মাচাং ঘর আর চন্দ্র-সূর্যের গদ্য
চন্দ্র ছিল খুবই সুন্দরী। ভাই সূর্য থেকে ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তৈরি হয় মনোমালিন্য। সূর্য বোনের রূপলাবণ্যে হিংসা করতে থাকে। তাই দু-ভাইবোনে ঝগড়া চলে হরহামেসাই। তাদের মা তা থামাতেন। একদিন তাদের বাড়িতে রেখে জরুরি কাজে মা গেলেন বাইরে। সে সুযোগে ভাইবোনে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া।
নৌকায় পরিচয় গোপালের সঙ্গে। দুর্গাপুরের স্থানীয় যুবক সে। আশপাশের সব তার চেনা। তার মুখেই শুনিবাদামবাড়ির কথা। সীমান্তবর্তী জিরো পয়েন্ট। পাহাড়ি এলাকা সেটি। তিনদিকে ভারতের মেঘালয়ের ডাইজাকুলা, কাংকুলবাড়ি আর রাঙাছড়া। মাঝখানে বাদামবাড়ি। সেখানে বসবাস করে গারো আদিবাসীরা। গারোদের বেশির ভাগ ধর্মান্তরিত হলেও ওখানকার আদিবাসীরা আজো টিকিয়ে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের জাত ধর্মকে। সব শুনে আমরাও রাজি হয়ে যাই।
তখন মধ্য দুপুর। দুর্গাপুর হয়ে তিন নালীর মোড় পেরিয়ে আমরা ডাহাপাড়ার পথ ধরি। ডাহাপাড়ার ওপাশেই বাদামবাড়ি। তবে পেরুতে হবে পাহাড়ি পথ। চারপাশে সবুজের সমারোহ। সবুজ ধানক্ষেত গিয়ে মিশেছে পাহাড়ঘেরা সবুজের ধারে। দূরে মেঘালয়ের বড় বড় সব পাহাড়। একেক জায়গার প্রকৃতি একেক রকম। পাহাড়ি পথে যেতে যেতে গোপাল কথা তুলে গারোদের নিয়ে।
গারো আদিবাসীদের আদি নিবাস আসাম। ধারণা করা হয়, তাদের পূর্বপুরুষরা কোনো এক সময়ে তিব্বত থেকে ব্রক্ষপুত্র নদী পার হয়ে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। গারোদের নামানুসারেই আসামের পাহাড় শ্রেণীর নাম-গারো পাহাড় রাখা হয়েছে।
বাদামবাড়ির পথ শুরু হয় পায়ে জড়ানো লাল মাটিতে। লালমাটির উঁচু-নিচু টিলা। মিনিট বিশেক চলতেই টিলাসম একটি পাহাড়ের দেখা মিলে। এখানেই নজরে পড়ে কয়েকটি গারো বাড়ি।
বাদামবাড়িতে ৫০টির মতো গারো পরিবারের বাস। একটি টিলার ধার ঘেঁষা পথে উপরে উঠতেই আমাদের চোখ ওঠে কপালে। বেশ কয়েকটি বাঁশের তৈরি মাচাঘর। একটি ঘরের মাচায় পা দুলিয়ে বসে আছে শিশুরা। আমাদের দৃষ্টি আটকে যায় একটি ঘরের দিকে। উঁচু মাচায় ছোট্ট একটি মুরগির ঘর। গারো ভাষায় ‘দেক চি দিক’। সেটিতে মুরগি ওঠার জন্য রয়েছে বাঁশের বিশেষ সিঁড়ি।
বাড়ির উঠোনে বসা একজন বৃদ্ধ। বয়স আশির মতো। সামনে জাল ছড়ানো। মনোযোগ দিয়ে তিনি সেলাই করছেন জালের ছেড়া অংশ। কথা বলতেই নিজের নাম জানালেন রুগেন সাংমা। বৃদ্ধর পাশেই মাদুর বিছিয়ে আমাদের বসার জায়গা করা হয়। নামের শেষে টাইটেল কেন সাংমা? এমন প্রশ্নে কাঁপাকাঁপা গলায় মিলে উত্তরটি-
একবার এক গারো নারী জন্মদেন দুটি জমজ পুত্রসন্তান। বড় হয়ে সে সন্তান দুটি হয় অসীম সাহসী। সবার কাছে তারা বীর হিসেবেই পরিচিতি পায়। একবার ভাইদের একজন দেশ জয়ের উদ্দেশ্যে পূর্বদেশে যাত্রা করে। যাত্রার পূর্বে সে অপর ভাইকে গ্রাম ও গোষ্ঠী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে যায়। ওই ভাই নানা আচার পালনের পাশাপাশি ভাইয়ের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রহর গুনত। গ্রামে থাকা ভাইটি কখনো মাটিতে লম্বা হয়ে ঘুমাত না। কারণ তার বিশ্বাস তার দেহে ও মাথায় ধূলাবালি লাগলে অপর ভাইয়েরও অমঙ্গল হবে। তাই সে দন্ডায়মান অবস্থায় কোনো কিছুর সাথে হেলান দিয়েই ঘুমাত।
