মুক্তিযুদ্ধ

মানুষের মাংস যে পিঁপড়ার পছন্দ এইডা একাত্তরে বুঝছি

স্যার কইল, ‘এলএমজিডা তোর কাছে রাখ।’ সাইডে স্টেনগানও। আইলের ধার ঘেইষা পজিশনে রইছি। ওগো ক্যাম্প একটু ওপরে। খুব কুয়াশা। কিছু দেখা যায় না। ফজরের আযান দিছে মাত্র। দেখলাম, আমার এলাকার রেজাকার আতিক। হাতমুখ ধুইয়া পাকিস্তানিগো লগে ও বেঞ্চিতে বইসা আছে। ওরাই আমগো গ্রাম জ্বালাইছে। ওরে দেইখাই ঠিক থাকতে পারি না। কমান্ডারের নির্দেশও ভুইলা যাই। ব্রাশ কইরা আতিকসহ সাত আটজনরে ফালায়া দিলাম। শুরু হইল গোলাগুলি।’’

‘‘আমার বাপ ছিল মহাঅলস। ভাবও ছিল বেশি। ধনীর পোলা। তার ওপর লেহাপড়া জানা। ওই আমলেই মেট্রিক পাশ। পাশের গ্রামের একজনের সঙ্গে উনি ভর্তি হয় পুলিশে। এক মাস পর ইউনিফর্মসহ ভাইগ্যা আসে। তহনই দাদা খেইপ্যা যায়। বাপের সঙ্গে রাগারাগি হয়। দাদা বাপেরে সম্পদ দেয় না। কয়, ‘সম্পত্তি থাকাতেই তোর কামকাজ করতে ভালা লাগতাছে না, তাইলে তোর সম্পদের দরকার নাই। রোজগার কইরা খা।’’

‘‘সংসারে তহন অভাব। আমগো পেটও চলে না। আমি ক্লাস থ্রিতে। লেহাপড়া বাদ দিয়া কামে নামি। কষ্ট করছি বহুত। মাইনসের বাড়িত বসোইরার কামও করছি। পেটেভাতে বছরে পাইতাম ৬শ টাকা। পরে মুক্তাগাছার মাড়োয়ারি সাগর বাবু, লালু বাবুর গদিত ডিউটি করতাম। উনারা ছিল পাটের ব্যবসায়ী। টাকার খতি নিয়া উনাদের লগে লগে ঘুরতাম। ডেইলি দিত একশ টাকা। গ্রামে গ্রামে গিয়া পরে আমিও পাট কিনছি।’’

তাজউদ্দিনের হাত থেকে গুলি বের করে আনার চিহ্ন
তাজউদ্দিনের হাত থেকে গুলি বের করে আনার চিহ্ন

‘‘বাপের ওপর রাগ নাই। তবে খুব ইচ্ছা ছিল লেহাপড়া করার। মা মনের কথা বুঝত। রাগ হইয়া তাই বাপেরে মাঝে মইধ্যে কইত, ‘ছেলেরে লেহাপড়া করাইতে পারলা না। ওর কামাই দিয়া ঘরে বইসা বইসা খাও। তোমার লজ্জাও নাই।’’’

বাল্যকালের দুঃখের স্মৃতি দিয়েই জীবনের গল্প শুরু করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের সংসারে সবার বড় তিনি। বাবার নাম রাজ মামুদ আর মা লোহরী। বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মানকোন বিনোদবাড়ি গ্রামে। লেখাপড়ায় তাঁর হাতেখড়ি বিনোদবাড়ি মানকোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতেই। তাঁর বাড়িতে বসেই আলাপ হয় আমাদের। শুধু দুঃখের স্মৃতিই নয়, সে সময়কার সুখস্মৃতি আজও তাঁকে আন্দোলিত করে।

https://www.youtube.com/watch?v=I5y8PzZmIag

তাজউদ্দিনের ভাষায়:

