উঁচু ডিবি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধূপ কাঠি টাঙ্গিয়ে, পান, সুপারি, দুধ, কলা, দুর্বা ঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরকে পূজা দেওয়া হয় চৈতালিপূজায়। একই সাথে বলি দেওয়া হয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে চলে খিচুড়ি আর হাড়িয়া খাওয়া। রাতভর চলে নাচ-গান।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বৈশাখের আনন্দে বেজে ওঠে আদিবাসীদের মাদল আর ঢোলগুলো। শালবনের ভেতরে তখন ঝিঁ ঝি পোকার ডাক। মাঝেমধ্যেই ডেকে উঠছে দু-একটা শেয়াল। এরই মাঝে আমরা ফিরতি পথ ধরি। দূর থেকে ভেসে আসে আদিবাসী গানের সুর :

পানের ডেলা পানে রইল

সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল, মা

সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল

হে সেবেল, সেবেল, ওয়াহাগলে, ওহাগলে, হে…।

আদি রীতি মেনে প্রতি চৈত্র-বৈশাখেই আদিবাসী গ্রামগুলোতে চলে নানা উৎসব। এভাবেই নাচ, গান আর আদি বিশ্বাসের রীতিগুলো টিকে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। দারিদ্র্য, বৈষম্য আর নানা অবহেলায় আদিবাসীদের সারা বছরের কষ্টগুলো ভেসে যায় উৎসবের বাঁধভাঙা আনন্দ স্রোতে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমে প্রকাশকাল: ১৪ এপ্রিল ২০১৬

এই সাইডে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button