ছেলের এমন কষ্ট দেখে মায়ের মন কেঁদে ওঠে। সে তার জন্য মাচাং ঘর তৈরি করে। যাতে সে ধুলাবালির সংস্পর্শ এড়িয়ে আরামে ঘুমাতে পারে। গারো সমাজে সেটিই ছিল প্রথম মাচাং ঘর। সে সময় সমাজের লোকেরা ওই মাকে সম্মানের সঙ্গে ডাকতেন চাংমা অর্থাৎ মাচাং ঘরের মা বলে। কালক্রমে চাংমা সম্বোধনটি সাংমাতে রূপান্তরিত হয়। পরে ওই মায়ের বংশধরেরা সাংমা হিসেবেই গারো সমাজে পরিচিতি পায়।
তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় এক গারো নারী। তার পিঠে বিশেষ ভঙ্গিতে একটি শিশু বাঁধা। নাম তার মিথিলা সাংমা। ফিরেছেন কাজ থেকে। দুই পাহাড়ের মাঝে সমতল জায়গায়। সেখানে ধান আর লেবু চাষ করে যা পান তা দিয়েই চলে আদিবাসীদের পরিবারগুলো। মিথিলা জানান, এ ছাড়া পাহাড়ে নানা শস্যেরও চাষবাস করেন তাঁরা।
কথা জমে উঠছিল। এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে মুড়ি হাতে আসেন এক বৃদ্ধা। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু বয়সের ভার এখনো তাঁকে নোয়াতে পরেনি। তিনি রুগেন সাংমার সহধর্মিণী। নাম-সাইলো মারা।
মুড়ির টানে পাশের বাড়ির বেলেমান সাংমা ও শাহজত সাংমাও আসরে যোগ দেন। গারোদের আদি বিশ্বাসগুলো নিয়ে আলাপ চলে রুগেনের সঙ্গে। তিনি গল্পের মতো করে বলেন একটি গারো কাহিনী।
তখন চারদিকে ছিল পানি আর পানি। কোথাও স্থলের চিহ্ন নেই। সবকিছু অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এমন অবস্থা দেখে ভগবান তাতারা রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টির ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি নস্ত নুপাস্তকে স্ত্রীলোকের আকার দিয়ে পাঠালেন। সঙ্গে দিলেন কিছু বালি। নস্ত নুপাস্ত প্রথমে মাকড়সার জালে আশ্রয় নিয়ে সব জলরাশির ওপর সে জাল বিস্তার করলেন। অতঃপর তিনি সঙ্গে আনা বালি মুষ্টিবদ্ধ করে পানিতে নিক্ষেপ করে বললেন, অনন্ত জলরাশির নীচ থেকে মাটি নিয়ে এসো। যথা সময়ে মাটি আসল এবং নস্ত নুপাস্ত সে মাটি দিয়ে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। গারো ভাষায় একে বলে, মেন পিলটি।
পৃথিবী সৃষ্টির পর ভগবানের কাছে তা ভিজে মনে হলো। তাই তিনি তা শুকাতে আসিমা দিংগাসীমার পুত্র ও কন্যাকে স্থাপন করলেন পৃথিবীতে। এরাই রেঙ্গরা বলসা (সূর্য) ও বীরে জিতজে (চন্দ্র)। তাই গারোদের কাছে চন্দ্র ও সূর্য ভাইবোন। এভাবে পৃথিবী বসবাসের উপযোগী হিসেবে তৈরি হয়।