‘‘ভালো হাডুডু খেলতাম। বিভিন্ন জায়গায় তহন হায়ারে নিয়া যাইত। পাঁচশ টাকা পর্যন্ত হায়ারে খেলছি। বন্ধু জামালউদ্দিন ছিল দমে প্লিয়ার। আমি ধড়িয়া। যারে ধরতাম সে ছুটতে পারত না। মানকোন ইউনিয়নে একবার হাডুডু খেলা হইতাছে। আমি গেছি খেলা দেখতে। একটা প্লিয়ার ঠেং মেলে মেলে ডাক দেয়। কেউ ধরার সাহস করে না তারে। আমারে দেইখা সবাই কয়, ‘তাজুরে নামাও’। আমি তারে কেচকি দিয়া ধইরা ফালাইলাম। ওইদিন সবাই আমারে মাথায় নিয়া নাচছিল।’’

 সে সময় মুজাহিদ ট্রেনিং হলেই গ্রামে মিলত নানা কাজ। লাঠি হাতে ডিউটি করলেই সপ্তাহে তিনশ টাকা। তাজউদ্দিন তাই মুজাহিদ ট্রেনিংয়ে নাম লেখান। দুমাস ট্রেনিং নেন ময়মনসিংহে। এলএমজি লাগানো, খোলা, পরিষ্কার করা, পল্টু মারা, ফায়ার করা, পজিশনে যাওয়া, অ্যাম্বুস করা, গ্রেনেড থ্রো শেখানো হয় ওখানে। কিন্তু ওই ট্রেনিংই যে মুক্তিযুদ্ধে কাজে লেগে যাবে চিন্তাও করেননি সেদিন।

সেই সময়কার রাজনৈতিক অবস্থার কথা উঠতেই তাজউদ্দিন বলেন:

‘‘মুক্তাগাছায় নেতা ছিল খন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ, সামছুল হক ও ফজলু ভাই। আমরা তো শিক্ষিত ন। খালি মিছিল দেখতাম। পৌরসভার সামনে থাইকা শুরু হইত স্লোগান। মুজিব তহন বড় নেতা। একবার আইছিল মুক্তাগাছায়। বহু কষ্টে তার লগে হাত মিলাইছিলাম। কী যে ভালো লাগছিল।’’

তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন রেসকোর্স ময়দানে। মাত্র পঞ্চাশ পয়সা নিয়ে ওইদিন ট্রাকযোগে চাচা আবদুল খালেকের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায়। বাকি ঘটনা শুনি তাঁর জবানিতে–

‘‘সকালে রওনা দিয়া দেড়টায় পৌঁছাইছি রেসকোর্স মাঠে। দেহি লাঠি হাতে লোকজন অপেক্ষা করতাছে। বঙ্গবন্ধু কইলেই নাইমা পড়ব সবাই। বিকালের দিকে উনি উঠলেন। কইলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়া–’ এই যে কথাডা, এই কথাডা এহনও মনে গাইথা আছে। শুনলেই গায়ের লোম দাঁড়ায়া যায়।’’

৭ মার্চ, ১৯৭১এর পর মুক্তাগাছায় স্থানীয় নেতারা উদ্যোগ নেন ট্রেনিংয়ের। রাজবাড়িতে চলে ২০ দিনের ট্রেনিং। মেজর রেফাজ উদ্দিন ও বিডিআরের তছিমুদ্দিন ছিলেন ট্রেনার। ট্রেনিংয়ে তহন লাঠি ছিল একমাত্র ভরসা।

২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। পাকিস্তানি আর্মি মধুপুর হয়ে ময়মনসিংহ শহরে ঢুকবে। খবর পেয়ে তাজউদ্দিনরা প্রতিরোধ গড়েন মধুপুরে। আনসার, ইপিআরসহ তাঁরা প্রায় দেড়শ জন। অস্ত্র ছিল শুধুই রাইফেল। প্রতিরোধের মুখে আর্মিরা প্রথমে পিছু হটে। পরে জামালপুর হয়ে ময়মনসিংহ শহর দখলে নেয়। শহরে ঢুকেই আশপাশ জ্বালিয়ে দেয়। সবার মতো তখন তাজউদ্দিনও আত্মগোপন করেন। দাদা হাজর মণ্ডলের সহযোগিতায় অস্ত্রটিও লুকিয়ে রাখেন পারিবারিক গোরস্থানে। ভেবেছিলেন ভারতে চলে যাবেন। কিন্তু সেটি আর হয়নি।

তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিনের নাম
তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিনের নাম

কেন?

