সাঁওতাল বিদ্রোহ: সিদু-কানুর কথা
‘সরাসরি বিজয়ী না হলেও সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের বসবাসের জন্য রাজমহল ও দামিন-ই-কো এলাকাসমেত বীরভূম ও ভাগলপুর জেলার বিস্তৃত অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামের একটি নতুন জেলা গঠন করে। মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল হয়। সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে।’
স্কুলমাঠের এক কোণে শহীদ মিনারটি। চুনকাম করে ধুয়েমুছে সাজানো হয়েছে সেটি। রঙিন কাগজ জড়ানো দড়িতে মাঠের চারপাশ ঘেরা। কয়েকশ আদিবাসী লাইন করে দাঁড়ানো। শহীদ মিনারে একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সবাই।
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের এই স্কুলটির নাম মহেশপুর উচ্চ বিদ্যালয়। শহীদ মিনারের পাশে ফুল দিয়ে অপেক্ষারত স্কুলটির একজন শিক্ষক। পরিচয় হয় তাঁর সঙ্গে। নাম তাঁর সানজিলা হেমব্রম। দিনটি ছিল গত বছরের ৩০ জুন। সানজিলার ভাষায়, ‘সানতাল বিদ্রোহ দিবস।’ তাই প্রতিবছরের মতো মহেশপুরে চলছিল এই আনুষ্ঠানিকতা। এরই মধ্যে একদল সাঁওতাল তীর-ধনুক নিয়ে মাঠে নামে। দূরে থাকা একটি কলাগাছকে লক্ষ্য করে তীর ছোড়ে তারা। সাঁওতালদের ভাষায় এই খেলাটির নাম ‘আ পরী তুইন এনেইদ’।
অন্যপাশে দেখি আরেক দল আদিবাসী। চোখে গামছা বেঁধে লাঠির আঘাতে তারা ভেঙে দিচ্ছে দূরে রাখা মাটির হাঁড়িগুলো। সাঁওতালরা একে বলে ‘টুকুই রাপুত এনেইদ’। সানজিলা জানালেন, এই খেলা দুটির মাধ্যমে সাঁওতালরা অশুভ শক্তির প্রতীকী বিনাশ ঘটায়।
কথায় কথায় আদিবাসীরা মেতে ওঠে নানা খেলায়। সানজিলার সঙ্গে আমাদের আলাপও জমে ওঠে।
কী ঘটেছিল ৩০ জুন? সানজিলার উত্তর, ‘এটা সিদা-কানু দিবস।’ অতঃপর তিনি হরহর করে বলতে থাকেন সবকিছু।
ওই সময় সাঁওতালরা বন কেটে জমি তৈরি করে ফসল ফলাত। আর জমিদারদের শকুনদৃষ্টি পড়ত সেই জমিতে। মহাজনদের কাছে সাঁওতালদের দেনার জের মিটত না ১০ গুণ পরিশোধের পরও। তাই সপরিবারে মহাজনের বাড়িতে গোলামি খাটতে হতো তাদের। আদালত আর পুলিশ থেকেও তারা কোনো সাহায্য পেত না। ফলে জমিদার, মহাজন আর সরকারকে শত্রু (দোকো) মনে করত সাঁওতালরা।
১৮৫৪ সালের প্রথম দিকের কথা। গোপনে সাঁওতালরা শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। বীর সিংয়ের নেতৃত্বে তৈরি হয় একটি দল। কিন্তু টিকতে পারে না তারা। পাকুড় রাজার দেওয়ান জগদ্বন্ধু রায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় বীর সিং ধরা পড়েন। জরিমানাসহ সবার সামনে তাকে তারা জুতাপেটা করে।
সে সময় গোচ্চো নামে এক ধনী সাঁওতাল ছিলেন। তাঁর টাকার ওপর ছিল মহাজনদের বিশেষ লোভ। তারা মহেশ দারোগাকে দিয়ে তাকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে। তার বিরুদ্ধেই দেওয়া হয় চুরির মামলা। গাছে ঝুলিয়ে গোচ্চাকে নির্দয়ভাবে চাবুক মারে ওরা। জমিদার, মহাজন আর পুলিশের এমন জুলুম-পীড়নে সাঁওতালরা ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হতে থাকে।
সিদু, কানু, চাঁদ, ভৈরব ছিল চার ভাই। সাঁওতাল পরগনার ভাগনাদিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে এদের জন্ম। একসময় এরা বেশ সচ্ছল ছিল। একবার ফসল না হওয়ায় মহাজনদের কাছে তাদের দেনা যায় বেড়ে। ফলে ক্রমেই তারা দরিদ্র হয়ে পড়ে।
বীর সিং আর গোচ্চোর অপমান ও পীড়ন সিদু-কানুর মনে দাগ কাটে। সাঁওতালদের ওপর জুলুম আর অত্যাচার দেখে সিদু-কানু বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারা তখন জমায়েত হওয়ার জন্য চারপাশের সাঁওতালদের কাছে পাতাসমেত ছোট শালের ডাল পাঠায়। তাদের কাছে এটি একতার প্রতীক। এভাবে ডাক দেওয়ার রীতিটি ছিল সাঁওতালদের ঐতিহ্য।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। সিদু-কানুর ডাকে ভাগনাদিহি গ্রামে জড়ো হয় প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষক। সবাই শপথ নেয় জমিদার, মহাজনদের, ইংরেজ শাসকের, পুলিশ-পাইক-পেয়াদার আর জজ ম্যাজিস্ট্রেটের নিপীড়ন ও দাসত্ব সহ্য না করার। সিদ্ধান্ত হয় খাজনা না দেওয়ার। বিদ্রোহী কণ্ঠে সেদিন স্লোগান ওঠে—জমি চাই, মুক্তি চাই।