পাশে বসা গোপালের প্রশ্ন ছিল, চন্দ্র কেন কম আলো দেয়? উত্তরে রুগেন মুচকি হেসে বলেন, চন্দ্র ছিল খুবই সুন্দরী। ভাই সূর্য থেকে ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তৈরি হয় মনোমালিন্য। সূর্য বোনের রূপলাবণ্যে হিংসা করতে থাকে। তাই দু-ভাইবোনে ঝগড়া চলে হরহামেসাই। তাদের মা তা থামাতেন। একদিন তাদের বাড়িতে রেখে জরুরি কাজে মা গেলেন বাইরে। সে সুযোগে ভাইবোনে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। সে ঝগড়া এক সময় রূপ নেয় হাতাহাতিতে। প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় সূর্য। মুঠি ভরা কাদা নিয়ে বোন চন্দ্রের মুখে তা লেপ্টে দেয় সে।
এতে বোনও হয় উত্তেজিত। ভাই সূর্যকে শায়েস্তা করতে হবে। তাই মুখের কাদা না ধুয়ে সে অপেক্ষা করে মায়ের জন্য। মা বাড়িতে আসতেই চন্দ্র কাঁদা মাখা মুখ দেখিয়ে বর্ণনা করে ভাইয়ের কীর্তি। মা এতে খুশি হন না। বরং চন্দ্রের এ আচরণে তিনি ক্ষেপে যান। এক পর্যায়ে তিনি মেয়ে চন্দ্রকে অভিশাপ দেন, চিরদিনই তার মুখ যেন এমনি কর্দমাক্ত থাকে। আদিবাসী গারোরা বিশ্বাস করে, সে থেকেই চন্দ্রের মুখে কলঙ্ক লাগে এবং সূর্যের চেয়ে কম আলোর অধিকারিণী হয়।
রুগেন কথা থামাতেই কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বজ্রপাতের কাহিনী শোনান সাইলো।
আকাশ দেবতার নাম গোয়েরা। এক সময় সে মর্তে বাস করত। তাঁর ছিল চমৎকার এক তরবারি। তিনি সে তরবারি দিয়ে একবার পাহাড়ের মতো এক প্রকাণ্ড দানবকে হত্যা করেন। তাঁর এমন সাহসিকতায় ভগবান খুশি হন। তিনি পুরস্কার স্বরূপ তাঁকে আকাশে বাস করবার অনুমতি দেন। সে থেকেই তিনি আকাশে বাস করেন। কিন্তু এখনো তিনি তরবারি চালানোর অভ্যেস ত্যাগ করতে পারেননি। তরবারি নিয়ে খেলার সময় যে শব্দের উৎপত্তি হয় গারোদের কাছে তাই বজ্রের শব্দ। আর তরবারির ঝলকানি হলো বিদুৎ।
কেন পৃথিবী কেপে ওঠে? এমন প্রশ্নের উত্তরে রুগেন বলেন, পৃথিবীটা বিরাট এক ষাড়ের মাথায় অবস্থান করছে। ভারসাম্য রক্ষার জন্য ষাড় পৃথিবীটাকে মাঝে মধ্যে এক শিং হতে অন্য শিংয়ে স্থানান্তর করান। তখনই পৃথিবী খানিকটা কেপে উঠে বা ভূকম্প হয়।আবার ষাড়ের কানের কাছে আছে এক বিরাটাকার মাছি। ষাড় এ মাছিকে ভয় করে। মাছি ষাড়কে মনে করিয়ে দেয় বেশিক্ষণ পৃথিবী কম্পিত হলে সৃষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে। তখন ষাড়ও সতর্ক হয়ে যায়। ফলে কম্পনও থেমে যায়। এতে ভূমিকম্প খুব কম সময় স্থায়ী হয়। গারো সমাজে প্রচলিত এই কাহিনীগুলোর সত্যতা মিলে প্রয়াত আব্দুস সাত্তারসহ দেশি-বিদেশি আদিবাসী গবেষকদের সংগৃহীত তথ্যাদি থেকেও।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। ঝিঝি পোকার ডাক আর জোনাকির আলো আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা তখন ফিরতি পথ ধরি। ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসে আদিবাসীদের ভাজপড়া মুখগুলো। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের কাহিনীগুলো মনের ভেতর জীবন্ত হয়ে থাকে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমে , প্রকাশকাল: ২৩ জুলাই ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.