তাজউদ্দিন বলেন:

‘‘আমগো কমান্ডার ছিলেন মেজর রেফাজ উদ্দিন। তিনি তহন মধুপুর গারো বাড়িতে ক্যাম্প করেন। একটা কোম্পানি গড়ারও চেষ্টা করছিলেন। খবর পাইয়া অস্ত্রসহ আমিও জয়েন করি তাঁর ওহানে। আমরা বিশ জনের মতো। কিন্তু হাতিয়ার কম। স্যারের নির্দেশে একদিন মুক্তাগাছা থানাডা অ্যাটাক করি। ওহান থেইকা পাই ১১ডা রাইফেল। ওইগুলা দেওয়া হইল ট্রেন্ড আর্মি পার্সনদের। এইভাবে আমগো দল বড় হইতে লাগল।’’

এরপর কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?

‘‘মধুপুর গারো পাহাড়ের ভেতরে ছিল আমগো ক্যাম্প। উচা পাহাড়, লাল মাটি। ওখান থেইকা আইসা অপারেশন কইরা আমরা আবার ফিরা যাইতাম। মাঝেমাধ্যেই টাঙ্গাইলে যাওয়ার রাস্তাডায় অ্যাম্বুস কইরা বইসা থাকতাম। পাঞ্জাবিদের গাড়ি দেখলে অ্যাটাক করতাম। খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক ছিল না। তবে গারোরা অনেক সাহায্য করছে। এইভাবে আমরা অপারেশন করি ১১ নং সেক্টরের কাকরাইল, তিলকি ব্রিজ, জামালপুর থেকে মুধুপুর রাস্তার ব্রিজ, মেঘনা বাজার প্রভৃতি এলাকায়।’’

তাজউদ্দিন তখন রণক্ষেত্রে। খবর আসে তার গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে আর্মিরা। বাইয়া বিলের দক্ষিণ পাড় থেকে চেইচ্চা পর্যন্ত ওরা একদিনে মারছে আড়াইশ লোক। পাকিস্তানিদের সহযোগিতায় ছিল মানকোন গ্রামের রাজাকার জগত মুন্সী, ছালাম, করিম ফহির।

কী করত এই রাজাকাররা?

মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিন বলেন:

‘‘আওয়ামী লীগ যারা করত ওরা তাগো বাড়ি, হিন্দুদের বাড়ি দহল করত। ধান পাকলে তাগো জমি দহল করত। হিন্দু-মুসলিম নাই, বুড়া-জুয়ান নাই, পুরুষ-মহিলা নাই– রাজাকাররা যারে পাইছে তারেই তুইলা দিছে পাকিস্তানি আর্মির হাতে। আমগো বাড়িডা একদম পুড়াই দিছিল। বাপ-মা পালায়া চইলা যায় জয়দায়, নানার বাড়িত। আমি জানতাম সবাইরে মাইরালছে।’’

তাজউদ্দিনের বুকে তখন প্রতিশোধের আগুন। যেভাবেই হোক দেশটা স্বাধীন করতে হবে। সে আশাতেই একের পর এক চলছে অপারেশন। কিন্তু এক অপারেশনে হাতে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। রক্তাক্ত সে দিনটির আদ্যোপান্ত বললেন তিনি:

‘‘ফাইট চলছিল মধুপুর আর ময়মনসিংহের মাঝখানে রাঙামাটি এলাকায়। একটা স্কুলে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প করছে। আশ্বিন মাসের ৮ তারিখ। তিনডা কোম্পানি আমরা রাইতেই পজিশনে গেলাম। সকালে হবে ফাইট। কোম্পানিতে আমরা একশ। ওই সাইড থাইকা পজিশন নেয় নান্টু কোম্পানি। নির্দেশ ছিল অর্ডার দেওয়ার আগ পর্যন্ত ফায়ার না দেওয়ার। আমার স্বাস্থ্য ছিল ভালো। স্যার কইল, ‘এলএমজিডা তোর কাছে রাখ।’ সাইডে স্টেনগানও। আইলের ধার ঘেইষা পজিশনে রইছি। ওগো ক্যাম্প একটু ওপরে। খুব কুয়াশা। কিছু দেখা যায় না। ফজরের আযান দিছে মাত্র। দেখলাম, আমার এলাকার রেজাকার আতিক। হাতমুখ ধুইয়া পাকিস্তানিগো লগে ও বেঞ্চিতে বইসা আছে। ওরাই আমগো গ্রাম জ্বালাইছে। ওরে দেইখাই ঠিক থাকতে পারি না। কমান্ডারের নির্দেশও ভুইলা যাই। ব্রাশ কইরা আতিকসহ সাত আটজনরে ফালায়া দিলাম। শুরু হইল গোলাগুলি।’’

মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিনের ডান হাতের তালুতে গুলি লেগেছিল
মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিনের ডান হাতের তালুতে গুলি লেগেছিল

‘‘আমারে ওরা টার্গেট করে। একটা ছাদের ওপর বাঙ্কার কইরা চায়না মেশিনগান ফিট কইরা রাখছিল। মেশিনগান আমার দিকে তাক কইরা বৃষ্টির মতো গুলি করে। আমার সাইডে কাদের। ওর এক পায়ে গুলি লাগছে। নড়তে পারে না। ওরে ধরতে যামু, দেহি, ডান হাতডা নাড়াইতে পারি না। পিছনে চাইয়া দেহি রক্তে ভিজা গেছে আইল। শরীরে গুলি খাইছি পাঁচটা। পায়েরটা কম ক্ষত ছিল। একটা গুলি কখন যে হাতের তালু ভেদ কইরা কনুইয়ের দিকে গেছে টের পাই নাই। গুলিডা ভেতরে আটকাইয়া যায়। গোলাগুলি একটু কমলে অর্ডার আসে ব্যাক করার। সবাই পিছনে চইলা যায়। কিন্তু আমরা দুইজন পইড়া আছি। শরীর তো চলে না। বহু কষ্টে কাদেরকে নিয়া এক দেড়শ গজ পিছনে যাইতেই সাথীরা আমগো তুইলা নেয়।’’

  গুলিবিদ্ধ হওয়ার কষ্টের চেয়েও ভয়ার্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল তাজউদ্দিনের চিকিৎসার সময়টা। সে কথা বলতে গিয়ে চোখ ভেজান তিনি। বুকের ভেতরকার জামানো কষ্টগুলো যেন ঝরে পড়ে জল হয়ে। তাজউদ্দিনের মতো এক একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গল্প আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, অনেক রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়েই স্বাধীন হয়েছিল এই প্রিয় দেশটি।

চিকিৎসার সময়টার কথা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিন। তিনি বলেন:

‘‘মহিষের গাড়িতে কইরা আমগো নেওয়া হয় চাচরি বাজারে। জ্ঞান তহনও ছিল। সারা রাস্তায় হাত দিয়া রক্ত পড়ছে। ওই বাজারেই এক ডাক্তার অপারেশন কইরা হাতের গুলিডা বাইর করে। পোড়া মাংস বাইর করতে হাতের ভেতর সাড়ে তিন গজ কাপড় ঢুকায়া দেয়। কী যে কষ্ট পাইছি তহন! বাজারের পাশের চেয়ারম্যান বাড়িতে আমরা ওই রাত থাকি। এ খবর ক্যাম্পে পৌঁছাইয়া দেয় রাজাকাররা। পরের দিন সকালেই আর্মিরা পুরা বাজার ঘিরা ফেলে। ওই ডাক্তাররে তারা গুলি কইরা মারে। চেয়ারম্যানের বউ একটা নৌকায় কইরা আমগো মাউচ্চা বিলে রাইখা আসে। গার্ড হিসাবে ছিল এক সহযোদ্ধা।’’

‘‘বৃষ্টি পড়ছিল ওইদিন। ভয়ে বিলের মাঝখানের পালার ভেতর আমগো রাইখা গার্ড চইল্লা যায়। তিন দিন খাওয়া নাই। রক্ত গিয়া শরীর সাদা হইয়া গেছে। শরীরের পচা মাংসের গন্ধে কচুরিপানা থেইকা লাল পিপড়া আসে। ভাবছিলাম ওইখানেই মরমু। চাইর দিন পর সাথীরা আসে। কিন্তু আর্মিদের গানবোটের টহলে আমগো ওরা নিতে পারে না। কোনো রকমে পাড়ের একটা ছোট ঘরে আশ্রয় নেই। ক্ষত তহন পাইকা গেছে। শরীরের গন্ধে নিজেরাই ঠিক থাকতে পারি নাই। রাতভর পিপড়া তাড়াইছি। মানুষের মাংস পিপড়ার যে কত পছন্দ এইডা একাত্তরে বুঝছি। ভাবছিলাম পিপড়াই আমগো মাইরা ফেলব!’’

