পত্রিকায় ইন্টারভিউ

‘শিশুর কাছে ইতিহাস জটিল পাঠ্যপুস্তক’

সালেক খোকন একজন প্রাবন্ধিক ও গবেষক। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক লেখালেখি আর সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত তিনি। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি তার। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ ও অনলাইন পত্রিকায়।

সাক্ষাতকার নিয়েছে পৃথা প্রণোদনা

তার রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা বিভাগে ‘কালি ও কলম’ পুরস্কার লাভ করে। তিনি একজন সফল আলোকচিত্রীও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, প্ল্যান বাংলাদেশ, সিবিএম ইন্টারন্যাশনাল, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ-এর সহযোগিতায় আইআইএসবি আয়োজিত আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ২০১৩ সালে তিনি দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। তার রচিত ‘ভিন্ন জাতির লোকজ উৎসব’ গ্রন্থটি পাঠাভ্যাস কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেকায়েপ প্রকল্পের আওতায় অষ্টম শ্রেণির জন্য নির্বাচিত হয়েছে।

সম্প্রতি এই অসাধারণ মানুষটির মুখোমুখি হয় হ্যালো।

হ্যালো: আপনার শৈশব কেটেছে কীভাবে?

সালেক খোকন: শৈশব কেটেছে আনন্দ হাসির মধ্য দিয়ে। লেখাপড়ারটা ছিল আনন্দের বিষয়। এখনকার মতো চাপ তখন আমাদের ওপর ছিল না। আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। শিক্ষকদের সত্যিকারের ভালবাসাটা আমরা পেয়েছিলাম। মহানগরের কাফরুল এলাকায় বড় হলেও এখানেই আমরা ঘুড়ি উড়িয়েছি, শিপ দিয়ে মাছ ধরেছি, নানা রঙের প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়িয়েছি, আরও কতই না মজা করেছি।

হ্যালো: শৈশবের কোনো মজার ঘটনার কথা মনে পড়ে কী?

সালেক খোকন: আমরা নিজেরাই স্কুলে চলে যেতাম। এখনকার অভিভাবকদের মতো তখন কেউ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে স্কুলে যেত না। খুব ছোট বেলায় একবার পরিক্ষা দিয়ে সেই খাতা নিয়েই বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আরেকবার ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরছি কখন যে বইগুলো ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েছে টেরই পাইনি। বাড়ি ফিরে মায়ের সে কি বকুনি।

হ্যালো: ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক বিষয়ে ঝোঁক বেশি হওয়ার কারণ কী?

সালেক খোকন: নিজের ভেতরে হয়তো একটা আগ্রহ দানা বেঁধে ছিল। তবে পরিবেশটাও অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। কারণ ক্লাস সেভেন থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। তখন পাঠচক্র করতে হতো নিয়মিত। নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরও আয়োজন চলত। সমাজের ভাল কিছু করার যে মানসিকতা সেটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওই সময়টাতে। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে যুক্ত হই এরই ধারাবাহিকতায়। ইন্টারমেডিয়েটের পর গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হই। এছাড়া ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। পরে কাফরুলে উত্তরসূরি নামক আমরা একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে তুলি।

হ্যালো: কী ভেবে আদিবাসী ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন?

সালেক খোকন: কড়া নামক একটি আদিবাসী জাতি এদেশে টিকে আছে। ওরা মাত্র ১৯টি পরিবার রয়েছে। এদের বাস দিনাজপুরে। মুলত তাদের টিকিয়ে রাখার চিন্তা থেকেই আদিবাসী বিষয় নিয়ে লেখা শুরু। আর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। পরবর্তী প্রজন্মও যেন এটি উপলব্ধি করতে পারে তার জন্য তো একাত্তরের বীরদের কথা তাদের আত্মত্যাগের কথা তুলে আনতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলম ধরা শুরু।

হ্যালো: বর্তমানে বেশিরভাগ শিশু ইতিহাস পড়তে পছন্দ করে না। এর কারণ কী?

সালেক খোকন: শিশুদের কাছে ইতিহাস এখন কঠিন ও জটিল পাঠ্যপুস্তক হয়ে গেছে। সবকিছু তুলে ধরা হয়েছে শুধুই পরীক্ষায় পাশের জন্য। শিশুরা এখন এ প্লাস পাওয়ার জন্য পড়ে, জানার বা জ্ঞানার্জনের জন্য নয়। তাদের কাছে গল্পের মতো করে দেশের ইতিহাস তুলে ধরতে পারলে অবশ্যই ইতিহাস পাঠে তারা আগ্রহী হবে। নিজের দেশের ও জাতির ইতিহাস না জানলে তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছ এবং কোথায় পৌঁছাবে সেটি কিন্তু বুঝতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের বীরদের কথা না জানলে তোমার মধ্যে বীরত্ব তৈরি হবে কিভাবে?

হ্যালো: এখন পর্যন্ত আদিবাসী ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী কী কাজ করেছেন?

সালেক খোকন: আদিবাসী গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে তুলে আনছি তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সুখ-দু:খের নানা কাহিনী। এছাড়া তৃণমুল পর্যায়ের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্য সংগ্রহ ও গণকবরের পেছনের গদ্য তুলে আনার চেষ্টা চলছে। আদিবাসী বিষয়ক সাতটি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

হ্যালো: আপনার রচিত যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা ক্যাটাগরিতে ২০১৫ সালে ‘কালিও কলম’ পুরস্কার পায়। এ নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?

সালেক খোকন: উৎসাহের ও কমিটমেন্টের ভিত খানিকটা শক্ত হয়েছে। তবে পুরস্কার খুবই আপেক্ষিক বিষয় বলে মনে করি। কাজটি চালিয়ে যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। লেখা প্রকাশের পর কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা আদিবাসীর মুখে যে তৃপ্তির হাসিটা দেখি সেটিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

হ্যালো: শিশুদের জন্য কিছু বলবেন?

সালেক খোকন: মনে রাখবে তুমি লেখক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যাই হও না কেন সবার আগে হতে হবে ভাল মানুষ। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাটা খুব জরুরি। পরিশ্রম ও চেষ্টাই তোমাকে তোমার স্বপ্নের কাছে নিয়ে যাবে।

হ্যালো: হ্যালোকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সালেক খোকন: তোমাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমের হ্যালো-তে , প্রকাশকাল: ২৮ এপ্রিল ২০১৬

 

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button