মুক্তিযুদ্ধ

ইসলামী ব্যাংকের টাকা ও সামষ্টিক নির্লিপ্ততার ব্যবচ্ছেদ

“অনেক গণমাধ্যমই নানা অনুষ্ঠানে স্পন্সর হিসেবে কিংবা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা। এ বিবেচনায় টিভি চ্যানেলের হিসাব কষলে তা নেহায়েত কম হবে না। অথচ এরাই দাবি করেন যে, এদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়ও আমরা দেখেছি একজন জনপ্রিয় উপস্থাপককে, যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জনে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে প্রকাশ্যে সুর মিলিয়েছিলেন, অথচ কয়েক দিন পরেই গোপনে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মোটা দাগের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের বিবেক ও কন্ঠ।”

প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা আর ঘৃণ্য রাজাকারদের পরিচালিত ব্যাংকের টাকা নেওয়া– এই দুটি কাজ কি একসঙ্গে চলতে পারে?

অনেক পত্রিকায় বিষয়টি না এলেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে উঠে এসেছে খবরটি। তা নিয়ে স্যোশাল মিডিয়াও ছিল সরব। দিন দুয়েক চলেছে নিন্দা আর সমালোচনার ঝড়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় আর্থিক সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে জামায়াত-সংশ্লিষ্ট ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে।‘হিরন্ময় অ্যালামনাই মেলববন্ধন’ নামের ওই অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল ইসলামী ব্যাংক। সঙ্গে ছিল শাহকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।

প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চা বিদ্যাপীঠের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের মিলন মেলায় কেন নেওয়া হল যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের টাকা? কেনই-বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থেকে মাস খানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছিল? তাহলে কাদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ইসলামী ব্যাংকের টাকা নিল? এই ব্যাংক ছাড়া কি অন্য কোনো ব্যাংক ছিল না? শুধু টাকার সহযোগিতা নেওয়াই কি এর উদ্দেশ্য ছিল?

এ রকম অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জামায়াত নেতাদের অংশগ্রহণের কারণে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ হিসেবে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর প্রায় শুরু থেকেই ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা করে আসছে জামায়াত-সংশ্লিষ্ট বা মতাদর্শের লোকেরাই।সেখানে কাজও করছে ওই আদর্শে বিশ্বাসী জামায়াত-শিবির কর্মীরা।

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের। একাত্তরে চট্টগ্রাম এলাকায় আল বদর বাহিনীর নেতা ছিলেন তিনি।শান্তি কমিটির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছাড়াও তিনি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ও চট্টগ্রাম বদর বাহিনীর জেলাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। সহজ অর্থে, ইসলামী ব্যাংকই জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান।

 এছাড়া ২০১৪ সালে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে এইচএসবিসি যুক্তরাজ্য, সিটি ব্যাংক এনএ, ব্যাংক অব আমেরিকা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির এক প্রতিবেদনেও ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ ওঠে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা মতে, এই ব্যাংকে এমন কিছু হিসাবধারী পাওয়া গিয়েছিল যাদের নাম ছিল জাতিসংঘের সন্দেহের তালিকায়।

এত কিছুর পরও যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে কিংবা জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে কথা বলছেন, তাদের অনেকেই আবার নানা অনুষ্ঠানে ওই ব্যাংকের মোটা দাগের তহবিল গ্রহণ করছেন নানা অজুহাতে, র্নিলজ্জভাবে। একে কোন চেতনার ধারক-বাহক বলা যায় আমাদের জানা নেই!

এর আগে বিভিন্ন সময় ইসলামী ব্যাংকের টাকা গ্রহণ প্রসঙ্গে বির্তকিত ও সমালোচিত হয়েছে সরকার। ২০১৪ সালে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ আয়োজনে ইসলামী ব্যাংক তিন কোটি টাকা দিলেও তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার তা ফিরিয়ে দেয়। তারও আগে, ২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনে এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যাংকটির কাছে হাজার কোটি টাকা চেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অনেক গণমাধ্যমই নানা অনুষ্ঠানে স্পন্সর হিসেবে কিংবা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা। এ বিবেচনায় টিভি চ্যানেলের হিসাব কষলে তা নেহায়েত কম হবে না। অথচ এরাই দাবি করেন যে, এদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়ও আমরা দেখেছি একজন জনপ্রিয় উপস্থাপককে, যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জনে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে প্রকাশ্যে সুর মিলিয়েছিলেন, অথচ কয়েক দিন পরেই গোপনে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মোটা দাগের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের বিবেক ও কন্ঠ।

দুঃখ লাগে তখন যখন এ ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজের পক্ষে পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে, একে অন্যকে দেখিয়ে তা জায়েজ করার চেষ্টা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা আর ঘৃণ্য রাজাকারদের পরিচালিত ব্যাংকের টাকা নেওয়া– এই দুটি কাজ কি একসঙ্গে চলতে পারে? তাহলে যারা এই কাজ করছেন তারা কি এক অর্থে জামায়াতের আদর্শ বাঁচিয়ে রাখছেন না?

বিজ্ঞাপনের প্রতিযোগিতার বাজারে এখন ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞাপন পাওয়া খুব সহজ। কারণ ব্যাংকটি প্রবলভাবে ইমেজ সংকটে পড়েছে। তারা তাই বিজ্ঞাপন ও নানা সহযোগিতা প্রদান করছে ইমেজ ফেরানোর কৌশল হিসেবে। এ ক্ষেত্রে এরা বেছে নিয়েছে সরকারি অনুষ্ঠান, মিডিয়া আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের অনুষ্ঠানের মতো জায়গাগুলো। আর আমরাও তাদের কৌশলগুলো যত্ন সহকারে বাস্তবায়ন করছি শুধুমাত্র টাকার লোভে। কিন্তু যতটা প্রবল আকারে এটি চলছে তাতে সন্দেহ থাকছে এটি শুধুই অর্থের কারণে ঘটছে কি না তা নিয়ে।

তাই এ বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে সরকারকেই। কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে এ ধরনের ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতা কোনোভাবেই গ্রহণ করা হবে না এ বিষয়ে সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকেই পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দিতে হবে, দেওয়াও উচিত।তাহলে হয়তো সরকারের অজুহাত দেখিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংকের টাকা গ্রহণ থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আসবে।

দিন দুয়েক আগে কথা হচ্ছিল প্রথম সারির দৈনিকে কর্মরত এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে। তার মতে, ইসলামী ব্যাংক এখন খাজা বাবার দরগা। সেখান থেকে কেউ ফিরে না খালি হাতে। যে যা চায় সে তাই পায়।

স্বাধীন এই দেশে ইসলামি ব্যাংকের দরগায় কে যাবেন, আর কে যাবেন না, সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত আদর্শ আর রুচি-অভিরুচির ব্যাপার। কিন্তু রাজাকারদের ব্যাংকের টাকা খেয়ে একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঢেঁকুরটি কি না তুললেই নয়!

ছবি: বিডিনিউজ২৪.কম

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে, প্রকাশকাল: ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button