‘‘সকালে সাথীরা আইসা আমারে পালকির ভিতর রাইখা চাইর পাশ কাপড় পেচাইয়া নানাবাড়ি দিয়া আসে। হাতের ঘা শুকাইতে প্রায় দেড়শ ইনজেকশন দিতে হইছে শরীরে।’’

যে দেশের জন্য যুদ্ধ করলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?

মুচকি হেসে তাজউদ্দিন বলেন:

‘‘দেশ তো পাইছি, বাবা। স্বাধীন দেশের পতাকা পাইছি। তহন ওইটাই তো স্বপ্ন ছিল। এহন তো দেশ অনেক উন্নত। দেশ তো সঠিক পথেই চলতাছে।’’

মুক্তিযুদ্ধের চুয়াল্লিশ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বিতর্কিত, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন:

‘‘বিএনপি সরকারের আমলে থানা কমান্ডার হইছে অমুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকাররাও গুলি খাইছে, আহত হইছে। ওই কমান্ডারগো মাধ্যমে তহন রাজাকাররাও তালিকায় নাম ঢুকাইছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তহন আরেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারে শনাক্ত করেছে। আওয়ামী লীগের সময়ও টেকাটুকা দিয়া অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হইছে। ২৬ মার্চে এক অনুষ্ঠানে মুক্তাগাছায় দেখা হয় এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তিনি নাকি রেফাজ কোম্পানিতে ছিলেন। বললাম, ‘কই, তোমারে তো কহনও দেহি নাই?’ হাসি দিয়াই তিনি সইড়া পড়েন। এইসব দেখলে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সত্যি লজ্জা লাগে।’’

দেরিতে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, এটি শেখ হাসিনা সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিন। কিন্তু রাজাকারদের ফাঁসির পরে পাকিস্তানের নিন্দা করা হাস্যকর বলে মনে করেন। ১৯৭১ সালে সারেন্ডার করার পরও পাকিস্তানের লজ্জা হয়নি। নিন্দা জানিয়ে বরং পাকিস্তান প্রমাণ করেছে যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে সেই সব রাজাকাররা তাদের বন্ধু ছিল। তাঁর ভাষায়:

‘‘ওদের ফাঁসি হইলে পাকিস্তানের কেন বুকে জ্বলে? কই, অন্য কারও জন্য তো লাগে না! যারা বলে রাজাকারগো দোষ নাই, তারাই বলুক হেগো লাইগা পাকিস্তান কেন কান্দে?’’

 স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার কথা জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

‘‘ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়নগুলো দেখলে ভালা লাগে। আমার দেশের খেলোয়াড়রা যখন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পতাকা তুইলা ধরে তখন আনন্দে বুক ভইরা যায়।’’

খারাপ লাগে কখন?

‘‘যখন দেখি ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা লুট হইয়া গেছে। দলের দুর্নীতিবাজদের দেখলে চরম খারাপ লাগে। শেখ হাসিনার দলকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে কিন্তু দেশ সোনার বাংলা হইব না। তবে এই দায়িত্ব শুধু সরকারের একলার না, সবার।’’

পরবর্তী প্রজন্মই এ দেশকে একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করবে। মনেপ্রাণে এমনটাই বিশ্বাস করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিন। তাদের উদ্দেশে অন্তর থেকে দোয়া করে এই যোদ্ধা বলেন:

‘‘আমাদের যা দায়িত্ব ছিল কইরা দিছি। এইবার তোমরা নিজেদের যোগ্যতা দিয়া দেশটারে আগায়ে নিবা। শুধু নিজেদের স্বার্থের জন্য লোভ কইর না। মনে রাখবা, এই দেশটাই তোমার সত্যিকারের পরিচয়।’’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে , প্রকাশকাল:  ৬ জুন, ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button