বিদ্রোহ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে সিদু-কানু জাহির করল, আমরা মহিষ টানা লাঙল আট আনায় ও বলদে টানা লাঙল চার আনায় দেব আর সরকার আমাদের কথা না রাখলে আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করব, দোকোদের খতম করব এবং আমরাই রাজা হব।
এভাবে সিদু-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বাহিনী গড়ে ওঠে। রেললাইনের কাজে যুক্ত জোয়ান জোয়ান সাঁওতাল ছেলেরাও যোগ দেয় বিদ্রোহে। এ ছাড়া সাঁওতাল নেতারা গ্রামে গ্রামে শালডাল পাঠাতে লাগলেন। তারা দলবেঁধে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গান গেয়ে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে থাকে বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার জন্য।
গ্রামে দিয়ে ওই গ্রামের নাম উল্লেখ করে তারা গায় :
ধানজুড়ি হে
ঢোল বাজে হে
ঢাক বাজে হে
সিদো কানহু চাঁদ ভায়রো
হুলে হু……. লে।
ভাবার্থ : শুন হে ধানজুড়িবাসী, ঢোল বাজছে, ঢাক বাজছে, সিদো কানহু চাঁদ ভায়রো, বিদ্রোহ বি…দ্রোহ।
বিদ্রোহ বিষয়ে গ্রামবাসীর কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেলে তারা টিটকারী দিয়ে গাইত :
ধানজুড়ি হে
জানি হইল ম…রদ
মরদ হইল জা…নি
হে হে হে…. হে।
একসময় তারা ডাক ও রেল বন্ধ করে দেয়। ক্রমেই সাঁওতালদের শক্তি দেখে জমিদার, মহাজন ও ঠগবাজ বেপারীরা পালাতে থাকে। এভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলায়।
সাঁওতালদের বিদ্রোহ দমাতে বহরমপুর থেকে ব্রিটিশ সেনাদল আসে মুর্শিদাবাদে। সেখানকার জেলা শাসক টুগুডে ১৫ জুলাই মহেশপুরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে বিদ্রোহীরা পরাস্ত হয়। ১০ নভেম্বর সামরিক আইন জারি করে জেনারেল লয়েড ও জেনারেল বার্ড ১৪ হাজার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ এলাকা ঘিরে ফেলে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করে তারা। ফলে বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন হয়।
সিদু-কানুর কী হয়েছিল?
উত্তরে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে সানজিলা হেমব্রম বলেন, নভেম্বরের শেষ ভাগে জামতাড়া এলাকা থেকে বন্দি হয় কানু। সিদু ধরা পড়ে তার আগেই ঘাটিয়ারিতে। পরে তাকে ভাগনাদিহি গ্রামে নিয়ে হত্যা করা হয়। কানুর বিচার হয় আদালতে। বিচারে তাঁকেও হত্যা করা হয় গুলি করে।
সিদু-কানু কি পরাজিত হয়েছিল?
সানজিলার উত্তর, ‘না তো।’ সরাসরি বিজয়ী না হলেও সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের বসবাসের জন্য রাজমহল ও দামিন-ই-কো এলাকাসমেত বীরভূম ও ভাগলপুর জেলার বিস্তৃত অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামের একটি নতুন জেলা গঠন করে। মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল হয়। সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ও ভারতের কৃষক-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে শুধু উজ্জ্বল আর গৌরবান্বিতই করেনি; বরং বিদ্রোহীদের বীরত্বের কাহিনী পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহকেও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
মাদলের শব্দে আমরা খেয়াল ফিরে পাই। এরই মধ্যে গোটা মাঠে জড়ো হয়েছে হাজারখানেক আদিবাসী। নানা সাজপোশাকে, খোঁপায় জবা ফুল গুঁজে, হাত ধরাধরি করে মাঠের মধ্যে নাচছে একদল নারী। মাদলের তালে তালে দোলে তাদের সমবেত কণ্ঠগুলো।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, তাদের সত্তায় সিদু-কানু বারবার ফিরে আসে। আজও অন্যায়, অত্যাচার আর নানামুখী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের রুখে দাঁড়ানোর প্রাণশক্তি সিদু-কানু। তাই প্রতি ৩০ জুনে কণ্ঠ আকাশে তুলে সাঁওতালরা গান ধরে :
নুসাসাবোন, নওয়ারাবোন চেলে হঁ বাকো তেঙ্গোন,
খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো
খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো…,
(ভাবার্থ : আমরা বাঁচব, আমরা উঠব, কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না। আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব। আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব…)
ছবি : সংগৃহীত।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমে , প্রকাশকাল: ৩০ জুন ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.